নাটকে দেবশঙ্কর হালদার ও প্রদীপ হাইত ছবি: প্রণব বসু
“এভাবে সে হয়ে ওঠে প্রায়শ নূতন ইতিহাস।/ ঘরের ভিতরে বসে দেখি তাকে, পড়ি তাকে,/আরো বেশি করে গড়ি তাকে...”
—‘শোকসভা’, শঙ্খ ঘোষ
এক মঞ্চ এক জীবন’ নাটকটি নাট্যাচার্য গিরিশ চন্দ্র ঘোষের জীবন নিয়ে।
নাটকের শুরু শোকসভা দিয়ে, আর নাটকের শেষে অভিনেত্রী বিনোদিনী দেবীর (দাসী) আত্মজীবনীর ভূমিকা লিখছেন গিরিশবাবু।
নাট্যকার উজ্জ্বল চট্টোপাধ্যায় তৈরি করলেন এক সম্পূর্ণ বৃত্ত ‘এক মঞ্চ এক জীবন’। এক জীবনেই রয়ে যায় সব কিছু।
শোকসভা কখনও হয়ে যায় মহলা কক্ষ, আবার মহলা কক্ষ হয়ে ওঠে নাটকের মঞ্চ, নাটকের মঞ্চ হয়ে ওঠে ব্যাক স্টেজ, থিয়েটার হলের সম্মুখদ্বার, ঘরের অন্দরমহল, লেখার টেবিল, সিনেমার ‘ডিজলভ’ (অনেকটা যেন চোখের সামনে মিলিয়ে যাওয়া বা একে অন্যের সঙ্গে মিশে যাওয়া দৃশ্যপট) নাটকে ব্যবহার করলেন পরিচালক ।
এ নাটক নতুন করে ‘এম্পটি স্পেস’ -এর কথা বলে। বিখ্যাত নাট্য নির্দেশক ইব্রাহিম আলকাজি বলতেন, কুরুক্ষেত্র তৈরি হতে পারে ফাঁকা মঞ্চে শুধু সঞ্জয়ের চোখ দিয়ে।
পরিচালক সৌমিত্র মিত্র তাই করলেন এম্পটি স্পেস—মাঝখানে কিছু ধাপ...বিমূর্ততা... সামনে খালি জায়গা। সেখানেই দক্ষিণেশ্বর, স্টার থিয়েটার...। অভিনেতার অভিনয় আর দর্শকের কল্পনায় মঞ্চ ফাঁকা, নয়তো ভরাট হয়।
উজ্জ্বলবাবু ও সৌমিত্রবাবুর জুটি সফল। এটি তাঁদের তিন নম্বর যৌথ কাজ।
এর আগে ওঁরা ইতিহাস-নির্ভর থিয়েটার করেছিলেন ‘অ্যান্টনি সৌদামিনী’। সে ছিল সময়কে ফিরিয়ে আনা, শিকড়কে চেনা, চিনিয়ে দেওয়ার কাহিনি। এ নাটকও আবার তাই করল।
মঞ্চের দৈর্ঘ্য-প্রস্থ বিচার করে ‘রবীন্দ্রসদন’ মঞ্চকে নাট্যমহলে বলা হয় ‘দিঘি’, ‘সমুদ্র’, ।
অথচ, দেবশঙ্কর হালদার (গিরিশচন্দ্র) এমন ভাবে মঞ্চটিকে ব্যবহার করলেন, তাঁর হাঁটায় চলায়, ওই সুবৃহৎ মঞ্চটি যেন নিমেষে আয়ত্তে চলে এল। যেখানে গিরিশ চন্দ্র মিনার্ভা, স্টার, ক্লাসিক, এমারেন্ড, ন্যাশনাল— একটার পর একটা থিয়েটারের কথা বলছেন আর মঞ্চ জুড়ে পাক খাচ্ছেন, কেমন যেন ঘোর লাগা অনুভূতি তৈরি হয়। অবিশ্বাস্য!
আমার জন্ম এতটাই পরে যে, আমি অনেক প্রবাদপ্রতিম অভিনেতাদের মঞ্চে দেখতে পাইনি। আক্ষেপ ছিল। কিন্তু এখন আর আক্ষেপ করি না। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে অন্তত বলতে পারব, আমি দেবশঙ্কর হালদারকে দেখেছি। ওঁর গিরিশের অভিনয়ে।
স্টেজের সামনের থেকে দেখতে পাচ্ছি গিরিশের চোখের জল চিকচিক করছে। উনি নাট্যাচার্যের মতো পোশাক পরেছেন। উনি অভিনয় শেখাচ্ছেন বিনোদিনীকে, তারাসুন্দরীকে। উনি দেবশঙ্কর, আবার উনিই গিরিশ। গিরিশবেশী বিভিন্ন আঙ্গিকে।
সচীন তেন্ডুলকর-বিরাট কোহালি টিমে থাকার ভাল দিক যেমন আছে, তার একটা অন্য দিকও থাকে।
যখন দল তােদর প্রতি বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। ইদানীং দেবশঙ্কর-নির্ভরতায় বাকি অভিনেতাদের অভিব্যক্তি খানিকটা – ‘উনি তো আছেন – ভাল হলেও উনি খারাপ হলেও উনি’। পরিচালকদের এ নিয়ে ভাবার সময় এসেছে।
ইতিহাস-নির্ভর হলেও এ নাটক ভীষণভাবে আজকের নাটক। আজকের কথা বলে।
যখন প্রতাপচাঁদ গিরিশকে বলেন, “কোন সিট কী দামে বিকাবে এই সব হিসাব আপনার... মানে... আমার মুনাফার পিছনের কারিগর আপনি...” কিংবা গিরিশচন্দ্র যখন ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ (প্রদীপ হাইত)-কে বলেন – “মধ্যবিত্ত সমাজ থিয়েটার দেখে হাততালি দেবে... কিন্তু রঙ্গালয়ের মালিক হবে অবাঙালি জহরত বিক্রেতা... থিয়েটারে লোকশিক্ষে হয় কিন্তু লোকসমাগম না হলে কার কাছে ডায়লগ কপচাবো ?...”। —নিজে বাংলা সিনেমা জগতের সঙ্গে যুক্ত, তাই মর্মে মর্মে অনুধাবন করছি এই কথার সত্যতা।
প্রতি নাটকে কিছু দৃশ্য থাকে, এক অর্থে আইটেম সিন। এ নাটকে তা গিরিশ ও শ্রীরামকৃষ্ণের ষোলোআনা দৃশ্যটি।
অনেক দিন বাদে এমন ‘শ্রীরামকৃষ্ণ’ দেখলাম, যাকে বিশ্বাস করলাম। আমার পাশে বসা সাধুমহারাজও হাততালি দিলেন, একবার নয় বারবার।
‘পটলকুমার’ আর ‘ভুতু’-র জনপ্রিয়তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাংলা নাটকে অভিনেত্রী পাওয়া এখন একটু মুশকিলের। এ নাটকে সে স্বাদ কিছুটা পূরণ হয়। মধ্যান্তরের সময় বিনোদিনীর (ঝুলন ভট্টাচার্য) ‘জুড়াইতে চাই... কোথায় জুড়াই...’- মন ভরে যায়।
এ নাটক যেখানে শেষ সেখান থেকেই যেন এর শুরু।
যখন গিরিশ চন্দ্র বলেন – “আমার জীবনে যেন যতি না পড়ে ঠাকুর....।”
‘এক মঞ্চ এক জীবন’ও এমন একটি নাটক, যাতে কোনও যতি নেই, কোনও দাঁড়ি নেই। নিরবচ্ছিন্ন, নিরন্তর আবেগ, ইতিহাসের নিগড়ে সমকালেরও কিছু বোধ, কিছু সম্পর্কের ধারাপাত যেন এই কাহিনি। বাংলা নাটকের এক গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ হয়ে থাকবে এই শিল্পসৃষ্টি।
পুনশ্চ: আমি সমালোচক নই। নাট্য সমালোচনা করা আমার কাজ নয়। একান্ত ব্যক্তিগত অনুভূতির কথাই এই লেখা
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy