নাটক ‘অনুসোচনা’য় কৌশিক চট্টোপাধ্যায় (ডানদিকে)
মাঠ-বিদায়ের সময়কার গাওস্করকে মনে পড়ে?
টেস্ট ম্যাচেও প্রথম বল থেকেই রুদ্রমূর্তি। চার-ছয় হামেশাই। কিন্তু একটাও আড়া ব্যাটে নয়। ক্রিকেট ম্যানুয়ালের ‘ক’ থেকে ‘চন্দ্রবিন্দু’ মিলিয়ে দেওয়া ক্লাসিক শট!
আয়ন্দা নাট্যদলের ‘অনুসোচনা’ (পালি ভাষা মেনে বানান এমনই) ঠিক তেমনই যেন!
সময়টা মগধরাজ বিম্বিসার ও তাঁর পুত্র অজাতশত্রুর। তথাগত বুদ্ধ মহানির্বাণের পথে। আজীবন তাঁর বিরুদ্ধাচারণে লিপ্ত যশোধরা-ভ্রাতা দেবদত্ত তখন অনুশোচনায় দগ্ধ। বুদ্ধের সাক্ষাৎপ্রার্থী।
এই মুখড়া নিয়ে যে থিয়েটার, তার অবয়বে যে গুরুগম্ভীর তকমা থাকার কথা, তাকে বেমালুম মাঠের বাইরে উড়িয়ে নাট্যকার ব্রাত্য বসু যে কাহিনির জাল বুনেছেন, তাতে মুহুর্মুহু ঢুকে পড়ল থ্রিলারের ঝড়! গুপ্ত হত্যার ষড়যন্ত্র। সুপারি কিলার। মিসাইলের মতো ধেয়ে আসা বিরাটাকার প্রস্তরখণ্ড...! এই প্রেক্ষাপটে অহিংসা আর তিতিক্ষায় বিশ্বাসী বুদ্ধদেবও যেন বিনির্মাণে হয়ে যান মানব-সদৃশ! মুমূর্ষু ক্ষমাপ্রার্থীর সাক্ষাৎও যিনি প্রত্যাখ্যান করেন অবহেলায়।
প্রাচীনতার দায় মেনে টেক্সট-এ প্রতি মিলিমিটারে তৎসম শব্দ। অথচ কাহিনিতে ঝোড়ো আধুনিকী বাঁক।— ‘অনুসোচনা’র ট্রাম্পকার্ড সেটাই।
সেই প্রান্তবেলার গাওস্করীয় ছাঁচ!
এই থিয়েটারকে আয়ত্তে এনে তাকে মঞ্চে তোলায় যে পরিমাণ ‘ক্র্যাফটম্যানশিপ’ লাগে, তা মজা পুকুরে মাছ ধরার চ্যালেঞ্জকেও পিছিয়ে দেয়। কঠিন এই কাজটি করেছেন নির্দেশক বিপ্লব বন্দ্যোপাধ্যায়। পাহাড়িয়া কুশীনগর তার নাটকের কেন্দ্রস্থল। আলুঢালু পথ। গিরিবর্ত্ম। বিপদসঙ্কুল খাদ। এই ভৌগোলিক বিন্যাসে যেমন স্তরের পর স্তরের ওঠাপড়া, তেমনই কাহিনির গায়ে আছে নানা স্তরের খেলা। কখনও তা সামাজিক। কখনও রাজনৈতিক। কখনও দুয়ে মিলে বিপরীত দুই ক্ষমতার সঙ্ঘাত। বিপ্লবের মুনশিয়ানা এইখানেই যে, এই স্তরীভবনকে মেনে এই থিয়েটারটির গড়ন দেওয়া। কুশীলবের নিরন্তর চলাচল, মঞ্চে তাদের ‘পজিশনিং’, এমন ভাবে চারিয়েছেন তিনি, নাটকের গতি এক মুহূর্ত টাল খায় না।
থিয়েটারে প্রথম সেট করলেন চিত্রকর গৌরাঙ্গ কুইলা। দৈত্যাকার পাহাড়গাত্রের কাট-আউট এ-মাথা, ও-মাথা। একেবারে পিছনে বৌদ্ধিক গং। মঞ্চের সামনে বাঁ ধারে বোধিবৃক্ষ। ডান, বাঁ আর মাঝখানে ফুট-চারেক চওড়া সিঁড়ির মতো। হঠাৎ দেখলে থিম-পুজোর মণ্ডপ-মণ্ডপ লাগে। কিন্তু হলুদ-নীলাভ-লাল নরম আলোর (দেবাশিস) জাদু যখন তার ওপরে চামর বোলায়, বুকের ভেতর আতঙ্কের কামড় বসায় ঘং-ঘং-ঘং শব্দ তোলা সঙ্গীত (দিশারী চক্রবর্তী) পুরো চেহারাটাই বদলে গিয়ে কেমন যেন আধিদৈবিক আকার পেয়ে যায়।
বুদ্ধের ক্ষমতা দেবদত্তের (কৌশিক চট্টোপাধ্যায়) কাছে ঈর্ষার। তার হীনমন্যতা, লালসায় জড়িয়ে মধ্যবিত্তসুলভ আগ্রাসন। এই আগ্রাসনের থাবায় অতীত হামাগুড়ি দেয় সমকালে। সমকাল ভাবীকালের দিকে এগোয় হায়নার ক্ষিপ্রতায়। তখন ইতিহাসের মুখ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে সমকালের তথাকথিত স্বজন।
উচ্চারণে, শরীরী চলনে কিছুটা শম্ভু মিত্রীয় ছাঁচ থাকলেও কৌশিক তাঁর ‘দেবদত্ত’ গড়তে প্রতিটি ধাপে অসম্ভব যত্নশীল। বহু দিন বাদে নান্দীকার ও ব্লাইন্ড অপেরা-র প্রাক্তনী শুভাশিস গঙ্গোপাধ্যায়কে পাওয়া গেল স্বকীয় নিপুণতায়। ক্রূঢ়, ধূর্ত, রক্তারক্তির তুখড় সেনানী ‘সুপারি কিলার’ কোকালিক তাঁর শরীরে যেন বাসা বেঁধে নড়িয়েচড়িয়ে কথা বলিয়ে নিল শুভাশিসকে দিয়ে! পাল্লা দিয়ে ওঁদের সঙ্গে অভিনয়ে চমকে দিলেন কেশব ভট্টাচার্যের ‘অজাতশত্রু’।
এক-দু’জনকে তুলনায় দুর্বল লাগে। বিষয়ের ভার, তৎসম শব্দের গাম্ভীর্য যেন কিছুটা ম্লান তাঁদের সংলাপে। কেউ হয়তো বা শরীরী বিন্যাসে ততটা দড় নন, কেউ অনাবশ্যক উচ্চকিত। তবু প্রযোজনার গড় মান, তার শৈলী এতটাই উঁচু তারে বাঁধা— আর কয়েক শো গড়ালে এই ভ্রান্তিগুলো দূর হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থেকেই যায়। আর সেখানেই ‘মহাকাব্যিক’ হয়ে ওঠার দিকে ঝুঁকতে পারে এই ‘অনুসোচনা’।
সব মিলিয়ে দেখতে হয়, নইলে পিছিয়ে পড়তে হয়!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy