প্রকাশমনি: লালুপ্রসাদ সাউয়ের চিত্রকর্ম।
সম্প্রতি গ্যালারি ৮৮-তে শিল্পী লালুপ্রসাদ সাউয়ের এক অনন্য প্রদর্শনী দেখা গেল। শিল্পীর জন্ম ১৯৩৭ সালে, বীরভূমের সিউড়ি সদরে। কলেজে গোপাল ঘোষ এবং অজিত গুপ্তকে পেয়েছিলেন শিক্ষক হিসেবে। অজিত গুপ্তের কাছে টেম্পেরায় শিক্ষাগ্রহণ। কী ভাবে লেয়ারের পর লেয়ার দিয়ে টেম্পেরার জমি তৈরি করতে হয় শিখে নিয়েছিলেন। এরও পরে সনৎ করের কাছে এচিং-এর শিক্ষালাভ। দীর্ঘ ১৮ বছর গ্রাফিক্সের কাজ করেছেন। তার পরে ধীরে ধীরে তাঁর ছবিতে এল ফিগার পেন্টিং। প্রথমে করেছেন ফ্ল্যাট ভাবে মিনিয়েচার ঘরানার কাজ, মোগল-রাজপুত ইত্যাদির অনুপ্রেরণায়।
‘ব্লসমস’ শীর্ষক প্রদর্শনীতে শিল্পীর বহু ভাবের ‘বাবু বিবি’ সিরিজ়ের কাজ দেখা গেল। মোটামুটি ১৫টি ছবি, পেপার বোর্ডের উপরে টেম্পেরার কাজ ও কিছু পেপারবোর্ডের উপরে কন্টি-পেন্সিলের ড্রয়িং। প্রায় সব ছবিই শিরোনামহীন। পুরনো দিনের নানা চরিত্র এঁকেছেন, যেগুলি ঔপনিবেশিক অতীতের সঙ্গে দেশজ ভাষার মিলনে এক অদ্ভুত মজার সৃষ্টি। শিল্পী একই সঙ্গে তাঁর চরিত্রগুলিকে কিছুটা মহিমান্বিত করেছেন, আবার কোথাও তাঁদেরই নিয়ে ব্যঙ্গরস সৃষ্টি করেছেন। আসলে ‘বাবু বিবি’ সিরিজ়ের ছবিগুলি ঠিক সহজ-সরল ছবি হিসেবে ভাবা যায় না। এ সব চরিত্রের প্রতি ব্যঙ্গের ভাব কখনও কখনও লক্ষণীয়। সব ছবি দ্বিমাত্রিক এবং রঙিন।
গ্যালারির অন্য অংশে ‘ইমপ্রিন্টস’ শীর্ষকে তাঁর অনবদ্য কিছু গ্রাফিক্সের কাজ দেখা গেল। এই কাজগুলি মূলত ১৯৭৬ সাল থেকে ২০০৪ সালের কাজ। এখানে যে সব ছাপাই ছবি দর্শক দেখতে পেলেন, সেগুলি তাঁর ফিগারেটিভ কাজে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার পরের পর্যায়ের কাজ। গ্রাফিক্স ছবিগুলি সম্পন্ন করার সময়ে কলাভবনে তিনি শিক্ষকতা করছিলেন। এই সব গ্রাফিক্স ছবির ভিতরে দেখা গেল লিথোগ্ৰাফ, সাদাকালোর এচিং, রঙিন এচিং, লিনোকাট এবং সেরিগ্রাফ। সবই কাগজের উপরে ছাপ নেওয়া। ছাপাই ছবির প্রায় সব নকশা বা ডিজ়াইনই এখানে বিমূর্ত। শিল্পী লালুপ্রসাদ সাউ এই সমস্ত কাজের মাধ্যমে প্রমাণ করেছিলেন যে, অ্যাকাডেমিক হিসেবে তাঁর জায়গা সব সময়েই অটুট থাকবে এ দেশের শিল্পজগতে। অতি অনায়াসে ক্রমাগত ছাপাই ছবির কাজ সম্পন্ন করেছেন এবং তারই সঙ্গে চালু রেখেছেন টেম্পেরায় করা ফিগার পেন্টিং। অতি উৎকৃষ্ট সব কাজ এই প্রদর্শনীর জন্য যত্ন করে সাজিয়েছেন গ্যালারির অধ্যক্ষা সুপ্রিয়া বন্দ্যোপাধ্যায়।
ছবির ব্যাপারে শিল্পী নিজেই বলেছেন যে, তাঁর ছবি সোজা-সরল। ঊনবিংশ শতাব্দীর বাঙালি জীবনযাত্রার ভাবধারাটুকু তিনি ধরার চেষ্টা করে গিয়েছেন। শান্তিনিকেতনের মেলায় দেখা বিভিন্ন মানুষকে এঁকেছেন। কখনও সেখানে পাওয়া যায় কৌতুকরসের ছোঁয়া। ইচ্ছাকৃত ভাবেই তিনি ও ভাবে পরিবেশন করেছেন কাজগুলি। এ ছাড়াও ‘বাবু বিবি’ ছবির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি সাহায্য পেয়েছিলেন যামিনী রায়ের ছবি থেকে, আর কালীঘাটের পট থেকে। পরের দিকের ‘বাবু বিবি’র ছবির আঙ্গিকে একটু পরিবর্তন আনার চেষ্টা করেছেন শিল্পী, ছবিকে অন্য দিকে চালিত করার জন্য। প্রথম দিকের ছবিতে ক্রিসক্রস লাইন দিয়ে রাজস্থান বা মোগল পেন্টিংয়ের মতো ভলিউম তৈরি করার প্রবণতা ছিল, ক্রমশ সেটা তিনি ত্যাগ করেন।
অ্যাবস্ট্রাক্ট কাজের ধরনে এক কঠিন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হন শিল্পী। সেই সময়ে রথকোর কাজের দ্বারা অনুপ্রাণিত ছিলেন তিনি। নিজেই বলেছেন, ‘‘বিমূর্ত কাজের পথটি বড়ই কঠিন। সে যেন এক অন্ধকার গলি’’।
শিল্পী লালুপ্রসাদ সাউয়ের সম্পূর্ণ কাজের এক বিস্তার দর্শকের সামনে উপস্থিত করা হয়েছে এই প্রদর্শনীতে। এক দিকে ‘বাবু বিবি’ সিরিজ়ের দ্বিমাত্রিক ও রসাত্মক ছবি, তার সঙ্গে নিখুঁত ড্রয়িংয়ের সম্ভার— অন্য দিকে, সম্পূর্ণ বিমূর্ত সব ছবি, যেগুলি অবয়ব ভেঙে নিজ রূপে বিদ্যমান। সেগুলি হয়তো মেশিনারি বা যন্ত্রপাতিকে খুব কাছ থেকে দেখার ফল। সাদাকালোয় করা অনবদ্য সব কাজ। বাকি অংশে সূক্ষ্মতম লাইন এবং মিশমিশে কালোর আশপাশে ধূসর উপচ্ছায়া। শিল্পরসিকদের জন্য এই প্রদর্শনী অত্যন্ত উপভোগ্য।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy