Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

আজ ইস্টবেঙ্গল জনতার কাছে ক্ষমা চান বড়ে মিঞা

ময়দানের এককালীন দাপুটে নবাব। এখন স্বেচ্ছানির্বাসিত। হায়দরাবাদে। ষাটোর্ধ্ব মহম্মদ হাবিবের ডেরায় বসে পুরনো সাম্রাজ্যের অলিগলি হয়ে নয়া জমানা নিয়ে তাঁর গর্জন শুনে এলেন সুপ্রিয় মুখোপাধ্যায়। সঙ্গী আলোকচিত্রী উৎপল সরকার। আজ দ্বিতীয় কিস্তিদূর থেকে আজানের স্বর ভেসে আসছে। আল্লা…আ…আ…জানকী নগরের বাড়িতে সোফায় বসা মিঞার চোখ তখন সিলিঙের দিকে। থমথমে মুখ। সফেদ পাঞ্জাবি গায়ে। কালো চশমার আড়ালটা আজ আর নেই। ঈষৎ ফ্যাকাশে লাগছে যেন তাঁকে। মধ্য সত্তরের এক বিতর্কিত অধ্যায় তোলার পর প্রথমে হেসে উঠেছিলেন। তার পরই যেন শব্দ হারিয়ে ফেললেন। অনেক বাদে অস্ফুট স্বরে বললেন, ‘‘কসুর মেরা ভি থা দাদা। লেকিন উও লোগ সব্ বেকার কর্ দিয়া!’’

গোলকোন্ডায় নবাব

গোলকোন্ডায় নবাব

শেষ আপডেট: ০৪ জুলাই ২০১৫ ০০:০৩
Share: Save:

দূর থেকে আজানের স্বর ভেসে আসছে। আল্লা…আ…আ…

জানকী নগরের বাড়িতে সোফায় বসা মিঞার চোখ তখন সিলিঙের দিকে।

থমথমে মুখ। সফেদ পাঞ্জাবি গায়ে। কালো চশমার আড়ালটা আজ আর নেই। ঈষৎ ফ্যাকাশে লাগছে যেন তাঁকে।

মধ্য সত্তরের এক বিতর্কিত অধ্যায় তোলার পর প্রথমে হেসে উঠেছিলেন। তার পরই যেন শব্দ হারিয়ে ফেললেন।

অনেক বাদে অস্ফুট স্বরে বললেন, ‘‘কসুর মেরা ভি থা দাদা। লেকিন উও লোগ সব্ বেকার কর্ দিয়া!’’

কী বলতে চাইছেন মহম্মদ হাবিব? তখনও বুঝে উঠতে পারিনি।

১৯৭৫। টানা ছ’বার কলকাতা লিগ জিতে নতুন রেকর্ড গড়ার মুখে ইস্টবেঙ্গল।
অথচ সে বারই লালহলুদ জনতাকে ভাসিয়ে দিয়ে ইস্টবেঙ্গল ছেড়ে মহমেডানে চলে গেলেন মহম্মদ হাবিব। তা’ও আবার একা নয়। সঙ্গে আকবর, লতিফুদ্দিন, মহম্মদ নাজির।

টানা পাঁচ বার লিগ জেতার পুরনো গৌরব তখনও মহমেডানের দখলে।

ময়দানে রটেছিল, কট্টর মৌলবাদী হাবিব চাননি মহমেডানের সে রেকর্ড ভেঙে যাক। তাই এই চলে যাওয়া।

এমনকী হাবিবের মহাগুরু তখনকার ইস্টবেঙ্গল-কোচ পিকেও নাকি ঘরোয়া আড্ডায় এই সম্ভাবনার কথা উড়িয়ে দেন না।

সাদা হাবিব-কালো হাবিব

১৯৭০-’৭৪ হাবিব যখন ইস্টবেঙ্গলে, এক হাজার ন’শো বত্রিশ দিন মোহনবাগানের কাছে হারেনি লাল-হলুদ।

লিগ-শিল্ড-ডুরান্ড-রোভার্স মিলিয়ে ওই পাঁচ বছরে জিতেছেন ১৩টা ট্রফি। পাঁচটা ফাইনালে গোল তাঁর।

তা সত্ত্বেও ‘মিস্টার ফাইটার’ বলতে ভারতীয় ফুটবল বরাবর যাঁকে বোঝে, সেই হাবিবের বিরুদ্ধে ’৭৫-এর সেই অভিযোগ আজও। এখনও।

হায়দরাবাদের বাড়িতে তাঁর সামনেই কথাটা তোলার আগে ভাবছিলাম এ বার নির্ঘাৎ
রাগে ফেটে পড়বেন। টেপরেকর্ডার বন্ধ-টন্ধ করিয়ে সটান বলে দেবেন, ইন্টারভিউ এখানেই শেষ!

কিন্তু দু’হাজার পনেরোর হাবিব কী করলেন?

হো-হো করে হাসতে লাগলেন। সাতষট্টির প্রৌঢ় শরীরটা সোফায় প্রায় গড়িয়ে পড়ার জোগাড় (আগের সংখ্যায় তাঁর বয়স একষট্টি ভুল লেখা হয়েছিল)। ‘‘আরে দাঁড়ান, দাঁড়ান। এটা তো জানতাম না! হাবিব ফান্ডামেন্টালিস্ট? হাবিব?’’ আবার অট্টহাসি!

খানিকটা হতভম্ব হয়েই তাকিয়ে রয়েছি। এক পলক থেমে বড়ে মিঞা বলতে শুরু করলেন, ‘‘আমি যদি সত্যিই এতটা গোঁড়া মুসলিম হতাম তা হলে তো সবচেয়ে বেশি মহমেডানে খেলতাম। অথচ আসল ঘটনা তো ঠিক তার উল্টো। ওখানেই সবচেয়ে কম সিজন খেলেছি। ইস্টবেঙ্গলে আট বছর। মোহনবাগানে সাত। মোহনবাগানেও ’৭৬-’৭৮ তিন বছরে লিগ, শিল্ড, ডুরান্ড, রোভার্স মিলে আটটা ট্রফি আছে আমার।’’

এর পরই হঠাৎ ভীষণ সিরিয়াস। এক্কেবারে চুপ। সিলিঙের দিকে চোখ রেখে যেন কথা হারিয়ে ফেললেন। বহু ক্ষণ বাদে গম্ভীর গলায় বললেন, ‘‘আসলে কী জানেন? পঁচাত্তরে যে ইস্টবেঙ্গল ছেড়েছি, তার জন্য আজ চল্লিশ বছর পরেও আমি কষ্ট পাই। এত বছর পরেও ওই ভুলের জন্য নিজেকে মাফ করতে পারি না। তার আগের পাঁচ বছর ইস্টবেঙ্গলকে অত সার্ভিস দিলাম। অথচ রেকর্ডের বছরটাতেই থাকতে পারলাম না! ছিঃ!’’

হাবিবের ছোট্ট ড্রইংরুমটা তখন যেন কেমন থমথম করছে। পাশে সোফায় তাঁর বিবি। গালে হাত দিয়ে বসে। এক মনে মিঞার কথা শুনছেন।

‘‘আমার ভুলে আকবরেরও ক্ষতি হয়েছে। একটা বিরাট রেকর্ডের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে রাখতে পারত ও। পারেনি। এই একটা ব্যাপারে ভাইয়ের কাছেও আমি দোষী। পরে আমি আর আকবর বারদুয়েক আলাদা ক্লাবে খেলেছি। আমি মোহনবাগানে, ও মহমেডানে। ও ইস্টবেঙ্গলে, আমি মহমেডানে। কিন্তু সেই পঁচাত্তরে আকবর আমার সঙ্গে এক টিমে ছাড়া কলকাতার বড় ক্লাবে খেলার সাহস পেত না। ওর তখন ক্যালকাটার বড় টিমে খেলার অভিজ্ঞতা মাত্র তিন-চার বছরের। যে জন্য আকবরও আমার সঙ্গে মহমেডানে গিয়েছিল। কিন্তু আমি না গেলে ও কি আর যেত?’’ একটানা নিজের দোষ কবুল করলেন মিঞা।

এই হাবিব যন্ত্রণাকাতর হাবিব! কথা বলতে বলতেই হঠাৎ উঠে পড়লেন। বাড়ি থেকে রাস্তায় বেরিয়ে এলেন। উল্টো দিকের ফুটপাথে একটা রক। তার ওপরই বসে পড়লেন ময়দানের এককালের নবাব।

‘‘তা হলে আসল কথাটা শুনুন! কলকাতায় ফিরে প্রদীপদাকে চেপে ধরলেও জানতে পারবেন। মিলিয়ে নেবেন আমার কথা,’’ আবার সে দিনের ঘটনায় ফিরে গেলেন।

যা বললেন, তা অনেকটা এমন— পঁচাত্তরে দলবদল শুরু হবে। ইস্টবেঙ্গলেরই কয়েকজন অফিশিয়াল সুযোগ পেলেই নাকি তখন তাঁর কানের কাছে ঘ্যানঘ্যান করতেন। — ক্লাব এ বার আর দুই ভাইকে রাখবে না। মহমেডানের রেকর্ড ভাঙতে চলেছে ইস্টবেঙ্গল। তাতে তাঁদের ধারণা, দাদা-ভাই মিলে স্যাবোটাজ করতে পারে!

‘‘ভুলটা আমারই হয়েছিল, আমি ওদের কথাতে নেচে প্রচণ্ড অভিমান আর রাগে প্রদীপদার সঙ্গেও এক দিন ঝগড়া করে বসেছিলাম। যার জন্য কোচও ওই সময় একটু বিরক্ত ছিলেন আমার উপর। আমি যদি ওই ফালতু কর্তাগুলোর কথাকে পাত্তা না দিতাম তা হলে অত বড় ভুলটা হত না। এখনও ভাবি, ইস, যদি এক বার সোজা ডাক্তারদাকে (ডা. নৃপেন দাস, তখনকার ইস্টবেঙ্গল-সচিব) গিয়ে জিজ্ঞেস করতাম!’’ আফশোস আজও যাওয়ার নয় তাঁর।

এই সময় হাবিবকে এক বার দেখতে হয়। কোথায় সেই ‘বাঘের বাচ্চা’ ইমেজ? হঠাৎ যেন কুঁকড়ে গিয়ে মাটিতে মিশে যেতে পারলে বাঁচেন।

এর পরই কিন্তু স্বমহিমায়। পাল্টা অভিযোগে বোমা ফাটানো, ‘‘শুনুন, ইস্টবেঙ্গল কর্তাদেরই একটা অংশ চায়নি ক্লাব টানা ছয় বছর লিগ পেয়ে রেকর্ড করুক। ডা. নৃপেন দাসের গোষ্ঠী আরও পপুলার হোক। আরও ক্ষমতা পাক।’’

সিংহবিক্রমে বার্ধক্যের থাবা

হাবিবের বয়স এখন ঠিক কত? ঠিক কোন সালে তিনি অর্জুন হয়েছেন?

তিন দিনে তিন বার জিজ্ঞেস করে তিন রকম উত্তর পাওয়া গেল।

চার দশক আগের ডাকসাইটে ফুটবলার এখন এতটাই আত্মভোলা! এক বার বললেন, ‘‘একষট্টি চলছে।’’

আর এক দিন বললেন, ‘‘আমার নাইনটিন ফর্টিনাইনে জন্ম।’’ তা হলে তো এখন ছেষট্টি!

হাবিব অর্জুন হয়েছেন গুরদেব সিংহেরও পরে! ফেডারেশনের চিরকালীন তুঘলকি কাজকারবারের সে এক চরম নিদর্শন।

তা বলে রাষ্ট্রপতির হাত থেকে অর্জুন নেওয়ার সাল-তারিখ ভুলে যাবেন হাবিব! এতটা বার্ধক্য কি ধরে গেল মহাদাপুটে ফুটবলারের মনে?

অর্জুনটা কোথায়? এ বাড়িতে, না আগের বাড়িতে?

এ প্রশ্ন করলেও প্রশ্নকর্তা নিজেই অস্বস্তিতে পড়বেন! কারণ হাবিবের উত্তর হবে, ‘‘কে জানে! বিবি বোধহয় জানে। শেষ বার তো ওটা পুরনো বাড়ির আলমারিতেই দেখেছিলাম, যদ্দূর মনে হচ্ছে!’’

হাবিব অর্জুন হয়েছিলেন ১৯৮০-তে। গুরদেবের দু’বছর পরে! কিন্তু অবলীলায় বলে দিলেন, ‘‘আমার শাদি তিয়াত্তরে। আর তার পরের বছরই অর্জুন!’’

এর পরে এই মানুষের বাকি সব ট্রফি, মেমেন্টোর খোঁজ নেওয়ার মানে হয়! কিন্তু ওই যে, আগের সংখ্যায় লিখেছিলাম— এক সাক্ষাৎ কনট্রাডিকশন ভরা আজকের এই মহম্মদ হাবিব! আমাদের ক্যালকুলেশেন যাঁর বয়স এখন সাতষট্টি।

পরক্ষণেই বলে উঠলেন, ‘‘তবে বছর চারেক আগে মমতাদিদির হাত থেকে পাওয়া ‘মহমেডান কা শান’ পুরস্কারটা এ বাড়িতেই রয়েছে। দেখুন, আমার সিধা বাত। জীবনে সবচেয়ে বেশি ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগানে খেললেও ওরা কেউ আমাকে লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট প্রাইজ দেওয়ার কথা ভাবেনি। কিন্তু মহমেডান ভেবেছে। যাদের হয়ে আমি সবচেয়ে কম খেলেছি। তেমন সাকসেস দিতে পারিনি। কী প্লেয়ার, কী কোচ— কোনও ভাবেই না। তাই এটা পেয়ে আমি সেদিন অভিভূত হয়েছিলাম। কলকাতা থেকে আমার পাওয়া সেরা সম্মান ওটাই।’’

হাবিবরা পাঁচ ভাই-ই মেরেকেটে দু’-তিন বছরের ছোট-বড়। আকবর যেমন হাবিবের চেয়ে আ়ড়াই বছরের ছোট। কথায়, হাবেভাবে এই আকবর কিন্তু তুলনায় অনেক গোছানো। স্মার্ট।

ছিয়াত্তরে মোহনবাগানে সই করার পর শৈলেন মান্না আকবরকে জিওলজিক্যাল সার্ভেতে চাকরির ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। যেখানে বাগানের মান্না নিজেও বরাবর চাকরি করেছেন। জিএসআই থেকে বছর তিনেক আগে অবসর নিয়েছেন আকবর। থাকেন হাবিবের জানকীনগরের বাড়ি থেকে অল্প দূরে। অলোকনাথ কলোনিতে।

মাঠের বাইরে গিয়ে আজও ‘থ্রু’টা বাড়িয়ে যান তাঁর আকবর ভাইয়াকে

পরের দিন সকাল ন’টাতে আকবর জানকীনগরের বাড়িতে এসে পড়ার পর অদ্ভুত একটা কাণ্ড ঘটল। এতক্ষণের অগোছালো হাবিব এ বার যেন ধীরে ধীরে কিছুটা স্বচ্ছন্দ। দাদা-ভাইয়ের পুরনো দিনের সেই তালমিল আজও তা হলে বহাল!

‘‘আকবরভাইয়া, তোর সাল-তারিখ ভাল ইয়াদ থাকে। এদের বল তো! আমি গুলিয়ে ফেলছি,’’ এক গাল হেসে প্রৌঢ় এ বার যেন এক কিশোরের ভূমিকায়।

হাবিব = গোল + ট্রফি

অত শত তারকার ভিড়ে কী ভাবে অসংখ্যবার নিজে মহাতারকা হয়ে ফুটে উঠতেন তার ব্যাখ্যাও রয়েছে হাবিবের কাছে।

টলি চৌকির উপর অত সাতসকালেও ক্যাঁচোরম্যাচোরে ভরা রেস্তোরাঁয় বসে মশালা ধোসার এক টুকরো মুখে পুরে বললেন, ‘‘এই দোকানটা দেখতে সাধারণ। কিন্তু খাবারটা অসাধারণ। স্পেশ্যাল। নিজের ফুটবলজীবনের যেন মিল পাই এখানে খেতে খেতে।’’

ঠিক বোঝা গেল না, বলাতে হাবিব হেসে ফেললেন। ‘‘বুঝলেন না? আমার জ্ঞানবুদ্ধিতে যতটুকু সম্ভব তেমনই একটা উদাহরণ দিলাম আর কী!’’

খাওয়া শেষ করে চায়ের কাপে একটা আরামের চুমুক দিলেন হাবিব। মুখে আলতো হাসি। বললেন, ‘‘মানে আমার ফুটবল দেখতে সাধারণ ছিল, কিন্তু রেজাল্টটা ছিল স্পেশ্যাল।’’

পাশের চেয়ারেই বসে আকবর। হঠাৎ যেন বড়ে মিঞা তাকে দেখে ‘থ্রু’ দিয়ে ফেললেন, ‘‘বল না, কত গোল করেছি ইম্পর্ট্যান্ট সব ম্যাচে!’’

বড় দাদার স্ট্যাটিসটিক্স ভাইয়ের ঠোঁটের গোড়ায় ঘোরে। ভেতরে ভেতরে একটু খালি গুছিয়ে নিলেন নিজেকে। দাদার লম্বা পাস পেয়ে বক্সের মাথায় যেমন করে যত্নে নামাতেন, অনেকটা তেমনই যেন।

আকবরের লম্বা ফিরিস্তি এক চুম্বকে এ রকম— সব মিলিয়ে ৫০টা টুর্নামেন্ট জিতেছেন হাবিব। ইস্টবেঙ্গলের ইতিহাসে প্রথম পাঁচ টপ স্কোরারের এক জন। ৬২টা গোল আছে লাল-হলুদ জার্সি গায়ে। শুধু বাহাত্তরের ডুরান্ডেই ৭ ম্যাচে ১২ গোল। ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান ডার্বিতে হাবিবের ১০টা গোল সর্বকালীন সর্বোচ্চ গোলের তালিকায় চার নম্বরে। তবে অদ্ভুত, ওই ১০ টাই ইস্টবেঙ্গলের হয়ে মোহনবাগান জালে পাঠানো।

‘‘ওটা লিখে আমাকে আবার বেশি ইস্টবেঙ্গল ফুটবলার বলে দেখানোর চেষ্টা করবেন না! আসলে হয়তো মোহনবাগানের হয়ে ইস্টবেঙ্গল ম্যাচ খেলার সময় প্রদীপদাই বলুন কিংবা অমলদা—আমাকে নিজে গোল করার চেয়ে বেশি অন্যকে দিয়ে গোল করানোর কাজে লাগিয়েছেন। সবুজ-মেরুন জার্সিতে বড় ম্যাচে তাই আমার কোনও গোল নেই।’’ নিজামের শহরে বিখ্যাত গোলকুন্ডা ফোর্টের বিশাল উঠোনে পায়রার ঝাঁক ওড়াতে-ওড়াতে বলছিলেন সত্তরের দশকে ময়দানের শাহেনশা।

লাল-হলুদ, সবুজ-মেরুনের মতোই ভারতের নীল জার্সি গায়েও অনেক গুরুত্বপূর্ণ গোল আছে। বয়স কুড়িতে ছোঁয়ার আগেই জাতীয় দলে নিয়মিত। টানা দশ বছর।

ছেষট্টি থেকে তিনটে এশিয়াড খেলেছেন। সত্তরে ব্রোঞ্জজয়ী পিকের ভারতের প্রথম ম্যাচে তাইল্যান্ডের সঙ্গে ০-২ পিছিয়ে থাকা ম্যাচে হাবিবের কীর্তি আজও ভোলার নয়। ২০ গজ দূর থেকে ভলিতে নিজে গোল করলেন। ২-১। তার পর সুভাষ ভৌমিককে দিয়ে দ্বিতীয় গোল। অবিশ্বাস্য ভাবে ম্যাচ ২-২ ড্র।

একাত্তরে পেস্তা সুকান চ্যাম্পিয়ন ভারতের হয়ে ইন্দোনেশিয়া আর মালয়েশিয়ার উল্টো দিকে পড়ে পর পর দু’ম্যাচে জোড়া গোল। উনসত্তরের সন্তোষ ফাইনালে সার্ভিসেসকে বাংলার হাফডজন গোলের মধ্যে হাবিবেরই পাঁচটা!

বিদেশি ক্লাব দেখলেও একই ভাবে জ্বলে উঠেছেন। পেলের কসমস। শিল্ডের ইতিহাসে সম্ভবত সবচেয়ে শক্তিশালী বিদেশি টিম আরারাত। দুটো ম্যাচেই গোল রয়েছে হাবিবের।

ডিসিএমে সাত জন নর্থ কোরিয়ান বিশ্বকাপার ভরা ডক রো গ্যাংয়ের সঙ্গে তো দুর্ধর্ষ কাণ্ড ঘটিয়েছিলেন প্রায় একা। ফরোয়ার্ড আর হাফলাইনের মাঝে পিভট হাবিব সে ম্যাচে তুখড়। পর পর দু’দিন ফাইনাল গোলশূন্য ড্র রাখার পর বিদেশিরা ‘পালিয়ে’ গেল। ট্রফি ইস্টবেঙ্গলের হাতে তুলে দিয়েছিলেন উদ্যোক্তারা।

কত অজস্র মণিমাণিক্য নিজের ফুটবল ক্যাবিনেটে জ্বলজ্বল করছে। তা সত্ত্বেও ২০১৫-র হাবিব কিন্তু বলছেন, ‘‘এগুলো একটাও নয়। আমার সেরা ম্যাচ আটষট্টির সন্তোষ ট্রফিতে পঞ্জাবের সঙ্গে রিপ্লে সেমি‌ফাইনালটা। তার আগের দিন মাঠ থেকে আমার লাশ কবরে ঢোকার কথা! তার বদলে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে আমি ম্যান অব দ্য ম্যাচ।’’

বড়েমিঞা বলে দিচ্ছেন, কোনও প্লেয়ারের জীবনে এ রকম আজব ঘটনা ঘটেনি!

(চলবে পরের শনিবার)

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE