গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর।
মুখ নিচু করে বসে আছেন গগনেন্দ্র। দৃষ্টি উদ্ভ্রান্ত। কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না তাঁর আদরের গুপু আর নেই।
নিয়তি বড় নিষ্ঠুর। কিন্তু সে-ই আবার পরবর্তী সময়ের কক্ষপথের নিয়ন্ত্রা। দুঃসহ শোকের মধ্যে কক্ষপথ লেখা হয়ে গেল গগনেরও।
সার্কুলার রোডের ভূত-ঘর
প্রতি বছর গরম পড়তেই জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি থেকে বেরিয়ে একটা ফাঁকা জায়গায় বাড়ি ভাড়া নেওয়ার চল ছিল। থাকা হত তিন-চার মাস। প্লেগ থেকে বাঁচতে খোলামোলা জায়গায় যাওয়া।
সে বারও ব্যতিক্রম হয়নি।
গগন ঠাকুর সপরিবার উঠে এলেন সার্কুলার রোডের এক বাড়িতে। ওই ক’টা দিন ঠাকুরবাড়ি ঝেড়ে-মুছে, ভাঙাচোরা সারাই করে, দরজা-জানালার বাইরে রঙের পোঁচ পড়বে। কিন্তু নতুন বাড়িতে এক তালাবন্ধ ঘর নিয়ে ছিল রহস্য।
অত বড় বাড়িতে জায়গার অভাব নেই। কিন্তু একটা ঘর তালাবন্ধ। বাড়িওয়ালা বাইরে থাকেন, ভাড়া দেওয়ার আগে পইপই করে বললেন ও ঘর না খুলতে। কারণ জানালেন না। পরে লোকমুখে শোনা গেল, সেই ঘরে নাকি বাড়িওয়ালার ছেলে মারা গিয়েছে। ও ঘরে ভূতের বাস।
এত বলা সত্ত্বেও কেমন করে যেন সে ঘরের তালা খুলে গেল। অবনের মেয়ে-জামাই নেলি আর নির্মল থাকতে এলেন সে বার। গগনের স্ত্রী প্রমোদকুমারী বরাবরই ডাকাবুকো। তাঁর ভয়ডর কম। তিনি দিলেন তালা খুলে। রাতবিরেতে শব্দ শোনা, হাওয়া ছাড়াই বারান্দায় কাপড় ওড়ার মতো ঘটনা ছাড়া ভূতের উপদ্রব তেমন একটা জমল না।
তবে গগনের ছেলে গেহেন্দ্র পড়লেন কঠিন অসুখে। জ্বর দেখে ডাক্তার জানালেন— টাইফয়েড।
সে অসুখ আর সারল না।
সে বার সকলে গ্রীষ্ম ঋতু শেষ হওয়ার আগেই জোড়াসাঁকো ফিরলেন। ফিরলেন না শুধু গেহেন্দ্র।
মুখ কালো করে আঁধার নামল ঠাকুরবাড়িতে। গগনের দিকে চোখ তুলে তাকানো যায় না। বছরখানেক আগেই ধুমধাম করে ষোলো বছরের ছেলের বিয়ে দিয়েছিলেন। নববধূর গা থেকে খসে পড়ল সাধের গয়না।
গেহেন্দ্রনাথের মৃত্যু গগনেন্দ্রনাথকে পাথর করে দিল।
কথকতা থেকে রং-তুলি
দীনেশচন্দ্র সেনের সঙ্গে ঠাকুরবাড়ির অন্তরঙ্গ সম্পর্ক ছিল। তিনি গগন ঠাকুরের দ্বিতীয় পুত্র কনককে পড়াতেন। গগনও তাঁকে ভরসা করতেন।
ও দিকে গেহেন্দ্রশোকে গগন শান্তি পান না। একদিন দীনেশকে ডেকে বললেন, ‘‘এ ভাবে থাকিলে আমি পাগল হইয়া যাইব। আপনি কি বলিতে পারেন কি করিলে আমি শান্তি পাইব?’’ দীনেশচন্দ্র ক্ষেত্র চূড়ামণিকে নিয়ে এলেন ঠাকুরবাড়িতে। গগনকে কথকতা শুনিয়ে তাঁর মন শান্ত করার অভিপ্রায়ে। মৃত্যুশোক ফিকে করে ক্রমশ কথকতা এগোল রামায়ণ থেকে মহাভারত, মহাভারত থেকে ভাগবতের পাতায়। কথকতার আসর যত জমল, গগনের মনের বিষাদকালো জমাট অন্ধকার ততই আলো হয়ে প্রকাশ পেল তাঁর ছবির খাতায়।
গগনেন্দ্র কখন যেন হাতে তুলে নিলেন কাগজ-পেনসিল-কালি। ফুটে উঠল ক্ষেত্র কথকের নানা মুহূর্তের অবয়ব। এর মধ্যে আবার কথকতার একঘেয়েমি কাটাতে রবীন্দ্রনাথ কুষ্টিয়া থেকে পাঠালেন শিবু কীর্তনিয়াকে। জমে উঠল আসর। গগন এঁকে চললেন। কখনও শিবু, কখনও ক্ষেত্র, কখনও ঠাকুর-পরিবারে আশ্রিত বন্ধু ডাকবিভাগের অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী মতিবাবু। বাদ পড়েননি খোদ দীনেশচন্দ্রও। গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিকথায় দীনেশচন্দ্র লিখছেন, ‘‘গগনবাবু উপাখ্যানভাগ ও কীর্তনের ভক্তিরস সকলের সঙ্গে উপভোগ করিতেছিলেন। কিন্তু তাঁহার হাতের পেন্সিলটি একদিনের জন্যও বিরাম পায় না...’’
সন্তানের মৃত্যু দেখার চেয়ে বড় শোক আর হয় না। কিন্তু দিনের শেষে জীবন সত্য। বেঁচে থাকাটুকুই জীবন। সন্তানশোক ভুলে জীবনে ফেরায় গগনের আশ্রয় হল ছবি আঁকা।
গগনেন্দ্রর আঁকা ‘ভোঁদড় বাহাদুর’ বইয়ের প্রচ্ছদ, শিল্পীর আঁকা দিয়ে ‘দেশ’ পুজোসংখ্যা, ১৯৮৬ ও কার্টুন ‘ইম্পেরিশেবল সেক্রেডনেস অফ এ ব্রাহ্মিন’
পাঁচ নম্বর বাড়ি
সেন্ট জ়েভিয়ার্সে পড়ার সময়ে গগনেন্দ্রর ছবি আঁকার হাতেখড়ি। শোনা যায়, সে সময়ে আর পাঁচটা বাড়ির ছেলের মতোই গগন স্কুলে যেতেন। বাবা গুণেন্দ্রনাথের ইচ্ছে ছিল, ছেলে সাধারণের মতো মানুষ হবে। গগনকে তিনি ঠাকুরবাড়ির সব রকমের বিলাসিতা থেকে দূরে রেখেছিলেন।
জোড়াসাঁকোর পাঁচ নম্বর বাড়িতে জন্মেছিলেন গগনেন্দ্র। গুণেন্দ্রনাথের প্রথম সন্তান যখন ছেলে হল, দাই বেশ ভাল রকমের বকশিশ পেলেন। সঙ্গে সোনাদানাও। তবে যখন সতেরো বছর বয়সে গগনের বিয়ে হল প্রমোদকুমারীর সঙ্গে, তখন কোনও ধুম হয়নি। তার মাত্র তিন বছর আগেই যে পিতাকে হারিয়েছেন গগন। উৎসব করতে কারও মন চায়নি।
বালক গগনের উপরে দায়িত্ব পড়ল সংসার দেখভালের। পড়াশোনা আর শেষ করা সম্ভব হয়েছিল কি না, সে প্রসঙ্গ চাপা পড়ে গেল। এক দিকে জমিদারি সামলানো, অন্য দিকে বিধবা মা সৌদামিনীর দেখাশোনা, ছোট ভাই-বোনের জন্য অভিভাবকত্ব, পাশাপাশি শিল্পীসত্তার মন-উচাটন।
সব দিক সামলে গগন স্থির করলেন শিল্পী যদি হতেই হয়, সঙ্গীতশিল্পী হবেন। সাহেব মাস্টার রেখে পিয়ানো বাজানো শিখলেন। নিজের ছেলেদের সঙ্গীতশিক্ষায় কোনও ক্রুটি রাখলেন না। যখন-তখন কিনে আনতেন মজার সব বাদ্যযন্ত্র, সুর নিয়ে চলত এক্সপেরিমেন্ট।
তখনও গগন জানেন না কয়েক বছর পরে তাঁর সঙ্গে দেখা হবে জাপানি ব্যক্তিত্ব কাকুসো ওকাকুরার। দেশীয় অঙ্কনশিল্পের ইতিহাসে গগন ঠাকুরের নাম লেখা হয়ে যাবে ব্যতিক্রমী বিশ্বজনীনতায়। নিয়তির এঁকে দেওয়া কক্ষপথ তাঁকে টেনে নিয়ে যাবে ভিনদেশীয় কিউবিক রীতির শিল্পচর্চায়।
শিল্পী যখন এক্সপেরিমেন্টাল
গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আঁকা ‘শুরু’ ব্যঙ্গচিত্র দিয়ে। তার নেপথ্যেও অবশ্য রঙিন গল্প রয়েছে। হাইকোর্টে জুরির কাজে প্রায়শ বসতে হত তাঁকে। বিচারকার্যের নোট নিতেন গগন। হাতে থাকত খাতা-পেনসিল। বিচারকের হাতুড়ি ঠোকা, সওয়াল-জবাব, উকিলের আনাগোনা— সবের মধ্যেই দেখা যেত, গগন মাথা নিচু করে মন দিয়ে নোট নিচ্ছেন। আদতে সে সময়ে তিনি পোর্ট্রেট আকঁতেন। উকিল, বিচারক, শ্রোতাদের চেহারার মধ্য থেকে বেরিয়ে আসত বিভিন্ন চরিত্র।
আর তাঁকে দেখে লোকজন ভাবতেন— আহা! কী মন দিয়েই না কাজ করছেন গগন ঠাকুর!
কাজটা অবশ্য বরাবর মন দিয়েই করতেন তিনি। পরে যখন ব্যঙ্গচিত্রের তিনখানা বই ‘অদ্ভুত লোক’, ‘বিরূপ বজ্র’ আর ‘নব হুল্লোড়’ প্রকাশ করলেন, তাতে এই অগণন পোর্ট্রেট আঁকার অনুশীলন কাজে লেগেছিল।
রবীন্দ্রনাথ আরামকেদারায় বসে আকাশে উড়ে যাচ্ছেন, এ ছবিও এঁকেছেন গগন। তাঁর ব্যঙ্গরেখা নির্মিত পোর্ট্রেটের কোপ থেকে বাদ যাননি জগদীশচন্দ্র বসু, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, মহাত্মা গাঁধী— কেউ-ই।
মাঝে কিছু দিন ফোটোগ্রাফি চর্চা চলল। কিনে আনলেন ক্যামেরা। কালো কাপড়ে মুখ-মাথা ঢেকে, বিরাট স্ট্যান্ডে রেখে চলল ছবি তোলা। এর ফাঁকে তেল রঙেও কিছু ছবি আঁকলেন। জমল না।
কোনও উস্তাদ হাতে ধরে তাঁকে ছবি আঁকা শেখাননি কখনও। তবে গগনের দেখার চোখ ছিল। আর ছিল শিল্পের সূক্ষ্ম বোধ। কখনও সে শিল্পবোধ ধরা দিল তাঁর ব্যঙ্গচিত্রে, কখনও নাটকের মঞ্চসজ্জায়, কখনও পুরী-রাঁচি-দার্জিলিং সিরিজ়ের চিত্রে।
শিল্পীমনের মেঘ-রোদ্দুর
গগনেন্দ্র, অবনীন্দ্র, সমরেন্দ্র। গুণেন্দ্রনাথের তিন ছেলেই ঠাকুরবাড়ির শিল্পময় লগ্নে জন্ম নেন। বাড়ির পরিবেশ, রবিকাকার সান্নিধ্য এ সব তো ছিলই। সঙ্গে ছিল শিল্পভাবনার উৎকৃষ্ট মন। শিল্পভাবনার পাশাপাশি স্ত্রী প্রমোদকুমারীর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সাংসারিক দায়িত্ব পালন করেছেন গগন। প্রমোদও শিল্পভোলা মানুষটিকে প্রশ্রয় দিয়েছেন। দক্ষিণের বারান্দায় বসে দিনের পর দিন যখন ছবি এঁকেছেন গগন, যাবতীয় দায়িত্ব সেরে নিঃশব্দে এসে বসেছেন স্বামীর পাশে, তাঁর আঁকার পাশে। মনঃসংযোগে ব্যাঘাত ঘটাননি।
এক বার বিকেলের দিকে ছবি আঁকতে বসলেন গগন। কখন যেন দক্ষিণের বারান্দা জুড়ে সন্ধে নেমে এসেছে। তিনি ছবির নির্মাণে এতটাই মগ্ন, সে দিকে খেয়াল নেই। কাঠের গোল সিঁড়ি দিয়ে দোতলার বারান্দায় নেমে এলেন প্রমোদকুমারী। অন্ধকারে দু’হাত দূরে কিছু দেখা যায় না— অথচ অন্ধকারে বসে গগনেন্দ্র কী যেন এঁকেই চলেছেন। প্রমোদ অবাক হয়ে জানতে চাইলেন, এই অন্ধকারে তিনি দেখতে পাচ্ছেন কী করে! সে শব্দে গগন চমকে মাথা তুলে তাকান। পরক্ষণেই ছবির দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘‘কই, কিছুই তো দেখতে পাইনি।’’
ছবি ঘিরে ভাব-তন্ময়তায় এক নিজস্ব গণ্ডি তৈরি করে নিয়েছিলেন গগন ঠাকুর। সেখানে গনগনে গ্রীষ্মের রোদ, বাড়ির কচিকাঁচাদের চিৎকার, সূর্যের ঢলে পড়া বা সাংসারিক শোক-তাপ তাঁকে স্পর্শ করত না। সকল শিল্পবিঘ্ন ঘটানোর ষড়যন্ত্র পরাস্ত হত গগনের শিল্পীমনের দুয়ারে এসে।
অবন-গগন পাশাপাশি বসে দক্ষিণের বারান্দায় বহু ছবি এঁকেছেন। সে সব লিখতে বসলে একটা মহাকাব্য রচনা হয়ে যায়। তবে ছবির স্ট্রোকের ঘোরে গগনের সাদা-পাজামায় অবনের তুলি থেকে কালো রং ছেটানোর গল্পটি না বললেই নয়। মোহনলাল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘গগনেন্দ্রনাথ’-এ তাঁর দাদামশাইয়ের স্মৃতিচারণকালে জানা যায়, অবনের ছবি আঁকার সময়ে ধ্যানভঙ্গ করবেন না বলে গগন নিঃশব্দে রং-ভরা পোশাক বদলে এসেছেন। কিন্তু ভাইকে চিত্র সৃষ্টির মুহূর্ত থেকে বিচ্যুত করেননি। শিল্পীমনই জানে অপর শিল্পীমনের প্রসবকালীন বেদনা।
রবিকাকার বকুনি
গগন-অবন দু’জনেই মায়ের কাছছাড়া হতেন না বড় একটা। জোড়াসাঁকোর বাড়ি ছেড়ে নড়ানো যেত না গগনকে। রবীন্দ্রনাথ বহু বার চেয়েছেন গগনেন্দ্রকে বিদেশে নিয়ে গিয়ে বিদেশি রীতির স্থাপত্য-চারুশিল্পে শিক্ষিত করতে। কিন্তু জোড়াসাঁকোর গলির বাইরে গগনকে পা রাখানোয় সমর্থ হননি রবিকাকা।
১৯১৬ সালের ৮ অগস্ট। রবীন্দ্রনাথ এক চিঠিতে গগনেন্দ্রকে লিখছেন— ‘‘গগন, তোমরা কবে ঘর থেকে একবার বিশ্বজগতে বেড়িয়ে পড়বে? তোমাকে তোমার নামের সার্থকতা করা উচিত। কিন্তু তোমাদের তাড়া দেওয়া মিথ্যে।’’
তার পরেই লিখছেন, ‘‘শেষ কালে অনেক ভেবেচিন্তে টাইক্কানের পরামর্শে আরাই নামক এক আর্টিষ্টকে তোমাদের ওখানে পাঠাচ্চি। এঁর ইচ্ছা বছরদুয়েক ভারতবর্ষে থেকে ভারতবর্ষীয় আর্ট চিনবেন এবং ভারতবর্ষীয় ছবি আঁকবেন। অন্তত ছমাস যদি ইনি আমাদের বাড়িতে থেকে তোমাদের শেখান তাহলে অনেক উপকার হবে। বাইরে থেকে একটা আঘাত পেলে আমাদের চেতনা বিশেষভাবে জেগে ওঠে— এই আর্টিষ্টের সংসর্গে অন্তত তোমাদের সেই উপকার হবে।’’
তাঁকে জাপান থেকে আঁকা শেখাতে আসবেন চিত্রশিল্পী। পাঠাবেন রবীন্দ্রনাথ। আঁকা শিখবেন গগনেন্দ্রনাথ। কিউবিজ়মে পারদর্শী হয়ে নিত্যনতুন রহস্য তৈরি করবেন। এত সহজ ছিল না গগনের চিত্রশিল্পী হয়ে ওঠার কক্ষপথ। ওকাকুরার সান্নিধ্য, রবিকাকার পাঠানো বিভিন্ন বিদেশি আর্টের বইপত্তর, ছবি দেখার অভ্যেস, কিংবা জাপানি শিল্পীর আঁকা কিউবিক আর্টের সঙ্গে পরিচয়— সবই ঘটেছে অনেক পরে।
তার অনেক আগে গগনেন্দ্র দক্ষিণের বারান্দায় বসে বিকেলে চা-পাউরুটি খেতে খেতে কার্নিশে পাউরুটি ছড়িয়ে দিতেন। কাকেরা আসত তা খেতে। তাদের বসে থাকা, হাঁটাচলা, ঘাড় ঘোরানোর মুখভঙ্গি, খুঁটে খাওয়া নিবিষ্ট হয়ে দেখেছেন শিল্পী। কালির টানে একের পর এক ফুটিয়ে তুলেছেন কাকের ছবি। ছোটরা কেউ কাকের কাছে যেতে গেলে গগন তাদের বলতেন— ‘‘এই কাছে যাস নে। ওরা এখন ছবি আঁকাচ্ছে।’’
জ্যামিতিক বাক্স আর রূপকথা
কুড়ির দশকের প্রথম দিকে গগনেন্দ্র ‘কিউবিক’ অর্থাৎ জ্যামিতিক চিত্রাঙ্কন শুরু করেন। তাঁর ফ্যান্টাসি চিত্রনির্মাণের উৎস এই কিউবিজ়ম। নিজের কল্পনার সঙ্গে আন্দাজ মতো মেশালেন এই রীতিকে। ত্রিভুজ, বৃত্ত, অর্ধবৃত্ত বা ‘কোন’ অবলম্বনে গবেষণা শুরু করলেন।
সে সময়ে ইউরোপে কিউবিজ়ম নিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। গগনও লেগে রয়েছেন নিজের মতো করে। আলো-আঁধারি আর রহস্যে মোড়া রঙের খেলায় তাঁর ছবি সে ধারাকে নতুন আঙ্গিকে উপস্থাপিত করল। এ ছবি অনেকটাই অন্য রকম।
গগনেন্দ্রর কিউবিজ়ম ধারার প্রথম পর্যায়ের কয়েকটি ছবি ‘রূপম’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। স্টেলা ক্র্যামরিসের একটি প্রবন্ধের সঙ্গে সেগুলি দৃষ্টান্ত হিসেবে প্রকাশ পেলেও চিত্রকরের নামের উল্লেখ ছিল না। ‘অ্যান ইন্ডিয়ান কিউবিস্ট’ হিসেবে সেই প্রবন্ধে স্টেলা যে গগনেন্দ্রকে উল্লেখ করেছিলেন, তা অনেক পরে জানা যায়। ‘রূপম’ সম্পাদক জানিয়েছিলেন আলোচ্য শিল্পী স্বয়ং গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং প্রবন্ধের সঙ্গে মুদ্রিত কিউবিস্টিক চিত্রগুলি তাঁরই।
চট্টগ্রামের জমিদার যামিনীকান্ত সেনের সঙ্গে পাশ্চাত্যের শিল্পীদের ছবি নিয়ে গগনের অনেক কথা হত। যামিনী ছিলেন ভারতীয় চিরায়ত ও আধুনিক আর্টের সমঝদার। একই সঙ্গে তিনি গগাঁ, সেজান, রেনোঁয়া নির্মিত শিল্পের রসজ্ঞ। গগন সে সব শুনে বোঝার চেষ্টা করতেন। বইয়ের দোকান থেকে ইউরোপীয় আধুনিক শিল্পীদের আঁকা ছবির বই কিনে নিয়ে এলেন। সঙ্গে এল শিল্পীদের সম্পর্কে লেখা বইও। দিন-রাত পড়াশোনায় ডুবলেন গগন। এই চর্চার ফলে শিল্পীমনে যে প্রতিফলন দেখা গেল, তা কাগজে চিত্রিত হয়ে রূপ নিল গগনেন্দ্রর কিউবিস্ট ধারার ছবি।
রবীন্দ্রনাথের ‘রক্তকরবী’র প্রচ্ছদে থেকে গেল গগনের মনের সে নির্মাণ।
ক্যালাইডোস্কোপ বা প্রিজ়মের মধ্য দিয়ে শিল্পী যা দেখতেন, তাকে রঙে লেপে শরীর দিতেন গগন। যা দ্যুতিতে, বর্ণের বিচিত্র বিচ্ছুরণে কোনও এক ইন্দ্রলোকের সন্তান। ফ্যান্টাসি সেখানে একা নয়, পাশে হাত ধরে আছে রোম্যান্টিসিজ়মও। যেমন, ‘ড্রিমল্যান্ড’ ছবিটি। অর্ধগোলাকৃতি খিলানের নীচ দিয়ে আজব দেশের উদ্দেশে ভেসে চলেছে এক কাগজের নৌকা। তার উপরে ইন্দ্রধনুর মতো আলোর বিচ্ছুরণ। নৌকার ডান পাশের স্তম্ভটি নাট্যমঞ্চের দৃশ্যপটের এক ‘উইং’। বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসুর পরীক্ষাগারে কর্মরত ছবি ‘ক্যাপটিভ লাইট’ এই ধারার ছবি বলে অনেকে মনে করেন।
রূপকথা ধরা দিয়েছিল তাঁর স্বতন্ত্র শিল্পচর্চার তুলিতে। কয়েকটি ছবিতে উপস্থাপনা আর কৌশলের গুণে এক অন্য জগতের ছবি তৈরি হয়েছে। চিত্র-বিশেষজ্ঞরা যাকে ‘ওয়ান্ডার ল্যান্ড’ বা আজব দেশের চিত্রকল্প হিসেবে অভিহিত করেছেন। সাদা আর হাল্কা নীল রঙের ঘোড়া ছুটিয়ে এসে অরণ্যের প্রান্তে থমকে দাঁড়িয়েছেন রূপকথার রাজপুত্র। তার সামনে এক জলাশয়। অরণ্যে নেমেছে জমাট অন্ধকার। পাতায় পাতায় প্রতিভাত হচ্ছে বৃত্তাকার বা অর্ধবৃত্তাকার দ্যুতিময় রঙিন ফানুস। দু’টি পেঁচা বৃক্ষকোটরে বসে রাজপুত্রকে লক্ষ করছে। তার হাতে তির-ধনুক, মাথায় মুকুট, অসিবন্ধে তরবারি। কিন্তু রাজপুত্র কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে চেয়ে আছে জলাশয়ের দিকে।
ব্যঙ্গমা-ব্যঙ্গমী কিংবা রূপকথার রাজপুত্র। এ জগতের সন্ধান কালি-কলমে গগন-অবন ব্যতীত আর ক’জন শিল্পীই বা দিতে পেরেছেন এ ভাবে!
বাঙালির চির চেনা দি-পু-দা
দিঘা-পুরী-দার্জিলিং, মানে দিপুদা। বাঙালির খিদে পেলে খায় মুড়ি আর ঘুরতে যায় দার্জিলিং, দিঘা আর পুরী। এ মজার ঠেসটি বহু দিন ধরেই প্রচলিত ঘরকুনো বাঙালিদের জন্য। গগন ঠাকুর কিন্তু দিঘাটিকে বাদ দিয়েও দার্জিলিং আর পুরী গিয়েছেন বহু বার। আর তাই খুব স্বাভাবিক ভাবেই তাঁর ছবিতে বারবার ধরা পড়েছে পুরীর সমুদ্র আর দার্জিলিঙের নিসর্গদৃশ্য। পাহাড়ের কোলে কাঞ্চনজঙ্ঘাকে ফুটিয়ে তোলার নেশায় তিনি কখনও সাদা-কালোকে মাধ্যম হিসেবে নির্বাচন করেছেন, কখনও সোনালি কাগজে বর্ণের সমাবেশে জীবন্ত হয়েছে পর্বতশৈল।
মা সৌদামিনীর প্রায় শেষ বয়স, জগন্নাথ দর্শনের ইচ্ছে জানালেন। মায়ের ইচ্ছেয় পুরীতে সমুদ্রের ধারে বাড়ি তৈরি করে ফেললেন ছেলেরা। নাম পাথার পুরী। মাঝেমাঝেই আস্তানা গাড়তেন সেখানে। ভুবনেশ্বর মন্দির, পুরী মন্দির, কোনারকের মন্দির, তীর্থযাত্রীদের ভাবভঙ্গি... কোনও কিছুই বাদ পড়েনি গগনের সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ শক্তি থেকে। ছবিগুলি কোনওটি রঙিন, কোনওটি আঁকা হয়েছে সাদা-কালোর বুনটে।
পাণ্ডাদের ছবিও এঁকেছেন গগন। পুরী সিরিজ়ে পাণ্ডাদের ১৫টি ছবির নিদর্শন পাওয়া যায়। রাঁচি সিরিজ়ের ছবিতে ধরা পড়েছে বনজঙ্গল, গাছপালা, আদিবাসী নারী-পুরুষ-শিশু-সহ বাস্তব যাপনের ছবি।
দুর্গা বিসর্জনের রাতের মতো তাঁর চৈতন্য সিরিজ়ের ছবিও জগদ্বিখ্যাত। গগন ‘চৈতন্যদেবের মুত্যু’ নামে একটি ছবি আঁকেন, যেখানে সমুদ্রের ঢেউয়ের মধ্যে শুধু চৈতন্যদেবের মুখটুকুই দেখা যায়। বাকি সব বিলীন হয়েছে সমুদ্রে। হাল্কা সবুজ রঙে আঁকা এই ছবিতে জাপানি রীতির প্রভাব স্পষ্ট। কুড়ির দশকে বিভিন্ন সময়ে চৈতন্য সিরিজ়ের এই ছবিগুলি ইন্ডিয়ান সোসাইটি অব ওরিয়েন্টাল আর্টসে প্রদর্শিত হয়েছিল। বিক্রির উদ্দেশ্যে প্রতিটি ছবির দাম রাখা হয় দুশো থেকে তিনশো টাকা।
গগন ঠাকুর যখন পুরীতে বসে ছবি আঁকছেন, তখন অবন ঠাকুরও তাঁর পাশে বসে তুলি-রং নিয়ে সৃষ্টির খেলায় মগ্ন। আর গগন সমুদ্রের সামনে বসে এঁকে চলেছেন সমুদ্রের জলে ঝাঁপিয়ে পড়া নুলিয়ার শরীরের রং, সমুদ্রের ঢেউয়ের সঙ্গে আলোছায়ার ওঠাপড়া।
দার্জিলিঙেও তিনি সৃষ্টিশীল। শিল্পীমনের তুলি দিয়ে প্রকৃতির রং শুষে নিয়ে তাকে ছবিতে বুলিয়ে দেন গগন। মেয়ে সুজাতা বাবার কারসাজির বর্ণনা দিচ্ছেন তাঁর এক লেখায়, ‘‘দার্জিলিংয়ে দেখেছি বাবা কাঞ্চনজঙ্ঘার দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতেন। শিল্পীর চোখে তিনি যা দেখেছিলেন, আমাদেরও তাই দেখতে শেখালেন। মহাদেব শুয়ে আছেন— নাক, মুখ, চোখের রেখা তখন স্পষ্ট দেখতে পেলাম। তিনি আমাদের চোখ ফুটিয়ে দিলেন, তাই, না হলে আগে শুধু বরফের পাহাড় বলেই দেখেছিলাম।’’
জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ
মানচিত্রের গণ্ডি না মানা শিল্পের নিজস্ব বিশ্বপরিসর তাঁকে সব সময়ে সত্যের পথ দেখিয়েছে। স্বাধীনতা আন্দোলনে বাংলার বিপ্লবীদের পাশে থেকেছেন নানা ভাবে। তাঁর কাছে আসতেন কারমাইকেল, রোনাল্ডসে, মন্টেগুর মতো শিল্প অনুরাগী সাহেবরা। অন্য দিকে, দিনবদলের স্বপ্ন নিয়ে গোপন কাজকর্ম আলোচনা করতে আসতেন বারীন ঘোষ, কানাইলাল দত্ত, নরেন গোঁসাইরা। গগনের অর্থসাহায্য পেতেন বিপ্লবীরা। কখনও অনুশীলন সমিতি বা যুগান্তর দলকে নতুন সাইকেল কিনে দিয়েছেন দ্রুত যোগাযোগের প্রয়োজনে। বিপ্লবীদের চাঁদা দিয়েছেন। এক বার বারীন ঘোষের ঠেকে তল্লাশি চালিয়ে মিলল বোমা বানানোর মশলাপাতি। সঙ্গে ওই সাইকেল। রাষ্ট্রচিহ্নিত ‘সন্ত্রাসবাদী’দের সঙ্গে সুসম্পর্কের প্রমাণ ইংরেজ পেলে তাঁর যে জেল হত, গগন তা জানতেন। কিন্তু তার পরেও তিনি নরেন গোঁসাই খুনের পিস্তল এক রাত নিজের কাছে রেখেছেন। নরেন ধরা পড়ার পরে পুলিশের কাছে খোচরবৃত্তি করে নিজের প্রাণ বাঁচাতে চাইলেও আলিপুর জেলের মধ্যে তাঁকে খুন করেন বিপ্লবী কানাই আর সত্যেন।
কোনও মতে সে বার হাতকড়া পরা থেকে বাঁচলেন গগন। মা সৌদামিনীর পরামর্শে বাড়িতে পাহাড় করে জমিয়ে রাখা সমস্ত স্বদেশি বই আগুনে পুড়িয়ে ফেলা হল।
আপসহীন শিল্প, স্বাজাত্য বোধ
স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়ে বিলিতি পর্দা, বিলিতি আসবাব, বিলিতি তেল রঙের ছবি দূর করেছেন গগন। বদলে ঠাকুরবাড়িকে সাজিয়েছেন দেশীয় শিল্প-স্থাপত্যে। ‘বেঙ্গল হোম ইন্ডাস্ট্রি’ গড়ে বাংলার কুটির শিল্পকে প্রাণ দিলেন। এক দিকে যখন লাট রোনাল্ডসে শিল্পী গগন ঠাকুরের শিল্প ভাবনায় মুগ্ধ হয়ে ‘ইন্ডিয়ান সোসাইটি অফ ওরিয়েন্টাল আর্টস’-এর জন্য মাসিক সরকারি সাহায্যের ব্যবস্থা করছেন, অন্য দিকে সোসাইটির সম্পাদক তথা প্রতিষ্ঠাতা গগনও স্থির করে ফেলেছেন ইংরেজ সরকারের তাবেদারি করবে না তাঁর শিল্পবোধপ্রসূত সংস্থাটি। লাটসাহেবও চিনতেন গগনকে। তিনি লিখলেন, ‘‘দি অ্যাকসেপ্টেন্স অব দিস গ্রান্ট বাই দ্য সোসাইটি নাইদার অফিশিয়াল ইনস্পেকশন নর কন্ট্রোল। দ্য স্কুল অব পেন্টিং ইজ় ইন নো সেন্স আ গভর্নমেন্ট স্কুল অফ আর্ট।’’
এই রোনাল্ডসেই আবার আন্দামান জেল থেকে ছাড়া পাওয়া বারীন ঘোষের রাজনৈতিক গতিবিধি জানতে শরণাপন্ন হলেন গগনেন্দ্রনাথের। অরবিন্দ ঘোষের অনুজ এই বিপ্লবী আর রোনাল্ডসের একদিন টানা দু’ঘণ্টা রুদ্ধদ্বার বৈঠক হল ইন্ডিয়ান সোসাইটি অফ ওরিয়েন্টাল আর্টস ভবনে। বৈঠকের মধ্যস্থতাকারী গগন।
শোনা যায়, তখন ইংরেজদের দেওয়া ‘ব্ল্যাক আন্ড হোয়াইট ক্লাব’ নামের প্রবল বিরোধিতা করেছিলেন গগনেন্দ্রনাথ। ওই ক্লাব গড়লেন কলকাতায় বসবাসকারী ইংরেজ সাহেবরা। ভারতীয়দের দাক্ষিণ্য দেখিয়ে সাদা আর কালোয় ছাপা হল সভ্য কার্ড। ওই ক্লাবের সভ্য তিনিও। গগন রুখে দাঁড়ালেন। চলল প্রচার, আন্দোলন। শেষে সাহেবরা ওই নাম প্রত্যাহার করে নিল।
সেটিই এখন এ শহরের ‘ক্যালকাটা ক্লাব’। বাংলার বাবুদের বিত্ত হয়তো এ কালেও বজায় থাকত। তবে গগন ঠাকুর না থাকলে আত্মসম্মানটি থাকত না!
শেষ হয়েও হল না শেষ
তত দিনে গগন ঠাকুর রবীন্দ্রনাথের জোব্বা পোশাক পরিকল্পনা করে ফেলেছেন। তত দিনে রবীন্দ্রনাথের নাটকে রাজার ভূমিকায় জমিয়ে অভিনয় করে গগন এমন মুগ্ধতা অর্জন করে ফেলেছেন রবিকাকার যে, তিনি গগনকে পার্ট দেবেন বলে ‘শারদোৎসব’ নাটকে নতুন করে রাজার চরিত্র জুড়ছেন। তত দিনে রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতন থেকে গগনকে চিঠি লিখছেন নিজের আঁকা ছবির বিষয়ে পরামর্শ করতে চেয়ে, ‘‘আমার ছবির নেশা আজও কাটল না। ...তোমরা কাছে থাকলে ভরসা পেতুম, কোন রাস্তায় চলছি সেটা তোমাদের সঙ্গে বোঝাপড়া করে নিতে পারতুম।’’
তত দিনে শিল্পীও বিছানা নিয়েছেন। আর আঁকতে পারেন না। ১৯৩০ সালে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের পর থেকে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হলেন। ওই অবস্থার মধ্যেও যামিনী রায়ের আঁকা ছবির প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করেছেন।
তার পরে একদিন দেহের বিচারে মারা গেলেন গগন। বেঁচে রইল তাঁর রং-তুলি আর নামের সার্থকতা।
রবীন্দ্রনাথ গগন-স্মরণে লিখলেন,
‘‘রেখার রঙে তীর হতে তীরে
ফিরেছিল তব মন
রূপের গভীরে হয়েছিল নিমগন।
গেলা চলি তব জীবনের তরী
রেখার সীমার পার,
অরূপ ছবির রহস্য মাঝে
অমল শুভ্রতার।’’
ঋণ:
রূপদক্ষ গগনেন্দ্র: কমল সরকার;
গগনেন্দ্রনাথ: মোহনলাল গঙ্গোপাধ্যায়
ইন্ডিয়ান কনটেম্পোরারি আর্ট সিরিজ়: ললিত কলা অ্যাকাডেমি
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy