এই একুশ শতকের বিশের দশকের প্রেমের কাহিনিতে বারবার ভিলেন হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে কেরিয়ার। তার হিরে-জহরত, রাজ্যের চাকচিক্য, সম্মান-স্বাচ্ছন্দ্যের লোভে বিস্তর পরিশ্রম করে যেই না চাকরির কাছাকাছি যাওয়া, অমনি টেনে-হিঁচড়ে আলাদা হয়ে যাচ্ছে আজকের হিরো-হিরোইন। ‘জব’সাহেবের হুকুমে আজকাল জুলিয়েট হলদিয়ায় ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে আর রোমিয়ো হনলুলুতে আগ্নেয়গিরি নিয়ে রিসার্চ করছে। ‘ভাগ্য’ কিঞ্চিৎ মায়া দেখালে, মজনু বড়জোর বেঙ্গালুরুতে আইটি-র চাকুরে আর লায়লা বেহালায় টিভি সিরিয়ালের শ্যুটিংয়ে ভীষণই ব্যস্ত।
তা দূরত্ব কম হোক বা বেশি, লং ডিসট্যান্স রিলেশনশিপে বড্ড কষ্ট। ত্রিভুবনে একজনও নেই যে খুশিতে ডগমগ হয়ে বলবে, ‘এই তো আমার বর অস্ট্রেলিয়ায় জব করে, আর আমি সৌদামিনী কলেজে বাংলা পড়াই। আর আমরা বিরাট সুখী। ইয়েপ্পি!’ তার আত্মকথা হল, ‘যখন অবরেসবরে অন্য কাপ্লরা হাত ধরে ঘোরে, দোল-পুজো-দেওয়ালিতে রংবাজি, প্যান্ডেল হপিংয়ে সুখের সাগরে ভাসে, বিশেষ দিনে একসঙ্গে ছুরি ধরে কেক কাটে, তখন অদৃশ্য এক ছুরি অল্প অল্প করে চোকলা তুলে নেয় আমার এই হৃদয়টার...’
তবুও তো সে অনেক ভাল। একই বিছানায় পাশাপাশি উলটোমুখী হয়ে শুয়ে, মনের অনেক অনেক ভিতরের ঘুপচিতে ‘তারারাও যত আলোকবর্ষ দূরে, তারও দূরে তুমি আর আমি যাই ক্রমে সরে সরে’ পারফর্ম করার থেকে, এই কয়েকশো বা কয়েক হাজার মাইলের বাধা টপকানো জলের মতো সোজা। কারণ ফেসবুক, স্কাইপের এই মুঠোফোনে বন্দি দুনিয়ায় আপনি চাইলে, বিরহ বলে আসলে কিচ্ছুটি নেই। তবে হ্যাঁ, এমন কলকাতা-ক্যালিফোর্নিয়ার বিশ্বজোড়া সংসার পাতলে সেই সম্পর্কের জন্য খাটনিটাও বেশি লাগবে বইকী। তাই এ সব সম্পর্কে মনোযোগ, বিশ্বাস, আস্থা, শ্রদ্ধা, যত্ন, সংযম, সময় সবই লাগে স্বাভাবিকের চেয়ে নিদেনপক্ষে দ্বিগুণ। অন্য জনের একাকিত্ব, যন্ত্রণা, হতাশা, অনিশ্চয়তা, নিরাপত্তাহীনতা সব কিছু তাড়াবার গুরু দায়িত্বটাও তুলে নিতে হয় কাঁধে।
কী ভাবে? রুটিন মেনে ভিডিয়ো কলিং-চ্যাটিং, ফোনের সময় না পেলে একটা টুকরো মেসেজ, দাগা দিনগুলোয় সারপ্রাইজ গিফট কুরিয়ার, আর এটা-সেটা খরচ কমিয়ে আগেভাগে ট্রেন বা প্লেনের টিকিট কেটে ছুটিছাটায় ঘন ঘন চলে আসুন বা দোঁহে মিলে ভেকেশনে যান এবং নিজেকে ভালবাসুন। নানা সাজে নানা ভঙ্গিমায় ছবি বা ভিডিয়ো তুলে মাঝেমাঝে পাঠিয়ে দিন সঙ্গীকে। এ ভাবে বারবার প্রেমে পড়তে বাধ্য করুন ওকে। এক কানে ফোন ধরে একই সিনেমা চালিয়ে চলুক গপ্পো, হাসাহাসি, খুনসুটি। মনেই হবে না আপনাদের মাঝে সাত সমুদ্দুর তেরো নদী বইছে। এই তো সোফায় ঘেঁষাঘেঁষি বসে বাটি ভর্তি চিপস নিয়ে সিনেমা দেখছেন। হল তো জিয়োগ্রাফি লাভোলজি-র কাছে হেরে ভূত? এবং সার কথা— নিজের তাগিদেই ঘটে চলবে এ সমস্ত। যন্ত্রের মতো নয়, দিওয়ানা-র মতো।
তবে সময়ের ব্যবধানকে অস্বীকার করার উপায় নেই। এক গোলার্ধ থেকে অন্য গোলার্ধ পর্যন্ত সেতু বানানোর মূল উপকরণ তাই অনেকখানি অ্যাডজাস্টমেন্ট। এখানে যখন গোধূলির আলো, ওখানে হয়তো শেষ রাত্তির। তাই এক শহরে থাকলে, যতই কাজের চাপ থাকুক, রাত এগারোটায় ফিরেও হয়তো ওকে দেখে শান্তি পেতেন, সেটি এ অবস্থায় ঘটবার জো নেই। তাই ভার্চুয়াল দেখা করার সময় বের করতে দু’জনের পক্ষে সম্ভব বা জোর করে সম্ভব এমন একটা সময় চুরি করে নিতেই হবে। হয় কাজে যাওয়ার আগে আধ ঘণ্টা অথবা ভোর রাতে অ্যালার্ম দিয়ে উঠে ঘণ্টাখানেক। কিছু দিন আপনি কষ্ট করুন, কিছু দিন ও। পালা করে ভাগ করে নিন যন্ত্রণা। তারই মধ্যে তো লুকিয়ে জীবন ভাগ করার আনন্দ।
দেখা করা, একসঙ্গে সময় কাটানো, অনর্গল বকমবকম— ইন্টারনেট, আর সস্তার আইএসডি কার্ডের সৌ়জন্যে, লং ডিসট্যান্সেও আজ পাশের বাড়ির প্রেমের সব আঁচটুকুই সহজলভ্য। মোক্ষম কাঁটা একটিই এবং তা বিঁধেছে মূল মর্মস্থলে। টাচে থাকা যাবে, কিন্তু ‘টাচ’ পাওয়া যাবে না। প্রেম কি কামের ঊর্ধ্বে পৌঁছতে পারবে?
ও সব দর্শনে মাথা না ঘামিয়ে আপাতত শরীরী চাহিদাকে গুরুত্ব দিন। মনের কাছাকাছি থাকতে সফল শারীরিক সম্পর্কের ভূমিকা যথেষ্ট। গভীর রাতের ব্যক্তিগত ফোনালাপে একটু চেষ্টা করেই দেখুন না... কথোপকথনে নাটক মেশান, উপুড় করে দিন সৃজনশীলতা। এতে বার বার সশরীরে হাজির হওয়ার তেষ্টা আর চেষ্টা দুই-ই বেড়ে যাবে।
বিশেষজ্ঞরাও তো তেমনটাই বলছেন যে, লং ডিসট্যান্স রিলেশনশিপ মানেই তার ভবিষ্যৎ নিষ্ফলা নয়।
ইন্টারনেটের যুগে ‘চোখের আড়াল, মনের আড়াল’ তত্ত্বটিও আর তেমন খাটে না। বরং, বড় বেশিই যোগাযোগ হয় এই জমানায়। ফলে, ‘একটু দূরত্বে টান বাড়ে বেশি’, এই ফর্মুলার সফল হওয়ার সম্ভাবনাই বাড়ছে। গায়ে গায়ে লেপ্টে থাকলে অনেক সময়ই কিন্তু সম্পর্কে একঘেয়েমি চলে আসে। মাঝেসাঝে কাছাকাছি এলেই বরং মিলনে প্যাশনের বিস্ফোরণ। তবু এক শহরে থাকার বদলে আলাদা আলাদা থাকলে সে সম্পর্কে ঝুঁকিও বেশি। তার সরাসরি কারণ, তৃতীয় ব্যক্তির অনুপ্রবেশ নয়। সেই বিশ্বাসঘাতকতারও পিছনে একটি মোদ্দা কারণ বর্তমান।
সমীক্ষা দেখাচ্ছে, এ সব রিলেশনশিপের অ্যাসিড টেস্ট হল প্রথম দুটি বছর।
কারণ, সম্পর্ক কখনওই এক জায়গায় থেমে থাকে না। হয় তা এগোবে, নয়তো ডান দিক বা বাঁ দিকে হাঁটবে। এ বার ঠিক কোনটা হবে, দু’জনের কাছেই সেটা ‘অব হ্যায় জুদাই কা মৌসম’-এর ওই প্রথম ২৪ মাসেই সুস্পষ্ট হয়ে যায়। সম্পর্কটা সেই এক জায়গাতেই ঠায় দাঁড়িয়ে আছে বা ক্রমশ পিছিয়ে যাচ্ছে। মানে, নো। টিকবে না।
তাও মানুষ যেমন আলাদা আলাদা, প্রতিটি দম্পতি বা জুটির রসায়নও এক্কেবারে আলাদা আলাদা। কিছু মানুষ থাকেন, যাঁদের বিশ্বস্ততা, রোম্যান্টিসিজম, সহনশীলতা, সততা, হাল না ছাড়ার দম সাংঘাতিক রকম বেশি। দেখা গিয়েছে, এঁদের সাফল্যের হারও বেশি। লং ডিসট্যান্স রিলেশনশিপের চাবুক সইবার পরও এঁরা নিজেদের চাওয়া-পাওয়া বাড়িয়ে-কমিয়ে দু’জনের স্বপ্নের পথ ফের জুড়ে ফেলেন একত্র।
তাঁরা সুখে থাকেন, ভাল থাকেন, সুস্থ সম্পর্কে বাঁচেন। ভূগোলের দূরত্বকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে সঙ্গীর সঙ্গে লুকোচুরি খেলেন দুনিয়া জুড়ে। কিন্তু হারিয়ে যান না কক্ষনও! ‘জান-এ-জাঁ... ঢুঁডতা ফির রহা... তু কঁহা’— সঙ্গী খুঁজলেই দেশ কাল সীমানার গণ্ডি টপকে নিমেষে দু’হাত ছড়িয়ে দেন।
‘এখানে...’
চিরশ্রী মজুমদার
মডেল: দীপশ্বেতা, সোনাই
ছবি: অমিত দাস
মেকআপ: সন্দীপ নিয়োগী
হেয়ার স্টাইলিং: মৌসুমী ছেত্রী
পোশাক: ওয়েস্টসাইড
লোকেশন: দ্য কনক্লেভ ক্লাব ভর্দে ভিস্তা
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy