Advertisement
২২ ডিসেম্বর ২০২৪
Christmas 2024

বঙ্গে বড়দিন, বাঙালির বড়দিন

তাঁর জন্মদিন মানেই ক্রিসমাস ক্যারলের সুর আর হাওয়ায় চেরি, মোরব্বা, কাজু, আখরোট মেশানো কেকের গন্ধ। মানবপুত্রকে নিয়ে তৈরি কবির গানে মুখরিত শান্তিনিকেতনের ‘খৃষ্টোৎসব’। বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে জেগে থাকা গির্জায় সকলের প্রার্থনা। শতকপ্রাচীন ঘণ্টার ধ্বনিতে ভেসে আসে স্মৃতিগুচ্ছ।

জন্মদৃশ্য: শিল্পীর কল্পনায় বেথলেহেমের সেই আস্তানায় মা মেরির কোলে সদ্যজাত জিশু খ্রিস্ট।

জন্মদৃশ্য: শিল্পীর কল্পনায় বেথলেহেমের সেই আস্তানায় মা মেরির কোলে সদ্যজাত জিশু খ্রিস্ট।

সেবন্তী ঘোষ
শেষ আপডেট: ২২ ডিসেম্বর ২০২৪ ০৯:৪৩
Share: Save:

একদিন যারা মেরেছিল তাঁরে গিয়ে

জুলিয়া কেরকেট্টা, সিনথিয়া ভুজেল, এবিগেল লেপচা চা-বাগানের ভিতরে ছিমছাম ছোট্ট চার্চের বারান্দায় বসে বড়দিনের কেক নিয়ে আলোচনা করছিল। তিন জনেই উপদ্রুত রণাঙ্গন ইজ়রায়েল থেকে সদ্য ফিরে এসেছে। গত দশ-বারো বছরে চুক্তিভিত্তিক ন্যানি বা বয়স্কদের দেখাশোনার দায়িত্ব নিয়ে এ দিকের পাহাড়ি এলাকা থেকে মেয়েরা ইজ়রায়েলে যায়। অবিগেল বা এবিগেল নামটি যে হিব্রু প্রভাবিত, আপনি ওদের সঙ্গে মাটিতে থেবড়ে বসে সে গল্প জুড়বেন। জেনে বিস্মিত হবে না স্বল্পশিক্ষিত মেয়েটি। বলবে, সে খ্রিস্টান হওয়া সত্ত্বেও তার মালিক ওই পোলিশ ইজ়রায়েলি দাদু-ঠাকুমা, এই নামটির কারণে বড়দিনের উপহার হিসেবে দুটো ফ্যান্সি ড্রেস কিনে দিয়েছেন। ঈষৎ দুঃখের সঙ্গে বলবে, যুদ্ধ না বাধলে কী সুখেই যে ছিল তারা! তবে আনন্দ এই, অনেক দিন পরে বড়দিনে এ বারে নিজের এলাকার চার্চে কাটাবে। তাদের শৈশবে বাগানের ম্যানেজারের বৌ ইভলিন কলকাতা থেকে কেক তৈরি করে আনতেন। ওই এক টুকরো কেক পাওয়ার জন্যে হুড়োহুড়ি পড়ে যেত ওদের মধ্যে। রামের গন্ধ মেশানো কেকের ভিতর আসল চেরি, মোরব্বা, কাজু, আখরোট, কিসমিস এত বেশি থাকত যে, ময়দাই খুঁজে পাওয়া যেত না। এ বারে ওরা অনলাইনে এমনই কেক অর্ডার দিয়েছে, যেন এলাকার খ্রিস্টান পরিবার ছাড়া সমস্ত আত্মীয়-বন্ধুও সে কেকের স্বাদ পায়— চার্চের প্রাঙ্গণে বসে তারই হিসাব-কিতাব শুনে আসবেন।

বলে ফেলতেও পারেন, ইহুদিরা তো বড়দিন পালন করে না। ওই সময় তাদের অন্য পরব। তা ছাড়া জন্মসূত্রে ইহুদি জিশুকে হত্যার জন্যও দায়ী তারাই। অবিগেল তার গলার ক্রুশ-লকেট দুলিয়ে, সুতোর কাজ করা চমৎকার স্কার্ফ টেনে শীতের হাওয়ায় কান চাপা দেবে। বলবে, ‘কোনও হত্যার জন্য একটা গোটা জাতকে কি দায়ী করা যায়? ওই যে এখন যুদ্ধ চলছে, একটা ডোম বানিয়েছে ইজ়রায়েল। প্যালেস্টাইনের বোমা পড়বার আগেই টেনে নেয় ওই ডোম। এটা বলছে ওরা, কিন্তু সবটাই কি এত সহজ? সাধারণ জনগণ, শান্তিপ্রিয় মানুষ কী চাইছে? তারা কি সবাই ডোমের তলায়থাকতে পারছে? বাধ্য হয়ে যাদের লড়তে যেতে হচ্ছে, তারা?’

আপনি এই চার্চের পাশে, ঈষৎ ঢালুতে দাঁড়িয়ে থাকা, বাগানের সুপ্রাচীন ডিরেক্টর’স বাংলোর দিকে তাকাবেন। এই বাংলো থেকে চা-বাগানের কলোনির ইতিহাস মুছে গেলেও ম্যানেজার হিসেবে বেটম্যান, ওয়েবস্টার, হ্যাগার্ট, ম্যাকেঞ্জি, ব্রুস, টার্নার ধরনের পদবিগুলো খুঁজে পাবেন। অনুমান করা যায়, চার্চ-সংলগ্ন বাংলোয় খুব ঘটা করে বড়দিন পালিত হত। এই চা-কর সাহেবরাই সাঁওতাল পরগনা, ছোটনাগপুর,অধুনা ঝাড়খণ্ডের সরল সহজ মানুষগুলিকে ডুয়ার্সের মেঘ-ডাকা অরণ্যে বাগিচা-শ্রমিক হিসেবে আড়কাঠি দিয়ে তুলে এনেছিল। জল, জঙ্গল, শ্বাপদ, অতিবৃষ্টি, চাবুকের মোকাবিলায় এই যে আদিগন্ত বিছানো চা-বাগান, এ তো তাদেরই রক্তে তৈরি। ওই সব স্কটিশ, ইংরেজ চা-কররা আজ পাহাড়ের লুকোনো ঢালে, পাথর বিছানো ঝোরার কিনারায় নামহীন কবরে শায়িত। এক দিন তারা সত্যকথনের দায়ে আত্মাহুতি দেওয়া এক শ্রমজীবী পরিবারের সন্তানের জন্মদিন পালন করেছে কাটগ্লাসে, হুল্লোড়ে। আজ তাদের ছেড়ে যাওয়া ধর্মের উত্তরাধিকারে চা-শ্রমিকদের উত্তরপুরুষ ও নারীদের অন্তরের দেবতা হয়ে উঠেছেন প্রভু জিশু। রাজপুরুষের বাংলো ছেড়ে মাটি পাথরের উঠোনে নেমে এসেছেন সূত্রধর সন্তান।

সিনথিয়া হেসে বলবে, ‘বড়দিনের সাজসজ্জায় এ বারে মেয়েরাই বেশি এগিয়ে। জানেন তো, চা-শ্রমিক হিসেবে পুরুষের চেয়ে সংখ্যায় আমরাই বেশি? টাকাও আমরা জমিয়ে রাখতে পারি পুরুষের চেয়ে ঢের বেশি গুছিয়ে। মা মেরি ছাড়া জিশুকে কি দেখা যায়?’ তাল দিয়ে বলবে অবিগেল, ‘সব লড়াই বাধায় তো রাজারা।’

অযোনিসম্ভূত অবতারবাদের আখ্যান এদের কাছে কোনও অর্থ বহন করে না, জানেন আপনি। বরং অবিগেলের শেষ কথাটা আপনার মন টেনে রাখবে। আপনার মনে পড়তে পারে, তীব্র ব্যথার সুরে রবীন্দ্রনাথ মানবপুত্র জিশুকে নিয়ে শিরোনামের গানটি লিখছেন ১৩৪৬ বঙ্গাব্দের ৯ পৌষে (২৫ ডিসেম্বর, ১৯৩৯)। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জীবদ্দশায় তাঁর রচিত যে গানগুলো গ্রামোফোনে রেকর্ড করেছিলেন, সেগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ইউরোপ বিধ্বস্ত করে দিচ্ছে, কলোনি হিসেবে আমরাও তার সঙ্গে ভীষণ রকম ভাবে জড়িয়ে পড়েছি।

‘কেথলিক দল সব প্রেমানন্দে দোলে

শিশু ঈশু গড় দেয়, মেরিমার কোলে’

‘বড়দিন’ শীর্ষক কবিতায় ঈশ্বর গুপ্ত লিখছেন, ‘যদিও আমরা ওই হিন্দুর সন্তান/ বড়দিনে সুখী তবু খ্রিস্টান সমান’। যে ঈশ্বর গুপ্ত নব্য মহিলাদের বিষয়ে ব্যঙ্গের খড়্গ নিয়ে বসে থেকেছেন, পাশ্চাত্য থেকে আসা আধুনিকতা নিয়ে যিনি সদা সরব, তিনিই জিশুকে হিন্দুর বড় আদরের ধন, সাক্ষাৎ গোপালের জায়গা দিয়েছেন! ‘যশোদার কোলে যথা, গোপালের শোভা’। আর চুঁচুড়ার রামরাম বসু বাংলা ভাষায় ‘খ্রিস্ট সঙ্গীত’ (১৭৮৮) রচনা করে তথাকথিত বাংলার সমাজে আলোড়ন তুলেছিলেন সেই কবে! যে নজরুল ইসলাম শ্যামাসঙ্গীত লিখছেন, তাঁর বড়দিন নিয়ে লেখায় অবাক হওয়ার মতো কিছু নেই। সমাজের খেটে খাওয়া শ্রেণি থেকে উঠে আসা সর্বহারার নেতা হিসেবে, জিশু তাঁর লেখায় ফিরে ফিরে এসেছেন— ‘পচে মরে হায় মানুষ, হায় রে পঁচিশে ডিসেম্বর!/ কত সম্মান দিতেছে প্রেমিক খ্রিস্টে ধরার নর!/ ধরেছিলে কোলে ভীরু মানুষের প্রতীক কি মেষশিশু?/ আজ মানুষের দুর্গতি দেখে কোথায় কাঁদিছ যীশু!’

রামমোহন রায়, রামকৃষ্ণদেব থেকে স্বামী বিবেকানন্দ, কবিতার ভুবনে সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত থেকে জীবনানন্দ দাশ, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, অমিতাভ দাশগুপ্ত— বড়দিনে ডুবে থাকেননি কে? সবাই মানবপ্রেমিক জিশুকে স্মরণ করেছেন।

‍‘...হাওয়া আসছে কয়েক’শ বছর থেমে থেমে/ কুয়াশারা সরে এলো, কে যেন নামছে, চুপ,/ খড়ে, বেথেলহেমে...’ (‘ক্রীসমাস ও শীতের সনেটগুচ্ছ’)। জয় গোস্বামীর এই কবিতার বই এক দিন কাঁপিয়ে দিয়েছিল কবিতা-পাঠককে। কবি বলছেন, রানাঘাটে তাঁর বাড়ি। বাড়ি থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরত্বে দু’টি জায়গায় দু’টি চার্চ। দয়াবাড়ি ও বেগোপাড়ার চার্চ দু’টির একটি ক্যাথলিকদের, অন্যটি প্রোটেস্টান্টদের। দল বেঁধে তাঁরা বড়দিনের উৎসব দেখতে যেতেন। আরও দূরের পথ পেরিয়ে চূর্ণী নদীর ও-পার থেকে আসত সহপাঠী বন্ধু আসগর আলি মণ্ডল, লতিফ। যেমনটা সবাই মিলে দুর্গোৎসব, ইদ পালন, তেমনই বড়দিনে এই বন্ধুদের সঙ্গে মিলে ছিল তাঁদের উৎসব উদ্‌যাপন। ‘লাল বাড়ি; ক্রীসমাস গাছে খেলনা জাহাজের ভোঁ; সাদা বুড়ো, সাদা শিশুরাও...’ সম্প্রদায় ও মতবাদের ঊর্ধ্বে জিশুর সর্বব্যাপী এই আসন আমাদের কবিতায় ছড়িয়ে আছে। সাম্প্রদায়িক কূটজাল এড়িয়ে হৃদয়হরণ প্রিয় মানুষটির জন্মদিনের কথা আমাদের কবিতায় আলো ছড়িয়ে দিয়েছে। ধর্মান্তরণের বিতর্ক জিশুর শিষ্যদের ভাগে পড়তে পারে, কিন্তু মাত্র তেত্রিশ বছরের আয়ুষ্কালে তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় ঘটনা তাঁর মৃত্যু। ফলে তাঁর জন্মদিন পালনে ভক্ত-সহ সাধারণ মানুষ একটু যেন বেশিই মমতাময়।

জিশুর জন্মদিনের কথা এলে ‘কুমারী’ তাঁর মা, মেরির কথা আসে। রাকা দাশগুপ্তের কবিতায় দেখি, ‘কতবার বলেছি, ওইসব অক্ষয়কৌমার্য-টার্য বলে কিছু হয় না! কতবার বলেছি, শ্বেতকপোত বলে কিছু নেই আসলে! তারপরেও তুই কোন অলৌকিক গর্ভের আকাঙ্ক্ষায় মাথা কুটছিস অস্থানে কুস্থানে... দ্যাখ, তোর সমস্ত লৌকিক জন্মের সন্তানেরা, তোর রক্ত-ঘাম-কাদা মাখা অভুক্ত, ম্লান সন্তানেরা মেষপালকের পোশাকে নেমে এসেছে রাস্তায়। উঠে আয়, ওদের স্তন্যপান করা।’ (আভে মারিয়া, দস্তানা আর শীতের গল্প)। অগ্নি রায়ের কবিতায় আছে বড়দিনের পার্ক স্ট্রিট পদাবলি— ‘এই সময়ে ন্যাপথালিনের গন্ধ পুরনো উল-কে নতুন করে উস্কে দেয়। বছরের শেষে, শৈশব ফেরত পাওয়ার এই সকাল। সার্কাস আর চিড়িয়াখানার পর্যটনী দ্বন্দ্ব শীতের ছুটিকে যথেষ্ট তাপ দেয়। ঝরা পাতার সড়ক মাড়িয়ে, শিস দিতে দিতে যে যুবাটি এগিয়ে গেল, তার কথা অবশ্য স্বতন্ত্র। ওর পিছনে পড়ে রইল বিষণ্ণ পেরেক ও ক্রুশকাঠের বিকেল। সামনে গির্জা সঙ্গীত, কেক-গলির অলৌকিক গন্ধ, আর পার্লার ফেরত মোহিনী মেরি...’ (ক্রিসমাস)

‘বো ব্যারাক ফর এভার’

কলকাতার একেবারেই প্রাণকেন্দ্র চৌরঙ্গী এলাকার বো ব্যারাক ও তার বড়দিন অঞ্জন দত্তর সিনেমার পর থেকেই চর্চার ভিতর ঢুকে গেছে। পঁচিশে ডিসেম্বরে পার্ক স্ট্রিট-উৎসাহী দর্শকদের মধ্যে যাঁরা খানিক খবর রাখেন, আর যাঁরা হালের কন্টেন্ট ক্রিয়েটর, তাদের অন্যতম গন্তব্য এই বো ব্যারাক। শোনা যায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সৈনিকদের জন্য এই কয়েক সারি লাল রঙের বাড়ি তৈরি করেছিল ক্যালকাটা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট। পরবর্তী কালে ক্রমক্ষীয়মাণ অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের বসতি গড়ে ওঠে এখানে। বড়দিনের সময় এই অঞ্চল জিশুর জন্মদৃশ্য সজ্জায়, ওয়াইন, পুডিং, কেক-সহযোগে যেন এক টুকরো ‘হোম’ হয়ে ওঠে।

ভৌগোলিক অঞ্চলভেদে ধর্মের আচার ভিন্ন হয়। স্থানীয় খাবার পোশাক তার অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়, যেমন খ্রিস্টান অধ্যুষিত কেরল। কিন্তু কলকাতার ক্ষেত্রে এটি ব্যতিক্রম। ঔপনিবেশিক হ্যাংওভার তার যাওয়ার নয়। নিউ ইয়র্কের দুর্গাপুজোয় বাঙালির কিছু আপস-রফা থাকে, কিন্তু কলকাতার বড়দিনে সে নিয়মবদ্ধ। এক সময় ‘অথেন্টিক’ খাদ্য, নিখুঁত সাজসজ্জার জন্যে নিউ মার্কেট চষে ফেলত তারা, এখন অনলাইনে তা হাতের মুঠোয়। লেখাপত্র থেকে জানা যায়, বড়দিনের নানা আচারে পৌত্তলিক ধর্মের অনুষঙ্গ জড়িত। হৃদয়াকার আইভি-লতার পাতা মর্ত্যে জিশুর আগমনের প্রতীক, অ-খ্রিস্টান পৌত্তলিক ও ডাইনিদের হাত থেকে তা মানুষকে রক্ষা করে। এর কাঁটা ক্রুশবিদ্ধকরণের সময় পরিহিত জিশুর কণ্টকমুকুট এবং লাল বেরি ক্রুশে জিশুর রক্তপাতের প্রতীক। প্রাক-খ্রিস্টীয় যুগে, রোমান সাম্রাজ্যের অধিবাসীরা শীতকালে চিরহরিৎ বৃক্ষের শাখাপ্রশাখা বাড়ির ভিতরে এনে সাজাত। বড়দিনের বৃক্ষ ও চিরহরিৎ শাখাপ্রশাখার ব্যবহার দক্ষিণ অয়নান্তকে ঘিরে পৌত্তলিক প্রথাজাত, মনে করেন অনেকে। খ্রিস্টানরা এই জাতীয় প্রথাগুলিকে তাঁদের রীতিনীতির মধ্যে স্থান দেন। কোথাও কোথাও বিশুদ্ধতাবাদী খ্রিস্টানরা, প্রোটেস্টান্টরাও বড়দিন উৎসবকে বর্জন করতেন। তাঁরা বলতেন, বাইবেলে এমন তথ্যের কোনও প্রামাণ্য ভিত্তি নেই যে, ২৫ ডিসেম্বর জিশুখ্রিস্টের জন্মদিন। কিন্তু সাধারণ ভক্তের কাছে এগুলি তথ্যমাত্র। আমাদের এই বঙ্গে, ধর্মনির্বিশেষে জিশুখ্রিস্টের জন্মদিন পালন অন্তরের উৎসবে পরিণত হয়েছে। গির্জার উপচে পড়া ভিড়, কেকের দোকানে লাইন, আলোকমালায় সজ্জিত পথঘাট আর ক্যারল সঙ্গীতে তিনি চির জনপ্রিয়।

‘গন উইথ দ্য উইন্ড’

উত্তরের পাহাড়তলির মফস্সল শহরগুলিতে এক কালে হাড় কাঁপিয়ে শীত নামত। দু’-একটি বাড়িতেই তৈরি হত কেক। ল্যাম্পপোস্টে শালকাঠের খুঁটির উপর টিমটিমে আলোর চার পাশে তখন জমাট কুয়াশা। ঘরের ভিতর ছোট্ট উনুন জ্বালিয়ে ডবল মোজা পরে হাত সেঁকতে সেঁকতে সেই কেক খাওয়া হত। ২৪ ডিসেম্বর ছিল বার্ষিক পরীক্ষার ফল প্রকাশের দিন, ফলে পরের দিন বড়দিন পালনের উৎসাহ স্রেফ তলানিতে! তবে মাথার উপর দার্জিলিংয়ে বড়দিন চিরকাল রঙিন। গভীর বিশ্বাসের সঙ্গে জড়িত সে বড়দিন পালিত হত প্রধানত স্থানীয় মানুষজনের জন্য, পর্যটকের মন ভুলিয়ে রাজস্ব আদায়ের জন্যে নয়। দার্জিলিং, কার্শিয়াঙে আমজনতার জন্য লোহার ট্রাঙ্ক মাথায় চড়িয়ে, তার ভিতর পান-কেক (পান সদৃশ), বান, পাউরুটি, ক্রিম রোল বিক্রি হত। ওই জনপদ জুড়েই আছে বেশ কিছু প্রাচীন চার্চ ও চ্যাপেল। মল রোডের চড়াই-উতরাই ভেঙে ১৮৪৩ সালে তৈরি স্কটিশ সেন্ট অ্যান্ড্রুর নামে তৈরি গির্জায় পৌঁছে গেলেই জমজমাট পঁচিশে ডিসেম্বর। পাশেই সুবিখ্যাত ও সুপ্রাচীন লোরেটো স্কুল ও কলেজ। জলাপাহাড়ের মিলিটারি ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় ১৮৬৪ সালে স্থাপিত হয় সেন্ট পল’স স্কুলে। গ্লেনারিজ়-মত্ত পর্যটক বাঙালির চোখের আড়ালে এখানে এখনও অন্য রকম বড়দিন পালন হয়ে চলে। চাইলে দেখতে পাবেন, এখানকার স্কুলের ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক-শিক্ষিকারা সারা বছর ধরে চ্যাপেলে যা দান করেন, সেখান থেকেই বড়দিনের সময় দুঃস্থদের সাহায্য করা হচ্ছে। কল্পনা করা যেতেই পারে, এই চত্বরে জন্ম নেওয়া এবং শৈশবে লোরেটো কনভেন্টে পড়াশোনা করা এক বালিকা বড়দিনের ক্যারলে অংশগ্রহণ করছে। কৌতূহলী পাঠকের কাছে তিনি ভিভিয়ান লি। ‘গন উইথ দ্য উইন্ড’, ‘আ স্ট্রিটকার নেমড ডিজ়ায়ার’ তাঁকে হলিউডে অমরত্ব দিয়েছে।‌

‘তাই তোমার আনন্দ আমার পর/ তুমি তাই এসেছ নীচে।

আমায় নইলে ত্রিভুবনেশ্বর,/ তোমার প্রেম হত যে মিছে।’

রবীন্দ্রনাথ ‘খৃষ্টোৎসব’ প্রবন্ধ শুরু করেছেন গীতাঞ্জলির এই কবিতা বা একটি গান দিয়ে। তাঁর লেখায় জিশুখ্রিস্ট ও বড়দিন ঘুরে ফিরে এসেছে! ‘বড়দিন’ প্রবন্ধে লিখছেন, ‘আজ তাঁর জন্মদিন এ কথা বলব কি পঞ্জিকার তিথি মিলিয়ে?... বড়দিন নিজেকে পরীক্ষা করবার দিন, নিজেকে নম্র করবার দিন।’ শান্তিনিকেতন আশ্রমে ১৯১০-এ প্রথম তিনি বড়দিন পালন করেন। ২৫ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় শান্তিনিকেতনের কাচ মন্দিরে এই দিনটি পালিত হয়।

এই সব গুরুগম্ভীর আলোচনার বাইরে, চাইলে আপনি দেখতে পাবেন, এক দল তরুণী শান্তিনিকেতনের শ্রীসদন হস্টেল থেকে সাদা শাড়ি পরে, তার উপর একটি মাত্র চাদর জড়িয়ে হি-হি ঠান্ডায় উদ্যান বিভাগের পথ ধরে, শান্তিনিকেতন বাড়ি পেরিয়ে উপাসনাগৃহে ঢুকছে। সাঁঝ মন্দিরে শুরু হচ্ছে ‘সাইলেন্ট নাইট, হোলি নাইট, অল ইজ় কাম, অল ইজ় ব্রাইট’। পড়া চলছে বাইবেলের বাণী ও উপনিষদের অংশ। ধ্যান-প্রার্থনার পর জ্বলন্ত মোমবাতি নিয়ে ছাতিমতলায় একত্রিত হবে সবাই। বীরভূমের হাড়-কাঁপানো শীত ভেঙে সমবেত সঙ্গীতে গর্জন উঠছে, ‘এ যুগে তারাই জন্ম নিয়েছে আজি,/ মন্দিরে তারা এসেছে ভক্ত সাজি—/ ঘাতক সৈন্যে ডাকি/ ‘মারো মারো ওঠে হাঁকি’...। এই অপার্থিব বড়দিন পালনের অভিঘাত চিরদিন অন্তরে গেঁথে থাকবে তাদের।

আন্টা বাংলা ও ফিলোমিলা ডি সুজা

স্মৃতির ভিড়ে শীতের লেপ পেটানো তুলোর মতো কত যে বড়দিনের গল্প ভাসে! ফি-বছর মায়ের বড় হয়ে ওঠার জায়গা আর আমার মামার বাড়ি পূর্ণিয়া গেলেই শৈশবের আহ্লাদে পথে-ঘাটে সাহেবদের গল্প হেঁটে-চলে বেড়ায়। রাধানাথ শিকদার মাউন্ট এভারেস্টের উচ্চতা নির্ণয় করেন বাংলা-বিহারে মেশামেশি পূর্ণিয়া জেলা থেকেই। যাকে নবাব সিরাজউদ্দৌলার মাসতুতো ভাই শওকত জঙ্গের রাজধানী বলে জানে ইতিহাস, তাকে বিপুল খ্যাতি দিয়ে গেলেন সতীনাথ ভাদুড়ী। ভারতের পুরনো জেলাগুলির মধ্যে অন্যতম পূর্ণিয়া ১৭৭০ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি জেলা হিসেবে ঘোষিত হয়। লোরেটো সিস্টাররা ১৮৮২ সালে পূর্ণিয়ায় স্কুল খোলেন। তার পর থেকে মিশনারিরা এসে স্থানীয় সাঁওতালদের মধ্যেই ধর্মপ্রচারের চেষ্টা করেন এবং তাঁদের এই প্রয়াস দীর্ঘকাল ফলপ্রসূ থাকে।

রামবাগ এলাকায় সৌরা নদীর ধারে গড়ে উঠেছিল ইউরোপীয় সেটলমেন্ট। বর্তমানের পূর্ণিয়া শহর থেকে ওই রামবাগ পেরিয়ে যে রাস্তাটি চলে গেছে সিটি কালী বাড়ির দিকে, আমার শৈশবে তার দু’পাশে জলাভূমি আর শটি গাছের ঝোপঝাড়। তার ভিতরে বর্ষায় জলে হাঁটুডোবা এক গা ছমছমে পরিত্যক্ত ইউরোপীয় কবরখানা। আমরা দেখি আলেকজ়ান্ডার জন ফোর্বস, পূর্ণিয়ার আদি উপনিবেশিক জমিদার, যাঁর নামে পাশের ফরবেশগঞ্জ শহর, তিনি পূর্ণিয়ায় রেসকোর্স, নানা ক্লাব তৈরি করে শহর সাজাচ্ছেন। তিনি ও তাঁর স্ত্রী ডায়ানা ১৮৯০ সালে ম্যালেরিয়ায় মারা যান। এমন সব মশার কামড়ে মৃতদের ভিড়ে যে সমাধিস্থল, বড়দিনের আগে কারা এসে যেন তার চার পাশ সাফসুতরো করে রাখত।

রঙ্গভূমি ময়দানের চার পাশে এখন যা পূর্ণিয়া কলেজ, গার্লস স্কুল, সেগুলি ছিল নীলকর সাহেবদের বাড়ি। উৎসাহী দর্শক বড়দিনের অন্ধকারাচ্ছন্ন রাতের স্তিমিত আলোয় ওই ময়দানের এক ফাঁকা অংশে ধসে পড়া নীলকর সাহেবের বাড়ির সামনে দাঁড়াতে পারেন। হয়তো দেখবেন, বারান্দা থেকে খোলস ছাড়তে থাকা সাপ ধীরে ধীরে অনতিদূরের চার্চ চত্বরের প্রাচীন কবরের ফাটলে ঢুকে যাচ্ছে। একতলা ওই চার্চের ভিতর তখন আদিবাসী খ্রিস্টানদের বড়দিনের আয়োজন চলছে। প্রায় দেড়শো বছরের খ্রিস্টান ধর্মের উত্তরাধিকার বহন করে নিয়ে চলেছে তারা। জাত-ধর্ম-নির্বিশেষে সাধারণ বাড়ির ছেলেমেয়েরা খানিক কেকের লোভে, খানিক আলো-ঝলমল উৎসবের আনন্দে মেতে উঠেছে প্রাচীন সেই গির্জার অভ্যন্তরে। চার্চের পিছনের চৌহদ্দিতে মাটির সঙ্গে প্রায় মিশে গেছে তৎকালীন ইউরোপীয় সোরা ব্যবসায়ীদের কবরগুলি। ১৭৫৭-র পর থেকে এই বিহার অঞ্চল থেকেই সর্বোৎকৃষ্ট ও সর্বোচ্চ সালফেট বা পটাসিয়াম নাইট্রেট সংগ্রহ করে ইংল্যান্ডে পাঠাত তারা। যা তাদের পৃথিবীব্যাপী ঔপনিবেশিক শাসনে দীর্ঘকাল ধরে বারুদের আগুন জুগিয়ে গিয়েছিল। সতীনাথের লেখায় রাম ও গানহি বাবা, মহাত্মা গান্ধীর সর্বব্যাপী প্রভাবের বাইরেও ছিল স্থানীয় আদিবাসী সাঁওতাল সমাজের পরমপিতা জিশু। তাঁর ‘আন্টা বাংলা’য় বা ইংরেজদের প্ল্যান্টার্স ক্লাবে বড়দিনের উৎসবে ব্রাত্য থাকবে যে সব গভীর শ্যাম নারী ও পুরুষ, তারাই জিশুর বাণী পতাকার মতো ধরে থাকবে স্বাধীন ভারতবর্ষে।

আপনি এই ভ্রমণপথে চলে যেতে পারেন অধুনা অস্থির বাংলাদেশের বরিশালে। দেখতে পাবেন এক খ্রিস্টান পাড়া, মাঝখানে এক চৌকো দিঘি ঘিরে চার পাশে তাদের বসতি। পোশাকে-আশাকে সত্তর-আশির দশকের ঘর চলতি ফ্রি-স্কুল স্ট্রিট মনে পড়ে যাবে। কৌতূহলী মনে প্রশ্ন করলে জানতে পারবেন, এদের অনেকের বাড়ি পাদ্রী শিবপুরে। ভেসেলের উপর গাড়ি চাপিয়ে আবার নেমে এ-নদী ও-নদী পেরিয়ে পৌঁছে যাবেন পর্তুগিজ জমিদারের শিবপুর গ্রামে। কথিত আছে, সপ্তদশ খ্রিস্টাব্দের গোড়ার দিকে বাংলাদেশের বারো ভুঁইয়ার অন্যতম রাজা রাজবল্লভ সেন এতদঞ্চলের জমিদার ছিলেন। এই অঞ্চলের প্রজারা দুর্ধর্ষ হওয়ায় জমিদার প্রজাদের থেকে খাজনা আদায়ে সক্ষম হচ্ছিলেন না। ফলে তিনি ব্যান্ডেল থেকে কয়েক জন পর্তুগিজ বণিক চেয়ে পাঠালেন। জমিদারের অনুরোধে ব্যান্ডেল থেকে চার জন পর্তুগিজ বণিক তাদের বন্ধুক-সহ এখানে আসেন আর অবশ্যই পিছনে বাইবেল হাতে মিশনারিরা। জমিদার এখানে বসবাসের জন্যে তাদের একটি তালুক প্রদান করেন। তারা জমিদারের পক্ষে কর আদায় করে জমিদারকে দিত। জায়গার নাম শৈবে, খ্রিস্টে মিলেমিশে হল পাদ্রী শিবপুর।

বাংলাদেশের কবি হেনরি স্বপনের সঙ্গে তার শ্বশুরঘর বাঙালি ক্যাথলিকের যে বাড়িতে আপনি প্রবেশ করবেন, মনে হবে যেন গোয়া এসে খানিকটা বাঙালিয়ানা মেখে নিয়েছে। খুব সাদামাটা চেহারার এক মহিলা এসে আপনাকে বাড়িতে বানানো ওয়াইন দিয়ে স্বাগত জানাবে। বাইরে পথের ধারে ধান ঝাড়ছে যে গায়ে ছিন্ন শাড়ি জড়ানো, নাম সই করতে না-পারা বৃদ্ধা; নাম জিজ্ঞেস করলে তার ধূসর লাজুক চোখ তুলে জানাবে, ফিলোমিলা ডিসুজ়া! এই ধানের গুঁড়ো দিয়ে এক রকম পিঠে হবে, করুণাময় জিশুকে অর্পণ করবেন বড়দিনে। কে মনে রাখবে তার পর্তুগিজ পূর্বপুরুষদের অথবা মূর্তিপূজক পূর্বনারীকে? জিশুর জন্মস্থান, জন্ম পরিচয়, জাত-বেজাত, এ সব নিয়ে এমন ভক্তদের কোনও মাথাব্যথাই নেই। পাদ্রী শিবপুরের বিরাট ও সুদৃশ্য চার্চকে ঘিরে হয়তো এ বারেও ক্যাথলিকদের বড়দিন পালিত হবে, তবে আনন্দের রং বোধহয় ততখানি উজ্জ্বল থাকবে না।

উত্তরে যারা মৌন

জলপাইগুড়ির সবচেয়ে পুরনো চার্চ প্রোটেস্টান্টদের ‘সেন্ট মাইকেল অ্যান্ড অল অ্যাঞ্জেলস’ চার্চ । জলপাইগুড়ির তদানীন্তন ইংরেজ চা-বণিকদের চা বাগানের গোড়াপত্তন এই চার্চের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে। জৌলুসহীন হলেও এখনও নিজের মতো করে বড়দিনে সেজে ওঠে এই চার্চ। জলপাইগুড়ি জেলাশাসকের অফিসের সামনে থাকা এই চার্চটি ১৮৬৮ সালে ইউরোপিয়ান চা-কর সাহেবরা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পুরোনো শাল কাঠ, চুন ও সুরকির এই চার্চে বেলজিয়ান কাচের জানলা আজও অক্ষত। ১৮৭৭ সালে ৫ ফেব্রুয়ারিতে প্রয়াত চা-কর ওয়াল্টার আলেকজ়ান্ডার জন টমসনের স্ত্রী, শার্লি টমসন হয়তো শেষ বড়দিন এই চার্চেই পালন করেছেন। তাঁর সমাধি ও স্মৃতিসৌধ আরও অনেকের মতোই রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে আজ স্মৃতিধূসর। বড়দিনের উৎসবে অবহেলার অভিমানে মাখা এই চার্চ-চত্বরে এলে হয়তো তার শিয়রে অধিষ্ঠিত সুপ্রাচীন ঘণ্টার ধ্বনি শুনতে পাবেন। কলেরায় মৃত একুশ বছরের তরুণ জেমসের স্মৃতিফলক খুঁজেও পেতে পারেন, শোনা যায় এই চার্চটি প্রতিষ্ঠায় তাঁর যথেষ্ট অবদান ছিল।

কোচবিহারে ১৮৯৮ সালে স্থাপিত বাবুরহাট চার্চটির অবশ্য ভাগ্য ভাল। এয়ারপোর্ট সংলগ্ন এলাকায় এই চার্চের পাশে আছে দৃষ্টিহীনদের বিদ্যালয় ও ছাত্রাবাস। এলাকায় চার্চটির জনপ্রিয়তা তাকে দৃষ্টিনন্দন করে রেখেছে। বড়দিনের অনেক আগে থেকেই বিদ্যালয় ছাত্রাবাস, চার্চ প্রাঙ্গণ সুসজ্জিত করা হয়। উত্তরের পথে পথে স্যান্টা ক্লস তাঁর ঝুলি উপুড় করে আনন্দ ছড়িয়ে দিয়ে যান। এই সময়টি দরিদ্র কোনও স্যান্টা ক্লস বেশধারী মানুষেরও, যে চার্চ-চত্বর থেকে সর্বত্র গজিয়ে ওঠা শপিং মলে সন্তের পোশাকে আবির্ভূত হয়ে উপার্জন করতে পারে। ঝলমলে পবিত্র রাতে এমন কোনও যুবক বা প্রৌঢ়ের সঙ্গে আপনার আলাপ হয়েও যেতে পারে।

তপনমোহন, জন ও স্মৃতিরঙ্গ

শেষে চলে যেতে পারি এক চিত্তাকর্ষক গল্পে।। তপনমোহন চট্টোপাধ্যায়ের মাতামহ দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর। সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ তাঁর দাদামশাই। ১৯২০ সালের জুন মাস। ছাত্রাবস্থায় তখন তিনি লন্ডনে। এক রাতে লেখাপড়া সাঙ্গ করে নীচে রাস্তায় নেমেছেন। কাছেই জন বলে এক জনের ভ্রাম্যমাণ কফি স্টলে যাবেন মনস্থ করেছেন। আগেই পিয়ারসনের কাছে খবর পেয়েছেন, তাঁর বাড়ির উল্টো দিকে রবীন্দ্রনাথ এসে উঠেছেন। তিনি নামতেই রবীন্দ্রনাথ ট্যাক্সি থেকে এসে নামলেন। জোব্বার পকেট হাতড়ে পয়সাকড়ি খুঁজে পেলেন না। অন্যমনস্ক কবির এমনই নাকি ছিল স্বভাব! স্বভাবতই তপনমোহন সেই টাকা মিটিয়ে দিলেন। হাতের কাছে যখন রবীন্দ্রনাথকে পাওয়া গিয়েছে, তাঁকে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে জনকে খানিকটা মুগ্ধ করবেন, এমনটাই ইচ্ছা। রবীন্দ্রনাথ রাজিও হয়ে গেলেন। রবীন্দ্রনাথ পিছনে আসছেন, তপনমোহন জনকে বুঝিয়ে বলার জন্য খানিক দূর এগিয়ে গেছেন। হঠাৎ দেখেন, “জন একেবারে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে। তার চাউনি অনুসরণ করে দেখি, দূরে গুরুদেবেরই উপর তার দৃষ্টি নিবদ্ধ। গুরুদেব তখন মাথার মখমলের লম্বা টুপিটা খুলে ফেলেছেন। সামনের বড়ো-বড়ো বাড়িগুলোর মাথার উপর দিয়ে পানসে-গোছের একফালি চাঁদ বেরিয়ে এসেছে। তারই মৃদু আলো একটুখানি গুরুদেবের ঠিক মুখের উপর এসে পড়েছে। দেখতে-দেখতে জন হাঁটু গেড়ে মাটিতে নিলডাউন হয়ে বসলো। তার দু-খানা হাত একত্র জোড়করা।”

তাড়াহুড়োয় রবীন্দ্রনাথের সে দিন আর জনের স্টল অবধি আসা হয়নি। তপনমোহন তাঁকে হোটেলে পৌঁছে দিয়েছিলেন। পৌঁছে দিয়েই, আবার জন-এর স্টলে ফিরে গেলেন। তাঁকে দেখে জন বললে, ‘চ্যাটার্জি, আমার জীবন ধন্য। করুণাময় লর্ড যীসস্ ক্রাইস্ট দূর থেকে আজ আমাকে দর্শন দিয়ে গেছেন। আমার জীবন সার্থক।’ তপনমোহন দেখলেন, ‘জন-এর মুখে অপার শান্তি!’

অন্য বিষয়গুলি:

Christmas 2024 Jesus christ christmas Xmas
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy