রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে অন্য গীতিকারদের যে সব গান ব্রহ্মসঙ্গীত হিসেবে রচিত হয়েছে সেগুলিকে ব্রহ্মসাধনার গান বা ঈশ্বরভক্তির গান হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। যে গানগুলিতে ঈশ্বরের অস্পষ্ট অস্তিত্ব আছে সে রকমই কিছু গান নির্বাচিত হয়েছিল প্রয়াত সুচিত্রা মিত্রের জন্মদিনের সন্ধ্যায় আইসিসিআর প্রেক্ষাগৃহে রবিতীর্থ প্রাক্তনীর আয়োজনে। ব্রহ্মধর্মের তৃতীয় পর্বে আছে ঈশ্বরচিন্তা আর চতুর্থ পর্বে প্রার্থনা। দ্বিতীয় পর্বে আরাধনা। তাই বোধহয় রবিতীর্থ প্রাক্তনীর এই নির্বাচন। রামমোহনের কাল থেকে রবীন্দ্রনাথের যুগ পর্যন্ত অগণিত ব্রহ্মসঙ্গীত বাংলার গানের জগতে ঠাঁই করে নিয়েছে যেগুলি বর্তমানে প্রায় অশ্রুতই থাকে। অনুষ্ঠানের পরিচালনায় ছিলেন অগ্নিভ বন্দ্যোপাধ্যায় ও প্রমিতা মল্লিক। পনেরো জন সঙ্গীত রচয়িতার গান ছিল এই সংকলনে। প্রমিতা ও অগ্নিভর কণ্ঠে একক গানগুলি ব্যতীত সবগুলি গানই ছিল সম্মেলক। সন্ধ্যাটির শুরু হয় ‘কোন শুভক্ষণে উদিবে নয়নে’ রবীন্দ্রসঙ্গীতের মাধ্যমে।
যে দেবতা অগ্নিতে জলে তাঁকে নমস্কার জানালেন প্রমিতা ‘ওঁ পিতা নোহসি, পিতা নো বোধি’ বৈদিক স্তোত্র উচ্চারণের মাধ্যমে। এর পরেই গীত হল সম্মেলক কণ্ঠে সাহনা রাগে ধামার তালে নিবদ্ধ রামমোহন রায় বিরচিত ‘ভয় করিলে যাঁরে না থাকে অন্যের ভয়’। প্রমিতার কণ্ঠে এ দিন যে গানগুলি শোনা গেছে তার প্রত্যেকটিতে ছিল তাঁর বাণী উচ্চারণ, ছন্দের সৌন্দর্য এবং গানগুলিতে সত্যিই তিনি আনন্দঘন মুহূর্ত রচনা করতে পেরেছিলেন। সিন্ধু রাগে তেওড়া তালে নিবদ্ধ ‘নিভৃত অন্তর মাঝে আছে দেবালয়’, ‘এসেছে ব্রহ্মনামের তরণী’ (রচয়িতা মনোরঞ্জন গুহ), ‘প্রাণারাম প্রাণারাম’ (রচয়িতা মনোমোহন চক্রবর্তী)। তাঁর প্রপিতামহ দুর্গানাথ রায় রচিত বেহাগ রাগাশ্রিত ও একতালে নিবদ্ধ ‘আমি হে তোমার কৃপার ভিখারি’, হরিনাথ মজুমদারের প্রেমরসে পরিপূর্ণ ভক্তিরসের গান ‘যদি ডাকার মতোন পারিতাম ডাকিতে’ গানগুলি যেমন কণ্ঠস্বর ও গভীরতা দাবি করে, প্রমিতার গানের মধ্যে তার সবটুকু পেয়ে যাই। অগ্নিভর কণ্ঠে এমন চমৎকার গান অনেক দিন পরে শোনা গেল। বড় দরদ দিয়ে গানের দীপ্তি ছড়িয়ে দিলেন অপার আনন্দে। সারঙ্গ রাগে ঝাঁপতালে বলেন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনা ‘অসীম রহস্য মাঝে কে তুমি মহিমাময়’ গানটি তিনি শোনালেন বহু যত্ন করে। উচ্চারণের গভীরতায় গানের কথাগুলি যেন প্রার্থনা হয়ে উঠল। স্বামী বিবেকানন্দের প্রিয় গান ছিল ‘মন চল নিজ নিকেতনে’। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনা দেশ রাগে আধারিত ‘পরিপূর্ণমানন্দং’ আজও শান্তিনিকেতনের ছাতিমতলায় যা নিয়মিত উপাসনায় গীত হয় সেই গানের মাধ্যমে পরিপূর্ণ আনন্দই দিয়ে গেলেন অগ্নিভ।
মৃত্যুকেও হার মানায়
‘নূরলদীনের সারাজীবন’ নাটকটি দেখলেন মনসিজ মজুমদার
কল্যাণী নাট্যচর্চা কেন্দ্রের ‘নূরলদীনের সারাজীবন’ (নাটক: সৈয়দ শামসুল হক, পরি: কিশোর সেনগুপ্ত) ইদানীংকালের অন্যতম উল্লেখযোগ্য প্রযোজনা। বেশ কয়েক বছর আগে ঢাকা থিয়েটার কলকাতায় এই নাটক করে কলকাতার দর্শকদের মুগ্ধ করেছিল। এই প্রযোজনায় মঞ্চ, আলো, দৃশ্যরচনা, সমবেত ও একক অভিনয়, গান, আবহসঙ্গীত— সব কিছুর সুষ্ঠু প্রয়োগ তাৎপর্যপূর্ণ। সেই পূর্ণাঙ্গ নাটকীয় অভিঘাতে ইতিহাস-বিস্মৃত এক ক্ষণস্থায়ী বিপ্লবী অভ্যুত্থানের কাহিনি এই প্রতিরোধহীন নিশ্চেষ্ট সময়েও দর্শকদের এক প্রতিবাদী মূল্যবোধে উদ্দীপ্ত করে। ইতিহাসনিষ্ঠ এই বিপ্লবের নায়ক কৃষক যুবা নূরলদীন ব্রিটিশ ও তাদের নিযুক্ত রাজস্ব-আদায়কারী জমিদারের নির্মম অত্যাচারের বিরুদ্ধে সংগঠিত করে জাতিধর্ম নির্বিশেষে সর্বরিক্ত মানুষদের।
মঞ্চের পরিসরে জনসাধারণের সংগ্রামী প্রয়াস ও ব্যাপক উদ্দীপনার সামগ্রিক ব্যঞ্জনার সঙ্গে পক্ষে-বিপক্ষের প্রতিটি চরিত্রের সুস্পষ্ট নাটকীয় ব্যক্তিত্বের দ্বান্দ্বিক অভিঘাতে প্রযোজনা সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। এই অভিঘাত নাটকের শুরুতেই, যখন জনগণের কোরাস দ্বিধাবিভক্ত নূরলদীন জীবিত না মৃত এই প্রশ্নে। কিন্তু শহিদ নূরুলদীন যে মরে না এমন অভিঘাতেই নাটক শেষ হয়। কৃতিত্ব অনেকটাই কিশোর সেনগুপ্তের নির্ভেজাল দেশজ নায়ক নূরলদীনের, যার সহজাত বিপ্লবী চেতনা ও নিঃস্বার্থ সংগ্রামকে আধুনিক রাজনৈতিক ধারণায় চিহ্নিত করা যায় না। অভ্যুত্থান ছিল সাধারণ মানুষের, নাটকে সুসংবদ্ধ মঞ্চচারণায় ও সুদক্ষ দেহাভিনয়ে এই ভূমিকা সফল করেছে কোরাস। কোরাস ছাড়া সংগ্রামের পক্ষে-বিপক্ষে যে চরিত্রগুলি নাটকের দ্বান্দ্বিক আবহকে তীব্র মাত্রা দেয় তাদের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য সংগ্রামের সাফল্যে সন্দিহান নূরলদীনের বন্ধু অনিরুদ্ধ বিশ্বাসের আব্বাস। স্বামীর আদর্শ সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ মধুলেখা দত্তের আম্বিয়া। আর প্রতিপক্ষ কোম্পানির সাহেবদের মধ্যে কিশোর সেনগুপ্তের ম্যাকডোনাল্ড, অতনু সরকারের মরিস ও উত্তম ঘোষের টমসন। প্রযোজনার সাফল্যের অন্যতম কারণ অবশ্যই অভিনয়যোগ্য শক্তিশালী কাব্যনাট্য এবং সুষ্ঠু পরিচ্ছন্ন পরিচালনা।
বাঘ ও মানুষের একাকিত্ব
‘রিং মাস্টার’ নাটকটি দেখলেন পিয়ালী দাস
দক্ষিণ রুচিরঙ্গ-র প্রযোজনায় মঞ্চস্থ হল ‘রিং মাস্টার’ নাটকটি। নাটক ও নির্দেশনায় রজতেন্দ্র মুখোপাধ্যায়। গল্পে মূলত সার্কাসে খেলা দেখানো একটি বাঘ ‘রয়’ এবং বদরাগি রিং মাস্টারের কথা উঠে এলেও নাটকটি বহিমাত্রিক। এখন বাঘেদের অস্তিত্ব প্রায় বিপন্ন। মানুষের ভালবাসাও যেন হারিয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। এই দুই বিপন্নতার সুন্দর যোগসূত্র রচনা করেছেন নির্দেশক। পশু এবং মানুষের সম্পর্কের রসায়ন এ নাটকের সেরা প্রাপ্তি। রোহন ফ্রান্সিস সার্কাসের জনপ্রিয় রিং মাস্টার। সুন্দরবন থেকে আনা বাঘ ‘রয়’ একদিন ফায়ার রিং-এর মধ্য দিয়ে লাফিয়ে যেতে অস্বীকার করে। রাগে রোহন তার রাতের খাওয়া বন্ধ করে দেয়। রোহনের স্ত্রী যে এক সময় এই সার্কাসেই খেলা দেখাত, লুকিয়ে নিজের খাবারের ভাগ রয়-কে দিতেই অশান্তি শুরু হয় সংসারে। এ দিকে নিঃসঙ্গ রয় এবং দুঃখে একাকিত্বে থাকা নন্দিনীর মধ্যে অসম বন্ধুত্বের সম্পর্ক তৈরি হয়। রয় খাঁচা থেকে বেরিয়ে এসে নন্দিনীকে তার ফেলে আসা জীবনের কথা, সঙ্গিনীর কথা এবং বনবিবির পালার কথা বলতে থাকে। নাচে, গানে, কথায় মন ভরিয়ে দেয় নন্দিনীর। এই পর্বে সুন্দর স্বপ্নদৃশ্য রচিত হয় নাটকে। জীবিকার জন্য, প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে গিয়ে রোহন হারিয়ে ফেলেছিল তার ভেতরের মানুষটিকে। পুনরায় সে নিজেকে আবিষ্কার করে। রয় এবং রোহনের দ্বৈত চরিত্রে অনবদ্য রাহুল সেনগুপ্ত। নন্দিনী শ্রীজাতা ভট্টাচার্য যথাযথ।
বন্ধু তোকে
বাসবদত্তা মজুমদারের পরিচালনায় স্বরক্ষেপণ আয়োজিত আবৃত্তিসন্ধ্যার সূচনা হয় আদ্যাস্তোত্র দিয়ে। এর পর ছোটদের মধ্যে আয়ুষ চৌধুরির আবৃত্তি ‘রবিঠাকুর’ এক অন্য মাত্রা এনে দেয়। এ ছাড়াও আবৃত্তিতে ছিলেন পিয়ালী বসু বিশ্বাস, সেরা দে, চন্দ্রা চট্টোপাধ্যায়, সায়ন্তনী ধর, রঞ্জনা মুখোপাধ্যায় প্রমুখ। বাসবদত্তার কবিতা সংকলন ‘বন্ধু তোকে’ সুন্দর উপস্থাপনা। অনুষ্ঠান শেষ হয় ছোটদের কবিতার কোলাজ ‘ছুটি ছুটি’ দিয়ে। সঞ্চালনায় চন্দ্রমৌলি বন্দ্যোপাধ্যায় এবং আবহে সিতাংশু মজুমদার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy