Advertisement
০৩ নভেম্বর ২০২৪
আলোচনা
Paresh Maity

Sculpture: ধাতুসৃষ্ট অতিকায় অষ্ট অভ্যুদয়

এই স্টাইলের পর্যালোচনায় প্রাথমিক ভাবেই কয়েকটি উল্লেখযোগ্য দিক পরিস্ফুট হয়।

ধাতব: পরেশ মাইতির ভাস্কর্যের প্রদর্শনী ‘কাস্ট’। দ্য পাওয়ার: ধাতুকর্মে উদ্যত পশুর অবয়ব।

ধাতব: পরেশ মাইতির ভাস্কর্যের প্রদর্শনী ‘কাস্ট’। দ্য পাওয়ার: ধাতুকর্মে উদ্যত পশুর অবয়ব।

অতনু বসু
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৭ নভেম্বর ২০২১ ০৯:২৯
Share: Save:

মাত্র আটটি বড় কাজ, গাছপালা ঘেরা সুসজ্জিত লনে ছড়ানো। কাজগুলির দৈর্ঘ্য, আয়তন এবং বিন্যাসময় উপস্থিতি জানান দিচ্ছে, বহু কালের ছোট-বড় অসংখ্য ড্রয়িং-পেন্টিংয়ের পাশাপাশি তাঁর সাম্প্রতিক ধাতু মাধ্যমে বিরাট ভাস্কর্য নির্মাণের মুনশিয়ানাও কিছু কম নয়। কলকাতার গ্যালারি আর্ট এক্সপোজ়ার ও বিড়লা অ্যাকাডেমির যৌথ উদ্যোগে অ্যাকাডেমিরই লনে চলছে পরেশ মাইতির ‘কাস্ট’ নামে ভাস্কর্যের প্রদর্শনী।

কাস্টিং একটি প্রাচীনকালের প্রক্রিয়া। পরেশ এখানে প্রধানত তিনটি বিশেষ মাধ্যমকে গুরুত্ব দিয়েছেন— ব্রোঞ্জ, ব্রাস ও কপার। কোথাও ব্রাস ও কপার মিশ্রিত ভাস্কর্য আছে। এ ছাড়া অতীতেও প্রদর্শিত পতঙ্গ-পিপীলিকার কাজগুলিতে টিন, অ্যালুমিনিয়াম, লোহা, মিশ্র ধাতুর দৈনন্দিন ব্যবহৃত সামগ্রীর নির্বাচিত কিছু নির্দিষ্ট অংশ নিয়ে বিবর্তিত রূপে গড়েছেন ওই পতঙ্গ-পিপীলিকার রূপ। তিনি বিশ্বশিল্পের চিত্র-ভাস্কর্যের ভাললাগার দিকগুলি গভীর পর্যবেক্ষণ করেছেন। এই আত্তীকরণের ফল তাঁর অবচেতনের দরজা-জানালা খুলে কখন যেন এ সব বৃহদায়তন ধাতু-ভাস্কর্যের সঙ্গে মিলেমিশে গিয়েছিল। যে কারণে আধুনিকতাকে একপাশে রেখে, সনাতনী ঐতিহ্যের পরম্পরাকে না ভুলেও, কোথাও যেন অনুরণিত হয়েছে প্রত্নভাস্কর্যের কিছু অনন্য রূপকল্প। সমগ্র ওই ফর্মেশনে বিরাটত্বের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে, তিনি প্রতিমাকল্পে একইসঙ্গে জ্যামিতিক বিমূর্ততার সঙ্গে ছন্দ ও প্যাটার্নের একটি স্টাইল তৈরি করেছেন।

এই স্টাইলের পর্যালোচনায় প্রাথমিক ভাবেই কয়েকটি উল্লেখযোগ্য দিক পরিস্ফুট হয়। প্রথমত, সলিডিটি ও ভলিউম। তিনি যেমন এক-একটি ভাস্কর্যের পূর্ণতায় দৈর্ঘ্য ও বিরাটত্বের কথা ভেবেছেন, তেমনই রূপারোপের দিক থেকে সমগ্র কাজটিতে স্পেস ও প্যাটার্নের দিকটিকেও একটি নিরীক্ষামূলক স্টাইলাইজ়েশনের মধ্য দিয়ে রূপান্তরিত করেছেন। এই ফর্মেশনের মধ্যেই নির্দিষ্ট ভাবে কয়েকটি কাজকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, তাঁর অবচেতনে থাকা কিছু অনুষঙ্গের প্রত্নরীতি যেন ওই নির্মাণের শৈলীতে কিছুটা হলেও আচ্ছন্ন হয়ে আছে। বিশেষত আফ্রিকান মাস্ক থেকে অ্যাজটেক স্কাল্পচার ও মেক্সিকান ট্রাইবাল স্কাল্পচারের কিছু কিছু দিক অনুরূপ প্রত্ন-রূপারোপের সীমানাগুলিকে প্রতীকায়িত করে। ফলে ব্রোঞ্জের ‘ভিগর’-এর কর্ণালঙ্কার, খোঁপার ডিজ়াইন, কপাল ও নাকের দু’পাশের আধাবর্তুল আলঙ্কারিক রূপ, অক্ষিগোলক, টিকলি... সব মিলিয়ে স্পেস ও জ্যামিতির প্রচ্ছন্ন রূপারোপকে প্রতিফলিত করে। এই প্রত্নশৈলীর মধ্যেও তিনি নিজের মতোই ফর্মেশনের বাস্তবতাকে আধুনিক স্টাইলে রূপান্তরিত করেছেন। এখানে তাঁর রচনারীতির মধ্যে ঠিকরে বেরোনো আধাবর্তুল অক্ষিগোলক, চুলের এক পাশের লম্বা নেমে আসা বঙ্কিম রূপারোপের মধ্যে খাঁজকাটা ডিজ়াইন ও লম্বা নাকের অসাধারণ শৈলী তাঁর ‘সঙ্গম ওয়ান’ ব্রোঞ্জটিকে এক আলাদা মাত্রা দেয়। প্রয়োজনীয় পাতিনার যথাযথ ও চমৎকার অনুজ্জ্বলতা রাখা এই নিয়ন্ত্রণও কাজগুলির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তিনি এ সব বৃহদায়তন ভাস্কর্যের ক্ষেত্রে নির্মাণের নিশানাটিতে প্রাথমিক ভাবেই স্পেসের দিকটি নিয়ে ভেবেছেন। কতটা শূন্য স্পেস ও ভারসাম্য অনুযায়ী কোথায় বাঁক ও জ্যামিতিক বিন্যাস, বিশেষত ডিজ়াইনাল অনুষঙ্গের ব্যবহার কী ভাবে রাখতে হবে ও নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, সে বোধ তাঁর প্রখর।

ভিগর: আদিমতার আভাস প্রত্নশৈলীতে

ভিগর: আদিমতার আভাস প্রত্নশৈলীতে

তাঁর ‘রাইডার’ ও ‘অ্যান্ড্রোজাইন’ ব্রোঞ্জ দু’টি প্রায় একই ধরনের, শৈলী ও রচনার দিক থেকে। দু’টিতেই উচ্চাবচ জ্যামিতিক শৈলীর অনতি-বিমূর্ততার চমৎকার ছন্দের মধ্যে যে ঐক্যকে তিনি রূপারোপিত করেছেন, পর্যবেক্ষণোত্তর মনে হয়, এ দু’টির সমস্ত ক্ষেত্রেই ভারসাম্য ও শৈলীর নিরূপণ নিয়ে তিনি যথেষ্ট সচেতন ছিলেন। এখানেও ধাতুর চরিত্রের সঙ্গে নিয়ন্ত্রিত সংক্ষিপ্ত পাতিনার ব্যবহার ও আলোর উৎস নিয়ে ভেবেছেন। ত্বকের মসৃণতা, রুক্ষতা, গহ্বর, বঙ্কিমতা, ডিজ়াইন-সহ এই আধাবিমূর্ত আধুনিকতার প্রয়াস কাজ দু’টিকে অনন্যতায় পৌঁছে দিয়েছে। ‘দ্য স্পাইস রুট’ বস্তাবন্দি আনাজপাতি, ছড়িয়ে রাখা অজস্র লঙ্কা বোঝাই করা একটি টেম্পো। সমস্তটাই কাস্টিং, চাকাগুলি পর্যন্ত। হেভিওয়েট এই কাজটি প্রদর্শনীর অন্যতম বিশেষত্ব। যেমন আট হাজারের অধিক ছোট ঘণ্টাকে পরস্পর ওয়েল্ডিংয়ের মাধ্যমে নির্মাণ করেছেন লেজ তোলা, শিং বাগানো ও থমকে দাঁড়িয়ে থাকা একটি ষাঁড়। তামা ও পিতলের মিশ্র কাজ।

ফোর পিলার্স অব লাইফ: সংসারধর্মের প্রতীক

ফোর পিলার্স অব লাইফ: সংসারধর্মের প্রতীক

লনের এক দিকে দাঁড়িয়ে থাকা ব্রাস নির্মিত বাঁদরলাঠি গাছটি যেন সত্যিই ঝর্নাধারার মতো। নাম দিয়েছেন ‘গোল্ডেন শাওয়ার’। তিনি বিশাল সব পতঙ্গে আকীর্ণ পুরনো ভাঙা দেওয়াল, তাপ্পি দেওয়া দরজা-জানালার চারপাশে প্রচুর স্পেস রেখেছেন। এইসব পতঙ্গ-পিপীলিকার শরীর হল বাইকের ডিজেল ট্যাঙ্ক, পাখার ব্লেড হল ডানা, আর বিরাট দু’টি চোখকে দেখাতে বেছে নিয়েছেন গাড়ি-বাইকের বৃহৎ হেডলাইট, কাচ লাগানো, আলো জ্বলছে প্রত্যেকটির। ফলে একটি আলাদা ডায়মেনশন তৈরি হয়েছে। ‘ফোর পিলার্স অব লাইফ’ যৎসামান্য ডিজ়াইন ও সরলীকরণে তৈরি। পিলার একটি হলেও চারটি অংশকে ব্রহ্মচর্য, গার্হস্থ, বাণপ্রস্থ, সন্ন্যাস এভাবে ব্রোঞ্জে প্রতীকী তাৎপর্যে বিন্যস্ত করেছেন। চমৎকার বিন্যাস।

অন্য বিষয়গুলি:

Paresh Maity Sculpture Metal
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE