চারমূর্তি কার্টুন: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য
পানের দোকানের ছেলেটি বলল, ‘‘এ দিক দিয়ে সোজা চলে যান, পটলডাঙায় পৌঁছে যাবেন।’’
আমহার্স্ট স্ট্রিট আর হ্যারিসন রোডের জংশনের ফুটপাতে দাঁড়িয়ে চোখ মেললাম একটি মিলিয়ে যাওয়া আলো আবছা গলিতে।
হেমন্তের দুপুরবেলায় এসে পড়েছি টেনিদা, প্যালা, হাবুল ক্যাবলা আর বহু জনের কৈশোরকে খুঁজতে।
গলিতে পা বাড়িয়েই এক অদ্ভুত রোমাঞ্চে গা ছমছম করে উঠল। এখানেই সেই চাটুজ্জেদের রোয়াক, ২০ নম্বর পটলডাঙার স্ট্রিট আর ডি লা গ্র্যান্ডি মেফিস্টোফিলিস ইয়াক ইয়াক বলে হুল্লোড়।
নির্জন গলিটা সরু হতে হতে শেষে এত সরু হয়ে গেল যে পাশাপাশি দু’জন একসঙ্গে হাঁটার উপায় নেই।
একজনকে দেখতে পেয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘‘২০ নম্বরটা কোথায় একটু বলবেন?’’
‘‘এই তো এইটাই ২০।’’
বলে আমার বুক ঘষে চলে গেলেন তিনি। ওই সরু গলির পেটে আরও সরু একটি গলি।
ঢুকলাম সে গলিতে। উত্তেজনায় বুক ঢিপঢিপ করছে। এই সেই বাড়ি! এই বাড়িতেই থাকতেন নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়! থাকতেন আসল টেনিদা।
হ্যাঁ টেনিদাই ডাকনাম ছিল নারায়ণবাবুর বাড়িওয়ালা প্রভাত মুখোপাধ্যায়ের।
কিন্তু কার সঙ্গে কথা বলি? সেই ২০ আর ২০ এ মুখোমুখি দুটি বাড়ির নীচের তলায় টেক্সট বইয়ের গোডাউন আর অন্য একটি অফিস।
গোডাউনের সামনে দাঁড়িয়েছিলেন এক মাঝবয়েসি ভদ্রলোক। শঙ্কর দাশ। ব্যস্ত ছিলেন বই গোছাতে। আমাকে ইতিউতি তাকাতে দেখে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘‘কাউকে খুঁজছেন?’’
মুখ ফস্কে বেরিয়ে গেল, ‘‘হুঁ, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়...।’’
‘‘কী! তিনি তো...।’’
‘‘না না তিনি যে নেই জানি। মানে ওই প্রভাত মুখোপাধ্যায়ের বাড়িটা...।’’
প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায় ছবি: শ্যামল চক্রবর্তী
‘‘বুঝেছি। রিপোর্ট করতে এসেছেন? টেনিদাকে নিয়ে? কেউ নেই এখানে। আর কেউ থাকেন না।’’
‘‘কেউ না?’’
‘‘নাহ...। প্রভাতবাবু মানে টেনিদা মারা গেলেন বোধহয় ২০০৩ সালে, তারপর ওর স্ত্রীও মারা গেলেন, ওর ছেলেও চলে গেলেন এই বাড়ি ছেড়ে দিয়ে।’’
‘‘আপনি দেখেছেন নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়কে?’’
‘‘না, আমি কাউকেই দেখিনি। তবে শুনেছি এই ২০ নম্বরের দোতলায় থাকতেন প্রভাতবাবু আর এই উল্টোদিকের ২০এ তে থাকতেন ওই লেখক নারায়ণবাবু। দোতলায়। এই যে গলির ভেতর তিনটে বাড়ি দেখছেন ২০, ২০এ আর ২০বি— এই তিনটেই প্রভাতবাবুদের বাড়ি। যৌথ পরিবার ছিল ওঁর। সবাই ছেড়ে চলে গেছেন।’’
‘‘আচ্ছা এই গলিতে পুরনো কেউ আছেন যার কাছে কিছু জানতে পারি?’’
‘‘নাহ, এখন শুধু গলিটাই পুরনো রয়ে গেছে মানুষরা সব নতুন।
‘‘ঘরগুলো?’’
‘‘পুরো রিমডেলিং করা হয়েছে। আর কিছুই বুঝতে পারবেন না।’’
‘‘আচ্ছা আঠেরো নাম্বারটা কোন দিকে বলবেন? চাটুজ্জেদের রোয়াক? যেখানে টেনিদারা আড্ডা দিত।’’
‘‘১৮ নম্বরটা এই বেরিয়েই বাঁদিকে পাবেন। ওটা চাটুজ্জেদের রোয়াক নয়, মুখার্জিদের।’’
‘‘হ্যাঁ। নামটা নারায়ণবাবু বদলে দিয়েছিলেন। রোয়াকটা আছে?’’
আবার সেই ঠোঁট ওল্টালেন ভদ্রলোক। বললেন, ‘‘বাঁ দিকে গেলে একটা বাড়ির সামনে লোহার খাঁচামতো রয়েছে দেখবেন, ওটাই রোয়াক।’’
লোহার খাঁচায় রোয়াক!
‘‘রোয়াক আর নেই?’’
‘‘নাহ। ভেঙে দেওয়া হয়েছে অনেকদিন আগেই। ওই বাড়িতেও কাউকে পাবেন না।’’
সেই গলি থেকে বেরিয়ে বাঁ দিকে দু’কদম যেতেই একটি বাড়ির সামনেটা অদ্ভুতভাবে লোহার খাঁচা দিয়ে ঢাকা। দরজা রয়েছে। কিন্তু রোয়াক নেই।
‘‘কেউ আছেন?’’
জিজ্ঞাসা করতে দরজার ভেতরের অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এল বছর কুড়ির একটি ছেলে।
‘‘কী ব্যাপার বলুন?’’
‘‘ক্যাবলা আছে?’’
‘‘কে?’’
‘‘হাবুল?’’
‘‘এখানে ওই সব নামে কেউ থাকে না।’’ বিরক্ত ছেলেটি।
‘‘তুমি কে?’’
‘‘আমি শফিক লস্কর। এখানে কাজ করি।’’
‘‘এই বাড়িতে পুরনো কেউ আছেন, যাঁর সঙ্গে কথা বলতে পারি?’’
‘‘না না কেউ নেই। ভেতরে কয়েকটা অফিস রয়েছে।’’
‘‘তুমি প্যালারাম, ক্যাবলা, হাবুল সেনদের নাম শোনোনি? ওরা কিন্তু এইখানে একটা রোয়াক ছিল, সেখানেই বসত। আর খুব আড্ডা দিত।’’
‘‘আমি রোয়াকটা দেখেছি দাদা আর এখানে ঐতিহাসিক কিছু একটা ঘটেছিল সেটাও শুনেছি কিন্তু এর বেশি কিছু জানি না। বাইরে থেকে এসে কাজ করে চলে যাই।’’
ঐতিহাসিকই বটে!
‘‘রোয়াকটা কেন ভাঙল শফিক? কেউ কিছু বলতে পারে?’’
‘‘পাশের এই ১৭ নম্বরে চলে যান। এই বাড়িতে একজন পুরনো লোক আছেন, উনি হয়তো কিছু বলতে পারবেন।’’
পাওয়া গেল পুরনো একজনকে। প্রদীপ মৈত্র। ১৭ নম্বর পটলডাঙার বহু দিনের পুরনো বাসিন্দা।
‘‘আপনি চিনতেন টেনিদাকে?’’
‘‘চিনতাম মানে? অবশ্যই চিনতাম। এখানকার সবাই ওকে চিনত। ইয়া লম্বা আর তেমনি রোগা। এইরকম খাঁড়ার মতো নাক। বেজায় রসিক মানুষ ছিলেন। এই এলাকায় খুব জনপ্রিয়।’’
অবশেষে এ পাড়ার একজনকে পাওয়া গেল, যিনি নাকি স্বচক্ষে টেনিদাকে দেখেছেন! দেখেছেন নারায়ণবাবুকেও।
‘‘তবে কি জানেন আমার বয়স তখন খুব বেশি নয়। বারো- তেরো হবে। ফলে নারায়ণবাবু কী লেভেলের মানুষ সেটা বোঝার উপায় ছিল না। তবে বাড়ির বড়দের কাছে মাঝেমাঝে শুনতাম আর এই গলি দিয়ে অমুকবাবু গেছেন। আজ তমুকবাবু এসেছিলেন নারায়ণদার বাড়িতে। একবারের কথা মনে পড়ে, আমার বাড়িতে তখন যৌথ পরিবার, ভাইবোনরা মিলে ঠিক করলাম নারায়ণবাবুর ভাড়াটে চাই নাটকটি করব। তো এই যে বৈঠকখানার ঘরটি দেখছেন? ঠিক এর ভেতরের ঘরেই নাটকটি করেছিলাম আমরা। তো, আমরা যে এই নাটক করব সেটা কীভাবে যেন কানে গেছিল নারায়ণবাবুর। নাটক চলাকালীন উনি সোজা চলে এসেছিলেন দেখতে। পুরো নাটক দেখে খুব খুশি হয়েছিলেন।
‘‘আর কী মনে পড়ে?’’
‘‘আর? টেনিদার ব্যাপারই ছিল আলাদা। ওই যে ১৮ নম্বরে লোহার খাঁচা দেওয়া জায়গাটা দেখলেন ওখানে লম্বামতো একটা বসার জায়গা ছিল। আমরা বন্ধুরা মিলে সবাই ক্রিকেট খেলতাম। টেনিদাও আসতেন মাঝেমাঝে। গায়ে একটা হাফহাতা গেঞ্জি আর লুঙ্গি পরে। খুব হাসাতেন আমাদের। কাঁধে হাত দিয়ে খুব মজার মজার গল্প বলতেন বানিয়ে।’’
‘‘কী কাজ করতেন উনি?’’
‘‘ওঁদের নিজস্ব ব্যবসা ছিল, ছাপাখানার। ওঁদের বাড়িতে সত্যজিৎ রায়ও আসতেন কাজে। নকশাল আন্দোলনের সময়েও এই গলি ছিল কুখ্যাত।’’
ওঁর কথায় মনে পড়ে যাচ্ছিল টেনিদার জীবদ্দশায় আনন্দবাজার-এ প্রকাশিত একটি সাক্ষাৎকারের কথা।
টেনিদা মানে প্রভাতবাবুর স্ত্রী বাসন্তীদেবী বলেছিলেন, ‘‘নারায়ণবাবু আর ওঁর স্ত্রী আশাদেবীর সঙ্গে আমাদের সম্পর্কটা একেবারেই ভাড়াটে বাড়িওয়ালার ছিল না , একেবারেই পারিবারিক সম্পর্ক হয়ে গেছিল।
নারায়ণদা আর আমার কর্তা মিলে এক এক দিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা দেদার আড্ডা দিতেন। কখনও ১৮ নম্বর বাড়ির রোয়াকে, তো কখনও আমাদের বাড়ির ছাদে।
আর দুজনেই রসিক মানুষ হওয়ায় যা হয়। দারুণ মজার মজার সব গল্প। পাড়ার অন্যরাও জুটে যেত সেই আড্ডায়। সঙ্গে চলত রাশি রাশি চপ-কাটলেট, কুলপি বরফ, ঘুগনি, চানাচুর। আমার আর আশাদির কাজ ছিল পালা করে একের পর এক চায়ের কাপ জুগিয়ে যাওয়া।’’
আড্ডা মারতে মারতেই নিজের গল্পের খোরাক জুটিয়ে ফেলতেন নারায়ণবাবু।
একবার আড্ডা দিতে দিতে প্রভাতবাবু নারায়ণবাবুকে বললেন, ‘‘জানেন দাদা, আমি এই টিংটিঙে চেহারাতেও একবার বিশাল চ্যাং ঘুড়ি উড়িয়েছিলাম।’’
নারায়ণ সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন, ‘‘তারপর আপনিও ওই ঘুড়ির সঙ্গে উড়ে গেলেন তো?’’
বলেই সবাই মিলে হাসি।
আর ওই আড্ডা থেকেই নারায়ণ লিখে ফেললেন ‘ঢাউস’ নামের গল্প।
আপনাকে নিয়ে এমন হাস্যকর একটা চরিত্র তৈরি করায় বাস্তবের আপনাকে কখনও বিড়ম্বনায় পড়তে হয়নি?
সেই প্রশ্নের উত্তরে টেনিদা হাসতে হাসতে সেদিন উত্তর দিয়েছিলেন, ‘‘পড়তে হয়নি আবার! খুব হয়েছে। একটা সময়ে শ্বশুরবাড়ি যাওয়াটাই আমার বিড়ম্বনা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। শালাশালিরা এত মজা করত যে তাদের ঠাট্টার চোটে কাহিল হয়ে যেতাম। পরে সয়ে গেছিল। তবে হ্যাঁ খ্যাতির মজাও উপভোগ করেছি ঢের।’’
প্রদীপবাবুকে বললাম, ‘‘টেনিদা নয় হল, হাবুল-ক্যাবলা এই চরিত্রগুলো কি বানানো?’’
‘‘না না ওগুলোও আসল। ওই প্রভাতবাবুরই দু’জন আত্মীয় ছিলেন, একজনের নাম ছিল হাবু আরেকজন ক্যাবলা। একটু তোতলামির দোষ ছিল।’’
আমার আবার মনে পড়ল সেই সাক্ষাৎকারের কথা। বাসন্তীদেবী বলেছিলেন, ‘‘আমার এক দেওরের নাম হাবু। তার সঙ্গে একটা ‘ল’ যোগ করে হাবুলকে তৈরি করেছিলেন নারায়ণদা। আর ক্যাবলাও আমার আরেক দেওরের নাম। তবে বাস্তবের টেনিদার সঙ্গে গল্পের টেনিদার যেমন অনেক মিল ছিল হাবুল ক্যাবলার কিন্তু শুধু নামটুকু ছাড়া আর কোনও মিলই ছিল না।’’
প্রদীপবাবুর সঙ্গে কথা সেরে ফিরছি। হঠাৎ রাস্তায় শফিক লস্কর।
‘‘পেলেন?’’
‘‘হ্যাঁ।’’
শফিক হাসিমুখে চলে গেল। হঠাৎ মনে হল, পাশে কেউ যেন লাফিয়ে উঠল, ‘‘ডি লা গ্র্যান্ডি মেফিস্টোফিলিস।’’
তার পরেই পালটা কারও কারও গলা, ‘‘ইয়াক ইয়াক!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy