Advertisement
২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪

কে বলে, সব সয় এই নারীর হৃদয়?

নিজের সামান্য যত্নআত্তির দিকে একটু খেয়াল রাখলেই নিস্তার পেতে পারেন হার্টের সমস্যা থেকেনিজের সামান্য যত্নআত্তির দিকে একটু খেয়াল রাখলেই নিস্তার পেতে পারেন হার্টের সমস্যা থেকে

চিরশ্রী মজুমদার
শেষ আপডেট: ০৩ মার্চ ২০১৮ ০০:০৬
Share: Save:

নারীচরিত্র বেজায় জটিল, কিছুই বুঝতে পারবে না…’ — আজ্ঞে হ্যাঁ। বুকের অনেক গভীরে সঅব চেপে রাখি আমরা। তাই বলে এতখানি ভুল বুঝবেন? যুগ যুগ ধরেই বিশ্বাস, হার্টের রোগটা পুরুষদেরই হয়।

এই একচোখো ধারণার উত্তর দিয়েছে সম্প্রতি এক সমীক্ষার ফল। দেশের ৪১ শতাংশ মহিলারই হার্টের অসুখ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। দেখা গিয়েছে, পুরুষের হৃদ্‌গোলযোগ ধরা পড়লে, তার চিকিৎসা যতটা ফলপ্রসূ হয়, মেয়েদের ক্ষেত্রে তা ততটা কাজে দেয় না। কারণ, রোগ দেরিতে ধরা পড়ে। ফল, আকস্মিক চলে যাওয়া। কী করব? জটিল প্রাণী আমরা। মন জটিল, শরীরও জটিল। তাই এটুকু বুঝি, মেয়েদের হার্ট অসুস্থ হওয়ার প্রধান কারণ অবহেলা।

চিকিৎসার ভাষায় বুঝিয়ে দিলেন হৃদ্‌রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. সুনীলবরণ রায়। তিনি বলছেন, প্রজননক্ষম সময়ে নারীর ‘করোনারি হার্ট ডিজিজ’-এ আক্রান্ত হওয়ার ভয় কম। তখন মেয়েদের শরীরে থাকে ‘হার্ট-প্রোটেক্টিভ’ হরমোন ইস্ট্রোজেন। হৃদয়ের অসুখ থেকে সামলে রাখে তা। এই নতুন সময়ের পরিবর্তিত জীবনযাত্রা হারাচ্ছে ইস্ট্রোজেনকে। তার বর্ম টপকে চাকু ঢোকাচ্ছে মেয়েদের হৃদয়ে।

আগে মা-দিদিমারা ঘরটাই সামলাতেন। পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন ‘থ্যাংকলেস জব’টা করতেন আমৃত্যু। তাতে কষ্ট অনেক। কিন্তু অন্তত এই প্রজননক্ষম বয়সটুকুর জন্য হৃদ্‌রোগ তাঁদের অন্তঃপুরে ঢুকতে সাহস পেত না। এখন তো ওই ঘর সামলানোর সঙ্গে এসেছে বাইরে পুরুষের সঙ্গে সমানে কাজ করার চ্যালেঞ্জ। এ ছাড়া পড়াশোনা করে ঘরে বসে থাকলেও স্বাধীনতা যেমন হারায়, তেমনই বাড়তে থাকে হতাশার পাহাড়। তা হলে, কাকভোরে উঠে ঘরকন্না সামলে অটো-বাস-মেট্রো ঠেঙিয়ে ছুটতে হয় কর্মস্থলে। সেখানে পৌঁছেই আবার এক লহমায় ঘরের চিন্তা মাথা থেকে একদম ঝেড়ে ফেলে লড়াই করতে হয় ‘প্রফেশনাল হ্যাজার্ডস’-এর সঙ্গে। হৃদয়ের এবং আয়ুষ্কালের হয়তো সবচেয়ে বড় শত্রুর নাম তাই স্ট্রেস।

অতক্ষণ অফিসে থাকতে গেলে তো সারাটা সময় বাড়ির খাবার পাওয়া যায় না। যা পাবেন চটপট তাই খেতে হবে। বাইরের কেক, পেস্ট্রি, রোল, চাউমিন, বিরিয়ানি। সুখাদ্য মানেই কুখাদ্য। তারা হার্টে ছ্যাঁদা করতে শুরু করে নিঃশব্দে। তার পর রাত গড়ালে বাড়ি ফিরে আবার ঝাঁপিয়ে পড়তে হয় গৃহকর্মে। অর্থাৎ বাড়ি-অফিস-বাড়ি। এক দিনেই তিন শিফ্‌ট-এর কাজ।

চিকিৎসক রায়ের আক্ষেপ, ইদানীং ৩০ বছর বয়সি মেয়েরও অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি করতে হয়েছে। সেই ভদ্রমহিলার স্বামী বাইরে চাকরি করেন। ফলে সবটাই নিজেকে সামলাতে হয় ওই মহিলাকে। আর সেই চাপ, যন্ত্রণা থেকেই এই ক্ষয়ের সূত্রপাত।

চিকিৎসকের অভিজ্ঞতা, এখনও ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের হার্টের রোগ কম হয়। কিন্তু ফারাক কমছে ভীষণ তাড়াতাড়ি। সংখ্যায় পুরুষদের তুলনায় অর্ধেক মহিলা রোগী আসছেন চেম্বারে। আশঙ্কা, খুব তাড়াতাড়ি সংখ্যাটা সমান সমান হবে। বা ছাপিয়েও যেতে পারে মহিলাদের সংখ্যা।

তাই এখনই দরকার প্রতিরোধ। নিজের আয়ু কিন্তু সত্যিই নিজের হাতে। তাই খেয়াল রাখতে শুরু করুন কুড়ির কোঠা থেকেই।
ডা. রায় সতর্ক করছেন, যাঁরা টেনশন বেশি করেন, যে কোনও রোগই তাঁদের আগে ধরে। হার্টের অসুখ তো বটেই। বংশে এই রোগের ইতিহাস, উচ্চরক্তচাপ, ডায়াবিটিসের ধাত, ধূমপানের অভ্যেস, বেশি কোলেস্টেরল, অত্যধিক স্ট্রেস থাকলেই ডাক্তার দেখান। বছরে অন্তত এক বার স্বাস্থ্যপরীক্ষা করা কিন্তু জরুরি। রক্তে চিনি, প্রেশার, কোলেস্টেরল বেশি থাকলেই চিকিৎসকের পরামর্শ মতো ওষুধ খেয়ে ওগুলি আয়ত্তে রাখুন। ফল, আনাজপাতি, চিনি, তেল, ঘি, মাখন ছাড়া বাড়ির খাবার খান। রেডমিট পারলে এড়িয়ে চলুন। ডায়েটে মাংসের বদলে মাছ বেশি রাখুন। টেকনোলজি যতটা সম্ভব কম ব্যবহার করুন। প্রযুক্তি আমাদের আয়েসি, কুঁড়ে বানিয়ে দিচ্ছে। সাঁতার কিন্তু হৃদয় সুস্থ রাখতে খুব ভাল ব্যায়াম। কিন্তু তার সময় ক’জন মহিলা পান? তাই নিয়মিত ঘাম ঝরিয়ে জোরে হাঁটার অভ্যেস করুন। এতে শুধু হৃদয়ই নয়, শরীরের সব যন্ত্র ভাল থাকবে।

কতকগুলো লক্ষণ খুব গুরুত্বপূর্ণ। বুকে চাপ লাগলে সেটা গ্যাস-অম্বলের ব্যথা বলে উড়িয়ে দেবেন না। যদি হজমের ওষুধ খেয়েও অস্বস্তি না কমে, ডাক্তারের কাছে যেতেই হবে। বুকের মাঝখানে বা বাঁ দিকে ব্যথা, চোয়ালে-হাতে-গলায় ব্যথা হচ্ছে মানেই কিন্তু হৃদয় জানান দিচ্ছে— সে ঠিক নেই। হাঁটতে গেলে হাঁপ লাগছে, দাঁড়িয়ে বা বসে পড়লে শ্বাসকষ্ট চলে যাচ্ছে মানেও বিপদ ধারেকাছেই ওঁত পেতে আছে।

ভয় নেই। একটু নিজের জন্য লড়ুন। আপনি ভাল থাকলে, সুস্থ থাকলে তবেই পরিবারের সকলকে ভাল রাখতে পারবেন। জীবনের চাওয়াগুলো একটু কমানোর চেষ্টা করা যায় কি না দেখুন। এই ‘চাই চাই’-ই আমাদের শেষ পর্যন্ত ‘নাই’-তে দাঁড় করিয়ে দেয়। স্ট্রেস কমাতে যোগাভ্যাস, প্রাণায়াম, ব্যায়াম, স্বজনের সঙ্গে সময় কাটানো, এমনকী পার্লারে একটু রিল্যাক্স করে আসাও অনেক সময়ে কাজে দেয়। রোজ পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুমোন। টাইম ম্যানেজমেন্ট করুন। চব্বিশ ঘণ্টা সময়টাকে ছোট ছোট খোপে ভাগ করে, গুরুত্ব অনুযায়ী আগে পরে সাজিয়ে ঘর-বাইরের কাজ গুছিয়ে রাখুন। কোনও কোনও যান্ত্রিক কাজ থেকে নিজের মনকে ‘ডিট্যাচ’ করতে শিখুন। জোর করে টেনশন চাপানো হলে, কী ভাবে সামলাবেন তাই নিয়ে পরিবার-বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলুন। কোনও শখ থাকলে সেটা লালন করুন।

সবচেয়ে বড় কথা, নিজেকে অত্যধিক বিলিয়ে দেবেন না। সমাজের শেখানো ‘দশভুজা’ বুলিটাকে নিজের ভগবানদত্ত প্রাণশক্তি নিংড়ে সত্যি করে তোলার কোনও দরকার নেই। ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে অতিরিক্ত চাপের বোঝা লুকোনোও জরুরি নয় মোটেই। বরং সুস্থ হাসিখুশি স্বাভাবিক মানুষ থাকুন! হৃদয় ভাল থাকবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Heart Problems Women Heart Attack
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE