চতুর্ভুজ: শিল্পী তন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘সিদ্ধিদাতা’ প্রদর্শনীর কাজ
শিল্পে কল্পনার দেবতাও বিষয় হিসেবে অনেকখানি জায়গা অধিকার করে নেন। পুজো-অর্চনার চেয়েও এই দেবতা সারা ভারতে বিশেষত শিল্পী-ভাস্করদের কাছে অসাধারণ এক বিষয়বস্তু। গত একশো বছরের শিল্প-ইতিহাসে এই চরিত্রটি নিয়ে যত কাজ হয়েছে, তা অন্য কিছু নিয়ে হয়নি।
মূর্তিতত্ত্বের প্রাচীন ইতিহাস থেকে অজস্র গ্রন্থে বিভিন্ন রূপে তাঁর ছবির মুদ্রণ-সহ চিত্রভাস্কর্যের নির্মাণ ও প্রদর্শনী সারা ভারত জুড়েই হয়েছে, হয়ে চলেছে এবং আরও অসংখ্যবার হবে।বাঙালি-অবাঙালি নির্বিশেষে এই কাল্পনিক দেবতাকে অতি সহজে শুধু গ্রহণই করেননি, ব্যবসা বা শিল্পসংগ্রহ হিসেবে তাকে ঘরে রাখার সঙ্গেই শুভফল ও মঙ্গলের প্রতীক হিসেবেও চাহিদাময় করে তুলেছেন। শিল্পের ক্ষেত্রে তার নধর হৃষ্টপুষ্ট অবয়বটিই শিল্পীদের কাছে আকর্ষক বিষয়। বিশাল উদর, গোলগাল পৃথুল হাত-পা ও বিরাট শুঁড়-সমন্বিত এক মস্তক ঘিরে বৃহৎ দুটি কান—ছবিতে, ভাস্কর্যে কত রকম পরীক্ষায় যে উৎসস্বরূপ, তার কোনও ইয়ত্তা নেই।
সেই সিদ্ধিদাতাকে নিয়েই এক প্রদর্শনীর আয়োজন করেন দেবভাষা কর্তৃপক্ষ। তরুণ ভাস্কর তন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘সিদ্ধিদাতা’ বিষয়ক ব্রোঞ্জ ভাস্কর্যের সেই প্রদর্শনীটি শেষ হল সম্প্রতি।
তন্ময় সরকারি আর্ট কলেজের ভাস্কর্য বিভাগের অধ্যাপক। চিত্রকলা, ড্রয়িং ও ভাস্কর্যে সিদ্ধহস্ত এই শিল্পীর প্রখর বোধচেতনার নিবিড় আলেখ্যটি অনুধাবন করলে তাঁর অতুলনীয় সব কীর্তি চোখে পড়বে। প্রদর্শনীতে মোট বারোটি ভাস্কর্য ছিল— চারটি রিলিফ ভাস্কর্য-সহ। কর্তৃপক্ষের উদ্দেশ্য ছিল খুব
ছোট ব্রোঞ্জের ভাস্কর্য, যা মানুষের কাছে আকর্ষক হবে, বিশেষত অত্যল্প অর্থে যাতে তাঁরা তা সংগ্রহ করতে পারেন। তন্ময় সে ভাবেই নির্মাণ করেছিলেন ভাস্কর্যগুলি। ছোট ভাস্কর্য বলতে ৪-৫ ইঞ্চির ভিতরে সীমাবদ্ধ ছিল আটটি কাজ। বাকি চারটি রিলিফ ভাস্কর্য দৈর্ঘ্য-প্রস্থে ৮-১০ ইঞ্চির কাছাকাছি। এত ক্ষুদ্র ভাস্কর্য, ১২টি মাত্র কাজ, তা সত্ত্বেও একটি বৃহৎ প্রদর্শনীর অনুভূতি থেকে কোনও অংশে কম নয়।
কারণ আকার বা মাপই চিত্র-ভাস্কর্যের মূল কথা নয়। বরং কতটা মুগ্ধতা ও সংবেদন তাতে জড়িয়ে রয়েছে বা কতখানি শিল্পগুণে তারা আচ্ছন্ন, সেই স্টাইলাইজ়েশন, কম্পোজ়িশনের টেকনিক, বিভিন্ন মাধ্যমকে ব্যবহার করার দক্ষতা ইত্যাদি নানা কারণেই দর্শকের কাছে তাদের গুণাগুণ নিরূপিত হয়। বর্তমান প্রদর্শনীর কাজগুলিতে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই সেই গুণ উপস্থিত।
লোকশিল্প কারিগরদের মৃত্তিকার রঙিন দেবদেবী অথবা টেরাকোটা-সংবলিত মূর্তির একটি বাজার বা চাহিদা আছে—তার অদ্ভুত লৌকিক পুত্তলিকা-সদৃশ ফর্মেশনের জন্য। ডিটেল অত্যন্ত কম, ছাঁচ ও ছাঁচহীন এক মধ্যবর্তী পন্থা। তন্ময় এখানে ওই সরল লৌকিক আবহকে সঙ্গী করে, পৌত্তলিকতাকে মাথায় রেখেও নিজস্ব আঙ্গিকে এক অসামান্য ফর্মেশনে গড়েছেন ছোট ভাস্কর্যগুলি।
বিশেষত চার হাত, শুঁড়, ভাঁজ করা দু’টি পা ও কান— এ সব ক্ষেত্রে রূপারোপের যে শৈল্পিক পরীক্ষা করেছেন, সমুন্নতি গুণ পুরো অক্ষুণ্ণ রেখেও সিদ্ধিদাতার প্রতিটি ব্রোঞ্জ ভাস্কর্য যেন লোকশিল্প ও প্রত্নভাস্কর্যের এক ধরনের আধা ভঙ্গুর মূর্তিতত্ত্বের স্মৃতিকে ফিরিয়ে দেয়। এই সঙ্গেই উল্লেখ করা প্রয়োজন, এমন ভিন্নমুখী পাতিনার ব্যবহার ব্রোঞ্জ ভাস্কর্যে সচরাচর দেখা যায় না।
সামগ্রিক দর্শনের মধ্যে কোথাও কোনও মোনোটোনির অবকাশ নেই। বসা গণেশের দু’পায়ের ভাঁজ সে অর্থে বিলীন, কিন্তু আদল স্পষ্ট। কোনও গজানন বৃহৎকর্ণ ও মস্তক ঈষৎ হেলিয়ে, লম্বা শুঁড় দিয়ে হাঁটু স্পর্শ করছে। কোথাও প্রায় মেঝে স্পর্শ করা শুঁড় অল্প বেঁকিয়ে গজপতি নিশ্চুপ চেয়ে আছে সামনে। আবার কখনও বা মাত্র দুই হাত— জগন্নাথের মতো স্বল্প, কিন্তু দু’দিকে তার বিস্তার। চকচকে হরিদ্রাভ জোড়া-গণেশ দারুণ নাদুসনুদুস, বর্তুলাকার। কোথাও বা আঙুলের চাপে রূপারোপের আদল বদলে দিয়েছেন।
তবে তাঁর চারটি রিলিফ ভাস্কর্য হঠাৎ যেন প্রত্নভাস্কর্যের পাথরপ্রতিম প্রাচীনত্বের বিভ্রম জাগায়। ব্রোঞ্জে ঠিক এমন পাতিনার ব্যবহার সাধারণ নয়। এই কাজগুলিতে অনেক বেশি ডিটেল এবং যেন অনুপুঙ্খময় সূক্ষ্ম মূর্তিতত্ত্বের দেওয়াল থেকে উঠে আসা প্রাচীন মন্দিরগাত্রের অংশবিশেষ। অলংকার ও ফর্মেশনের সামগ্রিক অবস্থানের প্রতিটি স্থানেই ধরে ধরে সূক্ষ্মতা এনেছেন। যেন হুবহু প্রাচীন যুগের স্মৃতিচিহ্নবাহী কিছু ক্ষয়িষ্ণু মূর্তির নস্টালজিয়ায় ভরা, বড় বেশি মায়াময় এই কাজগুলি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy