প্রকাশিত: চারুবাসনায় সঞ্জয় ঘোষের একক প্রদর্শনীর চিত্রকর্ম Sourced by the ABP
নরওয়ের শিল্পী এডভার্ড মুঙ্ক সৌন্দর্যের ভিতরে দেখতে পেতেন সঙ্কটের ছায়া। জার্মান শিল্পী এমিল নোলডের ছবিতেও একই উৎকণ্ঠা দেখা যায়। প্রায় একই ভাবে এক্সপ্রেশনিজ়মের অস্থিরতা রবীন্দ্রনাথের অনেক ছবিতে লক্ষ করা গিয়েছে। ড. সঞ্জয় ঘোষের সাম্প্রতিক কাজেও বিমূর্ত এক্সপ্রেশনিজ়মের সেই চাপা উৎকণ্ঠা অনুভব করা যায়। ত্বক বিশেষজ্ঞ সঞ্জয় চিকিৎসার পাশাপাশি বহু দিন ধরেই চিত্রচর্চা নিয়ে লেখাপড়া করছেন এবং ছবি এঁকে চলেছেন। এ ছাড়া সাহিত্য ও শিল্পজগৎ নিয়ে তাঁর বিপুল গবেষণামূলক বইয়ের সংখ্যাও কম নয়।
১৯৯৬ সালে শিল্পীর প্রথম চিত্রপ্রদর্শনী আয়োজিত হয়েছিল। সম্প্রতি চারুবাসনার সুনয়নী চিত্রশালায় আয়োজিত হয়েছিল সঞ্জয় ঘোষের পঞ্চম প্রদর্শনী। সাম্প্রতিক সময়ে তাঁর করা বিভিন্ন মিডিয়ামের ৪২টি ছবির একত্রীকরণের নাম ছিল ‘বিয়ন্ড দ্য লাইনস অ্যান্ড ফর্মস’।
জলরং, সঙ্গে কখনও প্যাস্টেল বা পেন অ্যান্ড ইঙ্ক। ক্যানভাস বোর্ডের উপরে অ্যাক্রিলিক, আবার কখনও সাপোর্ট হিসেবে শিল্পী বেছে নিয়েছেন ফেব্রিয়ানো, হ্যান্ডমেড পেপারের মতো জলরঙের কাগজ ও মাউন্ট বোর্ড।
ট্র্যাডিশনের মধ্য দিয়ে গেলে যেমন পায়ের তলার মাটি শক্ত হয়, আবার শুধুই ঐতিহ্যনির্ভর হয়ে উঠলে গতিপথ রুদ্ধ হয়ে যায়। এ দিক থেকে সঞ্জয় ঘোষের ছবি মুক্ত মনের বিচারী। কখনও অবচেতন স্তর ভেদ করে তাঁর রং এগিয়ে যায় আপন খেয়ালে। আবার কখনও বস্তুগত চিন্তাভাবনা দিয়ে শুরু হয়ে অবচেতন জগতের ইঙ্গিত দেয়। মূলত ছবির কম্পোজ়িশন এবং ফর্মকে রং দিয়ে ব্যাখ্যা করার চেষ্টায় শিল্পীর আগ্রহ বোঝা যায়।
বোর্ডের উপরে মিশ্র মাধ্যমে করা ‘দ্য বিল্ডিংস আই ট্রাভার্সড থ্রু’ কাজটি। আলট্রামেরিন ও প্রুশিয়ান ব্লু-র বুদ্ধিদীপ্ত সারফেসে উজ্জ্বল হলুদ ও বাদামির ইমারত ফুটে উঠেছে, রেখাবেষ্টিত জ্যামিতিক ছকে। এই কাজে দু’রকম নীলের ব্যবহার রয়েছে। আকাশকে অনেকগুলি চতুর্ভুজে ভাগ করা। অর্থাৎ আকাশে অনেক রকম জায়গা আছে। যেমন ফ্লাইটে যাওয়ার মধ্য দিয়ে দেখা, আকাশের আনুভূমিক তলগুলি বিভিন্ন অ্যাঙ্গলের বিন্যাসে যে প্রতিচ্ছবি হয়ে ওঠে, সেই চমৎকারিত্ব শিল্পীর আনসার্টেন বা অনিশ্চিত মুহূর্তকে দামি করে তোলে। প্রায় একই অনুভবে তৈরি হয় ‘দ্য সার্কলস, দ্য রেন, দ্য ডোর’ ইত্যাদি কাজগুলি। দেখতে দেখতে ভীষণ ভাবে মনে পড়ে যায় রাশিয়ান শিল্পী ক্যান্ডেনস্কির ক্লাসিক রেখার বলিষ্ঠ প্রকাশ।
এ বারের প্রদর্শনীটিকে টেক্সচারের জাদুঘর বললেও ভুল বলা হবে না। শিল্পের ক্ষেত্রে সঞ্জয় ঘোষের সবচেয়ে প্রিয় টেকনিক, টেক্সচারকে স্বতন্ত্র ভাবে পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ করা। ক্যানভাস বোর্ডে অসাধারণ চারটি কাজ ‘দ্য ব্লাড টিংগস’। সাদার ওপর জেসো দিয়ে, স্প্যাচুলার টানে আর্তি ঝরালেন তিনি, মৃত পাখির ছিটকে যাওয়া ডানার টুকরো এবং ঝরা রক্তের সামান্য অস্তিত্বের মাধ্যমে। ‘দ্য হিউম্যান ল্যান্ডস্কেপ’কে শিল্পী ব্যাখ্যা করলেন এই ভাবে— “আমরা ল্যান্ডস্কেপ বলতে সাধারণত নেচার বুঝি। হিউম্যান বডিও একটা নেচার। তাই এটাও একটা ল্যান্ডস্কেপ হতে পারে।” ব্লু ও ব্রাউনের পরস্পরবিরোধী ভাবনার প্রতিফলনে ছবি দু’টি মন্দ লাগে না।
মিশ্র মাধ্যমে করলেও, জায়গায় জায়গায় ড্রাই ব্রাশিং ও মৌলিক ভাবে জলরংকে গোয়াশের টেকনিকে ফেলে নিজের মতো টেক্সচার করে, শিল্পী বেশ কিছু ছবির ফর্মে নানাবিধ রূপান্তর ঘটিয়েছেন। ফলে দর্শক একাধিক অর্থ খুঁজে পেতে পারেন। এতে ছবিগুলি উত্তরণের পথ পায়। একটি ছবির কথা উল্লেখ করতেই হয়— ‘দ্য রেড পন্ড’। প্রকৃতির ধ্বংসাবশেষ। গাছের পাতা নেই।, আছে শুধু কাণ্ড। তা-ও শেষের পথে৷ দু’টি দুর্দান্ত রচনা— ‘দি অ্যানিমাল ইন দ্য স্কাই’, ‘দ্য বার্ড ইন দ্য ডেজার্ট’! স্কাই-এর ছবিতে জ্যামিতিক লেয়ার হতে হতে শিল্পীর মনে হয়েছিল, এখানে একটি স্ট্রাকচার লাগবে। ছবিতে আসে একটি কঙ্কাল, অর্থ পালটে যায়। একটি প্রাগৈতিহাসিক জীব আকাশ বিদীর্ণ করে চিৎকার করে চলেছে নিজের অস্তিত্বের দাবিতে। আকাশের ডাইমেনশনই বদলে যায়।
নিজের ছবি প্রসঙ্গে শিল্পী বললেন, “বিমূর্ত কাজ রাতারাতি সৃষ্টি হতে পারে না। তার চরম উদাহরণ গণেশ হালুই। ভাঙতে ভাঙতে উনি নিজেকে কোথায় নিয়ে চলেছেন! দু’রকমের অ্যাবস্ট্রাকশন হয়। একটা অর্গ্যানিক, আর একটা জিয়োমেট্রিক। এক দিকে ক্যান্ডিনস্কি, আর এক দিকে মন্দ্রিয়ান। আমার মনে হয়, দুটো কেন আলাদা হবে? মেলানোও তো যায়। ছবি রিয়্যালিস্টিক হোক আর অ্যাবস্ট্রাক্ট হোক, আমি যদি একটা দরজা খুলে না রাখি, তা হলে ছবি সার্থকতা পায় না। ছবি সার্থকতা পায় দু’পক্ষ থেকে, শিল্পী ও দর্শক। পরিতোষ সেনের ছিল এমনই একটা সহজ ভঙ্গি।”
প্রদর্শনীতে এসে শিল্প সমালোচক মৃণাল ঘোষ ও চিত্রশিল্পী তাপস কোনার বক্তব্য রাখেন সঞ্জয় ঘোষের কাজ নিয়ে। মৃণাল ঘোষ বললেন, “এই যে ধীরে ধীরে পাল্টে যাওয়া, লেখা-ছবি সমস্ত কিছুর ক্ষেত্রে একটা উত্তরণ, এটা একটা অসামান্য দিক। ওঁর সমস্ত কাজের মধ্যে একটা ফ্যান্টাসি আছে। সেটা এখন ধীরে ধীরে ধ্রুপদী চেতনার দিকে নিয়ে আসছেন সঞ্জয়। সেটা বিমূর্ত।”
তাপস কোনারের কথায়, “ওঁর মধ্যে যে এলিমেন্ট রয়েছে, সেটা সব সময়ে প্রকাশের অপেক্ষায় থাকে। সে সাহিত্যে হোক, শিল্পে হোক। পরিতোষ সেনের মধ্যে যেটা ছিল, নানা রকম লেয়ার টেক্সচার না করে উনি খুব সাবলীল ভাবে যেটা করতেন, সেই সাহসটা দেখাতে পারতেন। সঞ্জয়ের সে সাহস আছে। নানা অ্যাপ্রোচে এ বারে কাজ করেছে।”
প্রদর্শনীতে প্রকাশিত হয় সঞ্জয় ঘোষ সঙ্কলিত সুন্দর চিত্রাবলির একটি গুরুত্বপূর্ণ বই। সব মিলিয়ে মনে রাখার মতো একটি প্রদর্শনী দর্শককে উপহার দিলেন শিল্পী।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy