স্মৃতিবিজড়িত: শিল্পী সুমন দে-র একক প্রদর্শনীর চিত্রকর্ম। —নিজস্ব চিত্র।
এই প্রথম শিল্পী সুমন দে-র একটি একক প্রদর্শনী দর্শকের সামনে উপস্থাপিত করল কলকাতা সেন্টার ফর ক্রিয়েটিভিটি। প্রদর্শনীর নাম, ‘দ্য লস্ট ফ্র্যাগ্র্যান্স অফ মেমরি’।
সুমন দে একজন স্বশিক্ষিত শিল্পী। তাঁর প্রথম দিকের পুরাণভিত্তিক ছবিগুলি ব্যক্তিগত আবেগমণ্ডিত ছিল। তিনি সেই সময়ে বেঙ্গল স্কুলের ধরনে ছবি আঁকতেন। ২০১০-এর মাঝামাঝিতে সুমনের কাজে অনেক পরিবর্তন আসে। তিনি পুরাণের গল্প বলা ছেড়ে দিয়ে, আলঙ্কারিক কাজ থেকে সরে এসে অনেকটা আধুনিক এবং প্রতীকী করে তোলেন তাঁর ছবিগুলোকে। গত পাঁচ বছরে বড় বড় ক্যানভাসে ছবির রূপ নিয়ে অনেক পরীক্ষানিরীক্ষা করছেন সুমন। এই প্রদর্শনীতে দর্শক এই ধরনের বিমূর্ত কাজই দেখতে পাবেন।
তিনি কাজ করার আগে বহু স্কেচ করেন, খসড়া তৈরি করেন। যখন তিনি কাজের জন্য তৈরি হতে থাকেন, তখন টানা দু’-তিন মাস ধরে লেআউট (প্রাথমিক নকশা) গুলোই করতে থাকেন। তারও পরে মনস্থির করেন, কোনগুলো বড় করলে ভাল ছবি হয়ে দাঁড়াবে। তখন তিনি সেগুলো বড় করেন। ছোট ছবি বড় করতে গেলে আরও যে সব উপাদান লাগে, সেগুলি একত্র করে সুমন ছবিটাকে বর্ধিত করেন। কিন্তু তাঁর রঙের ব্যবহারে উজ্জ্বলতা দেখা যায় না। যখনই কোনও রং ব্যবহার করতে ইচ্ছুক হন, তখনই প্রাথমিক বা মৌলিক রঙের সঙ্গে সাদা মিশিয়ে প্রাথমিক রংটা বেশ খানিকটা চেপে নিয়ে, সেটাই ব্যবহার করা তাঁর অভ্যেস। সুমনের কালার প্যালেটে বেশির ভাগ সময়ে সাদা, কালো, বাদামি এবং ধূসর থাকে।
শিল্পী সুমন দে-র কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিল্পশিক্ষা হয়নি তার অন্যতম কারণ ছোটবেলায় পারিবারিক অবস্থা খুব অনুকূল ছিল না। বাবার একটি পানের দোকান ছিল, যেখানে মাঝে মাঝে তাঁকেও বসতে হত। কখনও সংসার চালানোর দায়ে ব্লকপ্রিন্টের কারখানায় কাজ করেছেন, আবার কখনও হোমিয়োপ্যাথি ওষুধের দোকানে কাজও করেছেন।
যেহেতু আর্ট কলেজে যাওয়া সম্ভব হয়নি, তিনি খুব ছোটবেলা থেকেই গ্যালারিতে যেতেন আর নানা শিল্পীর কাজ দেখতেন। নিজের কাজ নিয়েও বহু অগ্ৰজ প্রবীণ শিল্পীর দ্বারস্থ হয়েছেন। তাঁরাই বুদ্ধি দিয়েছেন সুমনকে এবং নানা ভাবে সহযোগিতা করেছেন।
বিগত ৮-১০ বছর ধরে সুমন দে অনেক বিমূর্তকরণ করেছেন ছবিতে। এই বিমূর্ত ভাবের ছবিগুলি নিয়ে বিভিন্ন সিরিজ়ে কাজ করেন। এখানে দর্শক দেখছেন তাঁর ‘মেমরি সিরিজ়’। প্রত্যেক মানুষের স্মৃতিতে যে রকম ছেলেবেলা ধরা থাকে, সেই রকম তাঁর স্মৃতিতে যা যা ধরা আছে, যেমন, পানের দোকানে যখন তিনি বসতেন, পানের উপরে চুন-খয়ের লাগানোর সময় যে টেক্সচার অনুভব করেছিলেন, সেই টেক্সচার ছবিতে উঠে এসেছে। পলেস্তরা খসে যাওয়া দেওয়ালের টেক্সচার দেখা যায়। আগের সিরিজ়ের ছবির সঙ্গে ফর্ম বা আঙ্গিকের কিছুটা ধারাবাহিকতা আছে। কিন্তু নিজেকে বেশ খানিকটা এগিয়েও নিয়েছেন সুমন। শিল্পীর কাজে কিছুটা বাস্তবধর্মী ভাব পাওয়া যায়, আবার কিছু বৈপরীত্য ভাবও এখানে প্রকাশ পায়। তাঁর কাজের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব রয়েছে, বা যে সব ভাবনা-চিন্তা তিনি করেন, সে সব বাস্তবধর্মী ভাব বিমূর্ততার ভিতর দিয়ে প্রকাশ পায় তাঁর আঁকায়।
শিল্পী সুমন দে-র ছবিতে রঙের জৌলুস পাওয়া যায় না। গভীর অনুভূতির উৎস থেকে উঠে আসা বলেই হয়তো শুধুমাত্র ওই ধরনের রং ব্যবহার করার সাহস রাখেন সুমন।
একটি ছবিতে ধূসর বাদামি এবং কালোর ছোঁয়া দিয়ে এঁকেছেন। এই ছবি অ্যাক্রিলিক, চারকোল এবং গ্রাফাইটে আঁকা ক্যানভাসের উপরে। ছবিটির নাম ‘রিমেইন্স’ মানে অবশেষ। ছবিটি ডিপটিক। দু’টি ক্যানভাস পাশাপাশি রেখে তাতে বোনা হয়েছে কাজটি। বেশ কিছু ভাঙা ভাঙা নৌকোর টুকরো বা বাড়ির দেওয়ালের টুকরো নিরাবরণ অবস্থায় এঁকেছেন। শিল্পী কী ভেবে এঁকেছেন এগুলি, দর্শককে বুঝে নিতে হবে। এই ভাবার সুযোগটুকু সুমন দে-র ছবিতে পাওয়া যায়। রঙের ব্যবহার বেশ উঁচু দরের। কিন্তু ছবিটি বেদনাবিধুর।
দ্বিতীয় আর একটি ছবির নাম ‘ডিকয়’। মানে ফাঁদ বা প্রলোভন। এটি অ্যাক্রিলিক চারকোল এবং পেন্সিলের কাজ। দর্শক দেখতে পাবেন প্রজাপতির মতো একটি প্রাণীর অংশ। ধূসর সাদা এবং একটু কালো ছোঁয়ায় বেশ আকর্ষক একটি আকৃতি, খানিকটা যেন প্রজাপতির মতো। দর্শকের কল্পনাকে উসকে দিতে সাহায্য করেন সুমন। যথারীতি রঙের ব্যবহার অনবদ্য। এত সীমিত প্যালেটে ইদানীং বড় একটা কাজ হয় না। অপর একটি ছবির নাম ‘আপস অ্যান্ড ডাউন’। প্রধানত বাদামি প্যালেটে করা, অনেকটা পাশাপাশি রাখা বইয়ের মতো, অথচ বইয়ের আয়তন নেই। যেন বইয়ের মলাটগুলো এলোমেলো অবস্থায় পড়ে আছে। এটিও অ্যাক্রিলিক চারকোল এবং পেন্সিলে করা কাজ। যথারীতি বেঁধে রাখা প্যালেট। এখানে একটু হালকা ও গাঢ় সবুজের ছোঁয়া পাওয়া যায়।
এ বারে যে কাজটির কথা বলা হবে, সেটির নাম ‘আনএক্সপেক্টেড স্টর্ম’। ক্যানভাসে অ্যাক্রিলিক, চারকোল এবং পেন্সিলে করা কাজ। ঝড়ে নদীর নীচে তলিয়ে যাওয়া নৌকোর ভাঙা অংশ ইত্যাদিকে নানা জ্যামিতিক আকার দিয়ে ছবিটি আঁকা হয়েছে। এই ছবিটিতে হালকা অনুভূতির ছোঁয়া লাগিয়ে বেশ বুদ্ধি খাটিয়ে ওই গড়নগুলিকে সাজানো হয়েছে।
ছোটবেলার নানা স্মৃতি থেকে ছেঁকে নিয়ে আসা, পার্থিব জগতের চারপাশের বস্তুগত উপাদান নিজের মনের মতো করে, এক নিজস্ব ভাষায় অনুভূতি দিয়ে পরিবেশন করেন সুমন। তাঁর প্রত্যেকটি ছবিতেই একটা স্বকীয়তা রয়েছে। সুমনের প্রদর্শনীটি চলবে আগামী ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy