রবীন্দ্রনাথ ১৯৩৩ সালে গল্পগুচ্ছের ‘একটি আষাঢ়ে গল্প’ অবলম্বনে ‘তাসের দেশ’ নাটিকা রচনা করেন। ক্ষণিকা কাব্যগ্রন্থের ‘বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মী’ কবিতার অংশবিশেষ অবলম্বনে রাজপুত্রের তিনটি গান রচিত হয়। ‘তাসের দেশ’ একটি রূপক— সাঙ্কেতিক নাটক। নতুন যৌবনের দূত রাজপুত্র এবং সদাগরপুত্র অচলায়তন এক নতুন দেশে কেমন করে নিয়মের বেড়া ভেঙে শুকনো গাঙে জীবনের বন্যা বইয়ে দিলেন, সেই গল্পই বলা হয়েছে এই নাটকে। যৌবনের দূত নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুকে বইটি উৎসর্গ করে কবি লিখেছিলেন— “স্বদেশের চিত্তে নূতন প্রাণসঞ্চার করবার পুণ্যব্রত তুমি গ্রহণ করেছ, সেই কথা স্মরণ করে তোমার নামে ‘তাসের দেশ’ নাটিকা উৎসর্গ করলুম।”
ভারতীয় বিদ্যা ভবনের উদ্যোগে ‘দীক্ষামঞ্জরী’ ও ইংল্যান্ডের ‘দক্ষিণায়ন’-এর যৌথ প্রচেষ্টায় নেতাজির জন্মদিনের প্রাক্কালে ২২ জানুয়ারি রবীন্দ্রসদনে ‘তাসের দেশ’ নাটিকার মঞ্চায়ন সে দিক থেকে তাৎপর্যপূর্ণ। আজকাল এই নাটিকার মঞ্চায়ন বিশেষ দেখা যায় না। অথচ নাটকের বিষয়বস্তু আজও খুবই প্রাসঙ্গিক। তাই উদ্যোক্তাদের ধন্যবাদ জানাই। নাটিকাটি রবীন্দ্র নৃত্যনাট্যের অনুসরণে উপস্থাপনা করায় কিঞ্চিৎ রসভঙ্গ ঘটেছে। বিশেষ করে নাটকের তির্যক সংলাপগুলি অনেক ক্ষেত্রে গুরুত্ব হারিয়েছে। গানের উপস্থাপনা মোটামুটি ভাল হলেও, তুলনায় নাটিকার সংলাপের উপস্থাপনা দুর্বল। প্রসঙ্গত উল্লেখ করি, প্রথম মঞ্চস্থ করার সময়ে একই সঙ্কট উপস্থিত হয়েছিল— “তাসের দেশের চিড়েতনী, হরতনী, রানী ও রাজকুমারদের গানের সঙ্গে নাচ থাকবে, স্থির হওয়ায় নৃত্যপারদর্শিনী মেয়েদেরই কেবল নির্বাচন করা হয়েছিল। অন্যান্য চরিত্রগুলির মধ্যে রাজমাতা এবং ছক্কা, পাঞ্জা, দুরি, তিরির গান ছিল, কিন্তু ওই চরিত্রগুলিতে যাঁদের নির্বাচন করা হয়েছিল, তাঁরা নাচ জানতেন না। তাঁদের বলা হয়েছিল গানের ছন্দে স্বাভাবিক ভাবে চলে ফিরে, হাত নেড়ে অভিনয় করতে। রাজপুত্রকে অধিকাংশ গানের সঙ্গে নৃত্যভঙ্গিতে অভিনয় করতে হয়েছিল গানের দলের সঙ্গে। কেবল তিনটি গান রাজপুত্র (শান্তিদেব ঘোষ) নিজে গেয়ে অভিনয় করেছিলেন।”
সে দিন রবীন্দ্রসদনে গান ও অভিনয়ে ছিলেন আনন্দ গুপ্ত (রাজপুত্র ও তাসের রাজার চরিত্রে সংলাপ ও গান), ঋদ্ধি চক্রবর্তী (পত্রলেখার গান), সোমা বন্দ্যোপাধ্যায় (রানীমায়ের সংলাপ), সৌগত শঙ্খবণিক (সদাগর, ছক্কা, পাঞ্জা, গোলামের চরিত্রে গান ও সংলাপ), ঝিনুক বসু (হরতনীর গান ও সংলাপ), অর্ণবনীল মুখোপাধ্যায় (রুইতনের সংলাপ), শ্রীরাধা গুপ্ত ও নীলাঞ্জনা চৌধুরী ( টেক্কানী ও দহলানীর গান), মালা দাস ( টেক্কানীর সংলাপ), মৌমিতা চক্রবর্তী (দহলানীর সংলাপ), শ্রীরাধা গুপ্ত (ইস্কাবনীর সংলাপ), দেবস্মিতা দাস ও মাধবী পাল (সমবেত গান)। নৃত্যে ডোনা গঙ্গোপাধ্যায় (রাজপুত্র), রঘুনাথ দাস (সদাগরপুত্র), সুতন্বী মিশ্র (রুইতন), রাগেশ্রী সোম (হরতনী), সুস্মিতা দাস (পাঞ্জা), অন্বেষা সরকার (ছক্কা), বহ্নিশিখা দাস (ইস্কাবনী), অনন্যা জানা ( টেক্কানী), প্রচেতা সাহা (দহলানী), শ্রীজা পোদ্দার (রাজা), ফারহিন ইসলাম (রানী), পলাশ দাস (ইস্কাবনের গোলাম)। যন্ত্রানুষঙ্গ ছিল নাটিকার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। শিল্পী ছিলেন বিপ্লব মণ্ডল (তবলা), সুব্রত মুখোপাধ্যায় (কিবোর্ড), সৌম্যজ্যোতি ঘোষ (বাঁশি), সুখময় ভট্টাচার্য ( সেতার), কিংশুক দাস (পারকাশন)। রাজপুত্র ও সদাগরপুত্রের নাচ মনোগ্রাহী। রুইতন ও হরতনীর নৃত্যাভিনয় মন্দ নয়। দীক্ষামঞ্জরীর ছাত্রছাত্রীদের নৃত্যাভিনয় মোটামুটি। রাজসভা ও শেষ দৃশ্যের নৃত্যনির্মাণ দুর্বল। স্টেজ জুড়ে এত বেশি তাসবংশীয়দের উপস্থিতি কোরিয়োগ্রাফিকে বিঘ্নিত করেছে। পিছনে রাজারানী ও দহলা পণ্ডিতকে তো দেখাই গেল না৷ ‘তাসের দেশ’-এর পোশাক ও সাজসজ্জা সম্পর্কে শান্তিদেব ঘোষ লিখেছেন—“শিল্পাচার্য নন্দলালের পরিকল্পনা ছিল অভূতপূর্ব। ...তাঁর পরিকল্পিত সাজের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল রঙের ছন্দসাম্য। পিসবোর্ডের ওপর সাঁটা নানা রঙের কাগজ ও কাপড়ের আলপনায় যেসব পোশাক রচনা করেছিলেন, সেগুলি ছিল প্রত্যেকটি চরিত্রের অনুকূলে অলংকার বিশেষ। নানাপ্রকার রঙিন কাপড়ের সমন্বয়ে রচিত জামাকাপড়ের সঙ্গে মিলে তা প্রত্যেক অভিনেতাকে একটি সার্থক শিল্পরূপে পরিণত করেছিল। ...এই সব সাজসজ্জা নতুন ধরনের হলেও দেখে মনে হত যেন এই নাটকের চরিত্রে এ সাজ ছাড়া আর কোন সাজই মানায় না। এদিক থেকে তাসের দেশের সাজসজ্জাকে বলা চলে শিল্পাচার্যের আর এক মহৎ সৃষ্টি।” নাটিকাটিকে ভবিষ্যতে মঞ্চস্থ করার আগে সাজসজ্জা রচনাকারকে শিল্পাচার্য নন্দলাল বসু পরিকল্পিত সাজসজ্জার ছবিগুলি দেখে নিতে অনুরোধ করি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy