বেন্টিঙ্ক স্ট্রিট ধরে লালবাজারের দিকে হাঁটতে হাঁটতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলেন এক অশীতিপর। উলোঝুলো সাদা চুল, কোমরের পাশে ক্যাথিটার।
এক পথচারী এসে ধরে তুললেন। ধরে ধরে এগিয়েও দিচ্ছিলেন। হঠাৎ চোখে পড়তে এগিয়ে এলেন এক তরুণ নাট্যকর্মী, “কোথায় যাচ্ছেন? কী হয়েছে?” চেনামুখ দেখে হাসলেন বৃদ্ধ, বললেন, ‘‘কানের যন্ত্রটা ঠিক কাজ করছে না। দোকানে যাচ্ছি। কিন্তু দোকানটা যে কোথায়? ট্যাক্সি নামিয়ে দিল, আসতে গিয়ে...’’
‘‘উনি রাস্তায় পড়ে গিয়েছিলেন,’’ কথাটা শেষ করলেন পথচারী। তরুণ বললেন, “আচ্ছা, অনেক ধন্যবাদ। আমিই ওঁকে নিয়ে যাচ্ছি।’’ বৃদ্ধ আঁকড়ে ধরলেন চেনা কাঁধ। তরুণ জিজ্ঞেস করলেন, “দোকানের কাছ পর্যন্ত গেলে চিনতে পারবেন তো, তাপসদা?”
তাপসদা। তাপস সেন। পাঁচ দশক ধরে খবরের কাগজের পাতায় কুচি কুচি নাটকের বিজ্ঞাপনে একটা লাইন ছিল প্রায় অবধারিত— ‘আলো: তাপস সেন’। তিনি যে কী, কলকাতার ভিড়ে হোঁচট খেতে থাকা এই নড়বড়ে বৃদ্ধকে দেখে আন্দাজ করা মুশকিল!
প্যারাডাইস কাফে
দেশ সবে স্বাধীন হয়েছে। হাজরা মোড়ের কাছে প্যারাডাইস কাফেয় আড্ডা দিতে আসেন প্রায় কপর্দকহীন কয়েকটি যুবক। স্বপ্নভঙ্গ আর নয়া স্বপ্নের নকশিকাঁথা বোনা হচ্ছে তখন। নিয়মিত আসেন মৃণাল সেন, ঋত্বিক ঘটক, হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়। মাঝেমাঝেই সলিল চৌধুরী, উৎপল দত্ত, বিজন ভট্টাচার্য, বংশী চন্দ্রগুপ্ত, কালী বন্দ্যোপাধ্যায়, নৃপেন গঙ্গোপাধ্যায়। পোক্ত জমি নেই প্রায় কারও পায়ের তলায় এবং প্রায় সকলেই কমিউনিস্ট। নিউ থিয়েটার্সে সম্পাদনার কাজের সুবাদে হৃষীকেশ একা ‘ক্যাপিটালিস্ট’।
সেই হৃষীই একদিন নতুন একটি ছেলেকে নিয়ে এলেন। নিউ থিয়েটার্সে পরিচালক সৌরেন সেনের সহকারী হিসেবে ঢুকেছে, টাকাকড়ি কিছু পায় না। ঋত্বিক দেখেই বললেন, ‘‘আবার অমুক দলের ছেলেটাকে আনলি!’’ এই ‘অমুক দল’ মানে ‘এসইউসিআই’। গোড়ায় তাপস কিছু দিন সেই দলে ভিড়েছিলেন। রাত জেগে পোস্টার সাঁটিয়েছেন, ‘গণদাবী’ বিক্রি করেছেন, গ্রেফতারও হয়েছেন। ঋত্বিক-মৃণালেরা তখন সিপিআই ঘেঁষা। ১৯৫০ সালে সেই ঋত্বিকেরই ‘জ্বালা’ নাটকে প্রথম আলো করলেন তাপস।
আঁধারে সলতে
তবে সেই আলোর গল্পে যাওয়ার আগে সলতে পাকানোরও একটা পর্ব থাকে অবিশ্যি। তাপসের সেই পর্বটা সারা হয়েছিল দিল্লিতে। অসমে পৈতৃক বাড়ি হলেও তাঁর বাবা মতিলাল সেন কর্মসূত্রে চলে এসেছিলেন দিল্লি, ১১ নম্বর সিকন্দর প্লেসে তিন কামরার কোয়ার্টারে। রাইসিনা বেঙ্গলি হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলে আঁকার শিক্ষক প্রতাপ সেনের কাছেই তাপসের শিল্পে হাতেখড়ি। আর ছিলেন শিক্ষক সুশীল রায়চৌধুরীও। দুর্গাপুজো আর সরস্বতী পুজোয় নাটক হত। কিন্তু অভিনয় নয়, বরং যন্ত্রের কলাকৌশল, বিশেষ করে আলো তাপসকে টানছিল।
১৯৪১ সালে ম্যাট্রিকুলেশন দিয়ে দিল্লি পলিটেকনিকে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে ঢুকলেন তাপস। ক’দিন পরে ছেড়েও দিলেন। আলোর যন্ত্রী হিসেবে কিছুটা পরিচিতি হয়ে গিয়েছে তত দিনে। যে নাটকই হয়, ডাক পড়ে, ‘লাইটওয়ালা বাঙ্গালি বাবুকো বুলাও!’ ১৯৪৪ সালে দিল্লিতে ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘের শাখা খোলা হল। তাপস তার প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। সেখানেই মাস্টারমশাই প্রতাপ সেনের সঙ্গে করলেন জীবনের প্রথম নজরকাড়া কাজ— পরশুরামের গল্প নিয়ে ছায়ানাট্য ‘ভুশণ্ডীর মাঠে’।
ইতিমধ্যে চাকরিও জুটে গিয়েছে। নিউ দিল্লি মিউনিসিপ্যাল, আরউইন হাসপাতাল, শেষে দিল্লি ক্যান্টনমেন্টে সিপিডব্লিউডি-র বিজলি বিভাগ। ভাল মাইনে, কিন্তু তাপস হাঁিপয়ে উঠছেন। ১৯৪৫-এর শীত গড়াচ্ছে ’৪৬-এর গ্রীষ্মের দিকে। তখন ক্যান্টনমেন্টে বন্দি আজাদ হিন্দ ফৌজের নেতারা। লালকেল্লায় বিচার চলছে, দেশ জুড়ে উত্তেজনা। তাপস কাছ থেকে দেখছেন জেনারেল মোহন সিং, শাহনওয়াজ খান, গুরবক্স সিং ঢিলোঁদের। রোজই আসছেন জওহরলাল নেহরু। কিন্তু পাড়ায় ফিরে যেই বন্ধুদের কাছে গল্প করেন, তারা হেসে উড়িয়ে দেয়— গুল দেওয়ার আর জায়গা পায় না!
বম্বে টু কলকাতা
ওই ’৪৬ সালেই চাকরি ছেড়ে বম্বে (তখন মুম্বই নয়) চলে গেলেন তাপস। ক্যামেরা আর আলোর কাজ শিখবেন। কাজ দেবে কে? বম্বে টকিজ়ে রোজ হত্যে দেন। যাতায়াতের পয়সা নেই, দোতলা ট্রামের এক দিক দিয়ে ওঠেন, কন্ডাক্টরকে আসতে দেখলে অন্য দিক দিয়ে নেমে যান। একদিন পৃথ্বীরাজ কপূরের নাটক দেখে তাঁর কাছে গিয়ে বললেন, আলো নিয়ে তাঁর কিছু চিন্তা আছে। আধময়লা পাজামা-কুর্তা পরা তরুণটিকে দেখে পৃথ্বীরাজ বললেন, ‘ওটা রাজ (কপূর) দেখছে।’ (বহু বছর পরে পৃথ্বীরাজ যখন আক্ষেপ করছেন, ‘শম্ভু বা উৎপলের মতো আমার একটা তাপস সেন নেই’, এই গল্পটা তাপস তাঁকে মনে করিয়ে দিয়েছিলেন!)
’৪৭-এর শেষে তাপস চলে এলেন কলকাতায়। তাঁর বিশেষ দুর্বলতা ছিল রঙমহলের প্রতি। কেননা নিউ ইয়র্ক থেকে কাজ শিখে এসে সত্যেন্দ্রনাথ ওরফে সতু সেন সেখানে আলো নিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছিলেন, তৈরি করেছিলেন ঘূর্ণায়মান মঞ্চও। কিন্তু সেই দরজা খুলল না।
শুরু হল টিকে থাকার লড়াই। প্রথমে ঠাঁই হয়েছিল হাজরা রোডের মেসে একটা স্যাঁতসেঁতে ঘরে, তাপস বলতেন ‘ডার্করুম’। পরে এস আর দাস রোডে আঁকিয়েদের ‘ক্যালকাটা গ্রুপ’-এর নেতা সুভো ঠাকুরের আস্তানায় জুটলেন বংশী চন্দ্রগুপ্তের সঙ্গে। নৃত্যশিল্পী অনাদিপ্রসাদও তখন সেখানে ঠাঁই নিয়েছেন। কাশ্মীর থেকে আসা বংশী তখনও সত্যজিৎ রায়ের ছবির শিল্প নির্দেশক হননি।
ধারবাকি করে চলছে। খবরের কাগজওয়ালার টাকাও বাকি, রোজ তিনি আসার আগে দুই বন্ধু পালান। একদিন মুখোমুখি পড়ে গেলেন আর তাপস বিশ টাকা ধার চেয়ে বসলেন তাঁর কাছেই! একই অবস্থা মৃণালেরও। মৃণাল আর তাপস পাওনাদারের ভয়ে অলিগলি পালিয়ে বেড়াচ্ছেন, এমনও কম হয়নি। হৃষীকেশ একদিন নিউ থিয়েটার্স থেকে ফেরার সময়ে দেখেন, তাঁদের হরিশ মুখার্জি রোডের বাড়ির রকে তাপস বসে। চোখ কোটরাগত, মুখ ফ্যাকাশে, চুল উস্কোখুস্কো। কী হয়েছে? ‘চারটে পয়সা দিবি, মুড়ি কিনে খাব? দু’দিন পেটে কিছু পড়েনি। জল খেলে বমি হচ্ছে।’
এবং রক্তকরবী
তাপস কলকাতায় আসার আগেই নাটকে নবযুগের সূচনা হয়ে গিয়েছে। ১৯৪৪ সালে বিজন ভট্টাচার্য করে ফেলেছেন ‘নবান্ন’। তাপসের আসল কাজের সূচনা হল তাঁরই ‘নীলদর্পণ’ নাটক দিয়ে। যোগাযোগ হল অমিতাভ চৌধুরী (পরে ‘দেশ’ পত্রিকার সম্পাদক) আর তরুণ রায় (কংগ্রেসপন্থী এবং পরে কলকাতা পুরসভার অল্ডারম্যান) নামে দুই যুবকের সঙ্গে। তরুণের ‘রূপকথা’ নাটকে সাদা ঘষা কাচের গ্লোবের সামনে বাঁশপাতা ঝুলিয়ে তাপস তৈরি করলেন পূর্ণচাঁদের মায়া।
খেলা পুরোদস্তুর শুরু হয়ে গেল!
১৯৪৯ সালে শম্ভু মিত্র গড়লেন বহুরূপী নাট্যদল। তার জন্মলগ্ন থেকে তাপস হাজির। ‘পথিক’, ‘ছেঁড়া তার’, ‘উলুখাগড়া’ পেরিয়ে ১৯৫১ সালে হল ‘চার অধ্যায়’। শহরের ছাদে গোধূলি পার করে নেমে আসা আঁধারে অন্তু আর এলার সিলুয়েট এবং ঘটনা যখন চূড়ান্ত ট্র্যাজেডির দিকে এগোচ্ছে, দূরে-কাছে বাড়ির আলো নিভে নিভে এসে মঞ্চে গাঢ় শ্বাসরোধী আঁধার— নতুন এক ব্যাকরণই রচিত হল যেন!
‘রক্তকরবী’ অভিনয়ের মঞ্চে
‘রক্তকরবী’ করার সময়ে প্রচ্ছদ আঁকিয়ে, এক সময়ে গণনাট্যের ব্যালে স্কোয়াডে থাকা খালেদ চৌধুরীকে মঞ্চ তৈরির দায়িত্ব দিলেন শম্ভু। ১৯৫৪ সালের ১০ মে শিয়ালদহের ইবিআর ম্যানসনে অবতীর্ণ হল রাজা, নন্দিনী, বিশুরা। নাট্যজগৎ মন্ত্রমুগ্ধ!
সেই পঞ্চাশের দশকে রবীন্দ্র সদন-কলামন্দির ছিল না, কলকাতার প্রধান প্রেক্ষাগৃহ নিউ এম্পায়ার। রবিবার বা ছুটির দিন সকালে সেখানেই নাটক। সিনেমার নাইট শো ভাঙার পরে রাত জেগে প্রস্তুতি, সকালে শো। বহুরূপীর ‘রক্তকরবী’ হল। তার পরে ‘ডাকঘর’, ‘পুতুলখেলা’, ‘পাগলা ঘোড়া’... শম্ভুর ভাবনাকে অনুপম সব মঞ্চমায়ায় মূর্ত করে তুললেন খালেদ-তাপস।
কলকল্লোলে
ইতিমধ্যে সেন্ট জেভিয়ার্স থেকে বেরোনো এক তীক্ষ্ণ তরুণের সঙ্গে কফি হাউসে পরিচয় হয়েছিল তাপসের। উৎপল দত্ত। ইংরেজি নাটক করেন, মূলত শেক্সপিয়র। তিনি প্রথম বাংলা নাটক করলেন সরোজ দত্তের অনুবাদে কনস্তানতিন সিমোনভের ‘সাংবাদিক’। শেষ দৃশ্যে রেডিয়োয় নায়ক শুনছে প্রিয় বন্ধুর মৃত্যুর বিবরণ। প্রায়ান্ধকার মঞ্চে রেডিয়োর কাচ চোঁয়ানো আলো ক্রমশ জোরালো হয়ে উঠে আবেগকে তুঙ্গে নিয়ে গেল।
সেই যে তাপস জুড়ে গেলেন উৎপলদের লিটল থিয়েটার গ্রুপের (এলটিজি) সঙ্গে, দীর্ঘ দিন ছিলেন তার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। তিনিই সম্ভবত এক মাত্র মানুষ যিনি শম্ভু আর উৎপলের মতো দুই মহাপ্রতিভার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছিলেন সমান তালে। দু’জনের মত-পথ-পছন্দ আলাদা, তাপসই যেন তাঁদের মধ্যে আলোর সেতু!
মিনার্ভা থিয়েটারে ‘কল্লোল’ দেখতে জনজোয়ার
উৎপলের বিশ্বাস ছিল, ধারাবাহিক ভাবে নাটক করতে হলে সাধারণ রঙ্গালয়েই করতে হবে। সেই স্বপ্ন নিয়ে ১৯৫৯-এ এলটিজি মিনার্ভা অধিগ্রহণ করে। ‘নীচের মহল’, ‘ছায়ানট’, ‘ওথেলো’ মুখ থুবড়ে পড়ল। সে বছরই সপ্তমীতে বিশ্বরূপায় পেশাদার ‘সেতু’ নাটকে মঞ্চে ট্রেন ছুটিয়ে দিলেন তাপস। নায়িকা (তৃপ্তি মিত্র) আত্মহত্যা করবেন বলে লাইনে উঠে দাঁড়িয়েছেন, মঞ্চের পিছন থেকে ছুটে এসে দর্শকের সামনে বাঁক নিয়ে চলে যাচ্ছে ট্রেন। তা দেখতে ভিড় ভেঙে পড়ছে।
এলটিজি-ও বুঝল, রঙ্গালয়ে দর্শক টানতে চোখ ধাঁধানো দৃশ্য চাই। কয়লা খনিতে জল ঢুকে শ্রমিকদের ডুবে মরার ঘটনা নিয়ে উৎপল লিখলেন ‘অঙ্গার’। দলে রবি ঘোষের ভগ্নিপতি আসানসোলে কয়লাখনির অফিসার। তাঁর সাহায্যে খনিতে নেমে খুঁটিনাটি দেখে আসা হল। ৩১ ডিসেম্বর নামল নাটক। মঞ্চে নির্মল গুহরায়ের গড়ে তোলা খনিতে হুহু করে উঠে আসতে থাকা জলে তলিয়ে যাচ্ছেন শ্রমিকেরা, তাপসের আলো আর রবিশঙ্করের বাঁধা বাজনায় দর্শক কাত! রোজই শেষ দৃশ্যে দু’এক জন করে মুচ্ছো যাচ্ছেন।
এর পরে ‘ফেরারী ফৌজ’, ‘তিতাস একটি নদীর নাম’। ১৯৬৪ সালে কমিউনিস্ট পার্টি ভাগ হয়ে জন্ম হল সিপিএমের। আর সেই বছরেই ’৪৬-এর নৌবিদ্রোহ নিয়ে উৎপল করলেন ‘কল্লোল’। তাপসের ডাকে সুরেশ দত্ত নামে পুতুল-নাচিয়ে হিসেবে পরিচিত এক যুবক খাড়া করলেন জাহাজ। তাপসের আলো-আঁধারি গায়ে মেখে সেই কমিউনিস্ট নাটক এমন জ্যান্ত হয়ে উঠল যে, অনেকে ‘গেল গেল’ রব তুললেন। তৎকালীন কংগ্রেস সরকার উৎপলকে গ্রেফতার করল। বসুমতী, যুগান্তর, আনন্দবাজার পত্রিকা বিজ্ঞাপন ছাপা বন্ধ করল। তাপস তখন দলের সভাপতি। তিনি পোস্টার লিখলেন— ‘কল্লোল চলছে চলবে’। কলকাতা ছেয়ে গেল সেই পোস্টারে। শাসকের রক্তচক্ষু সত্ত্বেও মিনার্ভা হাউসফুল!
ইকড়ি মিকড়ি
এত সব আশ্চর্য কাজের জন্য কিন্তু তাপসের কাছে যন্ত্রপাতি বিশেষ কিছুই ছিল না। তিনি যখন কাজ শুরু করেন, আলো যে একটা ব্যাপার, সেই বোধই অনেক নির্দেশক-প্রযোজকের ছিল না। যন্ত্রপাতি প্রায় নেই। কিন্তু তাপস জাদু দেখাচ্ছিলেন জুটিয়ে আনা বনস্পতির টিন, বার্লির কৌটো, বিস্কিটের ভাঙা টিন নিজের মতো পাল্টে নিয়ে। আর কী সব চমক লাগানো নাম সেই সব আলোর— দুধের বালতি, ইকড়ি মিকড়ি, ইঁদুরকল!
‘অঙ্গার’-এ খনির দৃশ্যে জল উঠল কাটা পলিথিনের চাদরে ঢেউ খেলিয়ে! ‘সেতু’তে কৌটোয় বসানো ছোট্ট ব্যাটারিচালিত পাখা ঘুরে হেডলাইট হয়ে কাঁপতে কাঁপতে ছুটে এল, ট্রেন তো ছিলই না! ‘তিতাস’-এ বাঁশের ডগায় ছোট আলো বেঁধে দোল দিলেন তাপস। আর দর্শক দেখল নদীর বুকে নৌকায় দুলছে হ্যারিকেন।
১৯৬৫-তে ডাক পড়ল বম্বেয়। ‘দ্য স্প্লেন্ডার্ড ওয়ান’ নাটকে মঞ্চে পাহাড় ভেঙে পড়ল, জরথ্রুস্ট নদীর উপরে হেঁটে গেলেন। তা দেখতে এমন ভিড় হতে লাগল, বম্বের ইংরেজি নাটক তা কখনও দেখেনি। পরে পৃথ্বী থিয়েটারে ফিরোজ আব্বাস খানের ‘দ্য রয়াল হান্ট অব দ্য সান’ বা ‘মহাত্মা ভার্সাস গাঁধী’তেও তারই পুনরাবৃত্তি।
মঞ্চে জাদু দেখিয়ে তাপস আসলে নাট্যরসের বারোটা বাজাচ্ছেন বলে অভিযোগ ‘সেতু’ বা ‘অঙ্গার’ নাটকের সময় থেকেই উঠছিল। কিন্তু শুধু জাদু নয়, বরং আলোর এবং তার দোসর অন্ধকারের বহুমাত্রিক ব্যবহারে নাটককে গভীরতর দ্যোতনা দেওয়াই ছিল তাপস সেনের আসল চাবিকাঠি। সে গিরিশ কারনাডের ‘তুঘলক’ হোক, ‘ছেঁড়া তার’-এ চালাঘরে রৌদ্রচ্ছায়া বা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘নামজীবন’-এর শুরুতে ভাঙা ঘরের ছাদে চরাচর ভাসানো জ্যোৎস্না।
শম্ভু-উৎপল যুগ পার করেও তাপস অক্লান্ত। থিয়েটার ওয়র্কশপের ‘চাকভাঙা মধু’, ‘মহাকালীর বাচ্চা’, ‘অশ্বত্থামা’, পরে ‘বেলা অবেলার গল্প’। নান্দীকারের ‘ফেরিওয়ালার মৃত্যু’, ‘মেঘনাদবধ কাব্য’। থিয়েট্রনের ‘তপস্বী ও তরঙ্গিনী’। চুপকথার ‘জন্মদিন’। রঙ্গকর্মীর ‘কাশীনামা’। ক্যালকাটা পাপেট থিয়েটারে সুরেশ দত্তের চমকপ্রদ ‘আলাদিন’... নজির অজস্র। ‘মাধব মালঞ্চী কইন্যা’র একরাশ ছবি হাতে বসে বিভাস চক্রবর্তী বলেন, ‘‘আমাদের ‘অশ্বত্থামা’ বা ‘মহাকালীর বাচ্চা’ বিশেষ চলেনি। কিন্তু তাপসদার কাজ অসামান্য। ওঁকে ক’টা টাকাই বা দিতে পেরেছি?’’
নাটকের বাইরে
সত্যি বলতে বাংলা থিয়েটার নয়, তাপসের আয়ের বেশিটাই আসছিল তার বাইরে থেকে। তিনমূর্তি ভবন, সবরমতী আশ্রম, গ্বালিয়র দুর্গ, চুনার দুর্গ, পুরানা কিল্লা, আগরার দেওয়ান-ই-আমে তাঁর করা ‘সন এ লুমিয়ের’। ’৮২-তে দিল্লির সিরি ফোর্ট অডিটোরিয়ামে এশিয়াডের উদ্বোধন। আর ’৮৫ সালে প্যারিসে ভারত উৎসবে তো খোদ আইফেল টাওয়ারই ঝলসে উঠল তাপসের আলোয়! পরে মস্কো, লেনিনগ্রাদ, তাসখন্দেও তা-ই।
নাচের মঞ্চে আলো ফেলার কাজটা তাপস শুরু করেছিলেন সেই চল্লিশের দশকে বালকৃষ্ণ মেননের নৃত্যনাট্যে। পরে অনাদিপ্রসাদের ‘ওমর খৈয়াম’, বৈজয়ন্তীমালার ‘চণ্ডালিকা’। কে নেই তালিকায়— বিরজু মহারাজ, বালা সরস্বতী, মঞ্জুশ্রী ও রঞ্জাবতী চাকী সরকার থেকে মৃণালিনী সারাভাই... এবং হেমা মালিনী!
মূলত এফেক্ট তৈরির জন্য ডাক পড়ছিল সিনেমাতেও। ’৬৯ সালে ভি শান্তারামের ‘জল বিন মছলি নৃত্য বিন বিজলি’। তার পর মৃণালের ‘কলকাতা ৭১’ আর ‘খণ্ডহর’, তপন সিংহের ‘সফেদ হাতি’, অর্ধেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের ‘বাবা তারকনাথ’, প্রফুল্ল রায়ের ‘শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ’, জ্ঞানেশ মুখোপাধ্যায়ের ‘স্বীকারোক্তি’, অপর্ণা সেনের ‘পরমা’।
১৯৭২ সালে এল এশিয়ার শ্রেষ্ঠ ‘লাইট ডিজ়াইনার’-এর স্বীকৃতি। ’৭৪-সালে সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমি পুরস্কার। ১৯৯৩ সালে বিলেতের ব্র্যাডফোর্ডে ফিল্ম, থিয়েটার ও টিভির আলোকশিল্পীদের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে তাপস হাজির করলেন তাঁর দৃশ্য-অভিজ্ঞতা। সাহেবরা অভিভূত। অ্যাসোসিয়েশন অব লাইটিং ডিজ়াইনার্স সাম্মানিক সদস্যপদ দিল। ভারত সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রক করল ‘এমেরিটাস ফেলো’। আগেই পেয়েছিলেন দীনবন্ধু পুরস্কার, শেষ লগ্নে এল কালীদাস সম্মান।
আলো কী?
বহু বছর আগে ব্রহ্মপুত্রের ধারে আঁধার আকাশের প্রান্তে টিমটিম করা এক বিন্দু আলো এক বালকের ভ্রুমধ্যে গেঁথে গিয়েছিল। প্রমথেশ বড়ুয়াদের গৌরীপুর রাজবাড়ির আলো। তাঁদের সেই অবিভক্ত গোয়ালপাড়া জেলার ধুবুড়িতেই ছেলেটার ঠাকুর্দার ভিটে। তার জবানিতে, “ঠাকুর্দা ভাগ্যের অন্বেষণে ঢাকার সোনারং ছেড়ে এসেছিলেন ভারতের পূর্ব প্রান্তে আসামে। ...গদাধর নদীর পাড়ে নিজের বাড়ি করলেন, জায়গাটার নাম ছিল ছাতিয়ানতলা। ...বাবা-মায়ের বিয়ের দশ বছর পরে নতুন ঘরে নতুন শিশু হয়ে এলাম আমি।’’
১৯২৪ সালের ১১ সেপ্টেম্বর। পরের শতকে লোকে দিনটিকে চিনবে ‘নাইন ইলেভেন’ বলে। টুইন টাওয়ার ভাঙার মতো না হলেও সেও মহা দুর্যোগের দিন। প্রচণ্ড ঝড়জল। শিশুটি জন্মেই মরতে বসেছে। তাকে ঘরের চালে অঝোর ধারার মধ্যে শুইয়ে রাখা হল। বেঁচে গেল সে। মা সুবর্ণলতার মুখে তাপস শুনেছেন, যে ছেঁচা বেড়ার ঘরে তিনি জন্মেছিলেন, তাতে কাচের জানালা ছিল আর সামনে ব্রহ্মপুত্র। গভীর রাতে স্টিমার যেত, সার্চলাইটের আলোয় গাছপালা বাড়িঘর মূর্ত হয়ে উঠে ভেসে ভেসে সরে যেত। পরে তিনি নিজেও দেখেছেন। মনে হয়তো বসে ছিল আলোর এই মায়াচলনই।
অথচ বয়স যত গড়িয়েছে, তাপস ক্রমশ ঝুঁকেছেন আলোর মায়া থেকে বৈজ্ঞানিক সত্তার দিকে। ছোটবেলায় যিনি অঙ্কে ভয় পেতেন, বিজ্ঞানের অন্তরে তিনি খুঁজে ফিরছেন ফোটনের স্বরূপ। ১৯৯২ সালে ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর নিবন্ধ পড়ে আন্দাজ করা শক্ত যে, তিনি আলোর কারিগর মাত্র। বিজ্ঞানী বা নিদেনপক্ষে বিজ্ঞান-লিখিয়েও নন। তবু তার পরেও তাপস লিখছেন, “দীর্ঘদিন আলোছায়ার জগতে মানুষের হাসি কান্নার পালায় নাট্য জগতে কাজ করলাম... দেখছি আলোকে জানাই হল না।’’
ইতি কমরেড
এত সাফল্য, তবু শেষ দিকটা ভাল কাটছিল না। বেশ অসুস্থ, ফলে কাজও কমছিল। ঠোঁটকাটা স্বভাব তো ছিলই। সেই সঙ্গে যেচে অন্যের ‘ভাল’ করতে যাওয়ার প্রবণতা আর ক্ষমতাসীনদের মুখের উপরে স্পষ্ট কথা বলাও সকলে ভাল ভাবে নিত না।
১৯৬৭-র নির্বাচনে বিধানসভায় কংগ্রেস ল্যাজে-গোবরে। কিন্তু সরকার গড়ার সুবর্ণসুযোগ পেয়েও বামপন্থীরা দ্বিধাবিভক্ত। বৌবাজার ট্রেড ইউনিয়ন অফিসে জ্যোতি বসুরা বৈঠক করছেন। তাপস সেখানে হাজির হয়ে বললেন, ‘আপনারা যদি মিলিত না হন, কংগ্রেস আবার আসবে।’ তাঁর কথায় কী কাজ হয়েছিল অজানা, কিন্তু পরে দু’পক্ষ একত্রিত হয়ে রাজ্যে প্রথম অকংগ্রেসি সরকার গঠন করে।
বাম জমানাতেও তিনি সেই একই রকম আপসহীন। বিভিন্ন মঞ্চের দুর্দশা ও নাট্যকর্মীদের অবস্থা নিয়ে অসন্তোষ জানিয়ে এবং বহুবিধ প্রস্তাব দিয়ে একের পর এক চিঠি লিখেছেন সরকারের কাছে। কখনও দু’লাইনের উত্তর এসেছে, বেশির ভাগ সময়েই আসেনি। তৎকালীন তথ্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সঙ্গে বিতণ্ডা হয়েছে, খবরের কাগজে খোলা চিঠিও লিখেছেন তাপস।
অগ্নিকাণ্ডে ভস্ম স্টার থিয়েটার ২০০৪ সালে যখন নবকলেবরে ফের খুলল, রবাহুত তাপস সেখানে গিয়ে ঠেলেঠুলে মঞ্চে উঠলেন। মাইক টেনে সটান প্রশ্ন করলেন, ‘স্টার তো খুলল, পুরনো কর্মীদের পাওনাগণ্ডার কী হবে?’ কর্তারা চরম অস্বস্তিতে।
আলোর বাইরে
সময় যায়, অস্বস্তি বাড়ে। সমমনস্ক বন্ধুদের বেশির ভাগেরই ‘এগজ়িট’ হয়ে গিয়েছে, তাপসের ভাষায়। থাকার মধ্যে এক মৃণাল, সকালে উঠেই তাঁকে ফোন করে একটু আড্ডা দিয়ে নেন। ওটুকুই ভাল লাগা। বাকিটা অন্ধকার। ডায়াবেটিস, প্রস্টেট, কানে শোনেন না। স্ত্রী গীতা ঘোরতর অসুস্থ, টানা ভুগছেন মেয়ে জয়ন্তীও। ওষুধের টাকা যাচ্ছে হুহু করে। নতুন আলোকশিল্পীদের মধ্যে অগ্রগণ্য ছেলে জয়। তাপসের কথায়, ‘আমার চেয়েও প্রতিভাবান।’ কিন্তু তিনি বেহিসেবি, সুরাসক্ত। স্ত্রী সুমিত্রা আর ছেলে সৌমিত্রিকে (বটাই) নিয়ে তাঁর সংসার টিকল না। ছেলেকে নিয়ে সুমিত্রা আলাদা হলেন। পরে সংসারে এলেন থিয়েটারের মেয়ে চিত্রলেখা। কিন্তু বছর কয়েক বাদে গলায় দড়ি দিল কিশোর বটাই।
তাপস বিধ্বস্ত। তবু প্রায় রোজই বেরোন, খানিক কাজে আর খানিক অকাজে, মনের খিদে মেটাতে। তাঁর দীর্ঘ দিনের সহকারী গৌতম ঘোষ বলেন, ‘‘হেমা মালিনী নাচের অনুষ্ঠান নিয়ে ওয়ার্ল্ড টুরে গেলেন, খুব চেয়েছিলেন যাতে তাপসদাকে নিয়ে যাওয়া যায়। ডাক্তার মত দিলেন না।’’
২০০৬ সালের ২৮ জুন।
দিন সাতেক আগে বন্ধু জ্ঞানেশ মুখোপাধ্যায়কে শেষ বিদায় জানিয়ে রবীন্দ্র সদন থেকে ২৬ এইচ, নাকতলা লেনের বাড়িতে ফিরেছিলেন তাপস। আর বেরোতে পারেননি। চিত্রলেখার মনে পড়ে, “সন্ধ্যায় জয়, আমি আর মেয়ে সিনেমায় গিয়েছিলাম। বাড়িতে জয়ন্তী ছিল।’’ হাফটাইমের আগে ফোন এল। ফিরে শোনেন, রাত আটটা নাগাদ তাপসকে খাওয়াচ্ছিলেন আয়া। বিষম! জয়ন্তী অ্যাম্বুল্যান্স ডাকেন। হাসপাতালে পৌঁছনোর আগেই শেষ।
জয়-জয়ন্তীও অকালে গত। সেই বাড়িতে রয়ে গিয়েছেন শুধু চিত্রলেখা আর তাঁর মেয়ে রূপমঞ্জরী।
পারাপার
শেষ দিনগুলোয় অশক্ত শরীরে দুই শহরের মাঝে ঝুলে থাকা এক সেতুকে আলোয় সাজিয়ে তুলছিলেন তাপস। সব আঁক কাটা হয়ে গিয়েছিল। আলো বসানোর আগেই বাঁশি বেজে যায়। কাজ শেষ করেন জয়।
রোজ রাত্তিরে কলকাতা থেকে হাওড়ার দিকে যেতে ডেলি প্যাসেঞ্জার চাঁদ দেখে নেয়, নীচে গাঙের জলে ছলছল করছে সেই হাওড়া ব্রিজ।
আশ্চর্য হলুদ, মিঠে বেগুনি!
ছবি পুনরুদ্ধার: জিয়া হক
ঋণ: সুজনেষু তাপস সেন, আশিস গোস্বামী; তথ্যচিত্র: লেট দেয়ার বি লাইট, অসিত বসু; অন্তরঙ্গ আলো, প্রভাতকুমার দাস, বিষ্ণু বসু; ছায়ায় আলোয়, জয়ন্তী সেন, বহুরূপী, নাট্যরঙ্গ পত্রিকা, সোপান নাট্যপত্র, নাট্যশোধ সংস্থান
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy