Advertisement
E-Paper

নাটক জুড়ে এক আগ্নেয়গিরির জন্ম

‘মহাত্মা বনাম গান্ধী’ নাটকটির দ্বন্দ্বের মূল জায়গাটি জুড়ে রয়েছে মোহনদাস কর্মচন্দ গান্ধীর সঙ্গে তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র হরিলাল গান্ধীর সুতীব্র বিরোধ।

নাটকের দৃশ্যে সুজন ও অনির্বাণ

নাটকের দৃশ্যে সুজন ও অনির্বাণ

সৌভিক গুহসরকার

শেষ আপডেট: ২৯ মার্চ ২০২৫ ১০:২৩
Share
Save

গত ২৬ জানুয়ারি জি ডি বিড়লা সভাঘরে মঞ্চস্থ হল চেতনা নাট্যগোষ্ঠীর নাটক— ‘মহাত্মা বনাম গান্ধী’। ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত হয় দিনকর যোশীর গুজরাটি উপন্যাস— ‘প্রকাশ নো পদছায়ো’। এই উপন্যাসটি থেকে ১৯৯৫ সালে মরাঠিতে নাটক নির্মাণ করেন অজিত দলভি। নাটকটির নাম ‘মহাত্মা ভার্সাস গান্ধী’। এই নাটকটি পরবর্তীকালে অন্যান্য ভারতীয় ভাষায় অনূদিত হয়েছে। কয়েকবছর আগে এই নাটকটি বাংলায় অনুবাদ করেন প্রসিদ্ধ নাট্য-ব্যক্তিত্ব অরুণ মুখোপাধ্যায়। একটি নাট্য পরিবেশন কতটা অবাধ ও উচ্চকোটির হবে, তার অনেকটা নির্ভর করে ‘টেক্সট’ অর্থাৎ লিখিত নাটকটির উপরে। অভিনয়, মঞ্চকৌশল যতই উচ্চমানের হোক না কেন নাটকটি সুলিখিত না হলে তা কখনওই দর্শকের চেতনায় আঘাত করবে না। ‘মহাত্মা বনাম গান্ধী’র ক্ষেত্রে প্রথমেই যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টির কথা উল্লেখ করা দরকার,তা হল এর অনূদিত নাট‌্যরূপ। বর্ষীয়ান নাট্যব্যক্তিত্ব অরুণ মুখোপাধ্যায় এত চমৎকার ভাবে নাটকটি অনুবাদ করেছেন যে মনে হয়, তা যেন এক সম্পূর্ণ মৌলিক নাটক। বাংলাতেই লেখা। ঝরঝরে, গভীর ও ব্যঞ্জনাময়।

‘মহাত্মা বনাম গান্ধী’ নাটকটির দ্বন্দ্বের মূল জায়গাটি জুড়ে রয়েছে মোহনদাস কর্মচন্দ গান্ধীর সঙ্গে তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র হরিলাল গান্ধীর সুতীব্র বিরোধ। এক পৃথিবী-বিখ্যাত সর্বজনমান্য ব্যক্তি পিতা হিসেবে কেমন মানুষ? সারা ভারতের ‘বাপু’ তিনি, ‘জাতির জনক’ অথচ তাঁর নিজের পুত্র হরিলালের কাছে তিনি পিতা হিসেবে নির্দয়, নির্মম‌। হয়তো ব্যর্থ। আর পিতাপুত্রের এই তীব্র বিরোধের আগুনে যিনি জ্বলেপুড়ে ভস্ম হয়ে চলেছেন প্রতি মুহূর্তে, তিনি কস্তুরবা— মহাত্মার অনুগত স্ত্রী, হরিলালের স্নেহময়ী মা। গোটা নাটক জুড়ে এক আগ্নেয়গিরির জন্ম দেখি। সম্পর্কের অনেক নীচে যে তরল অমীমাংসিত আগুন ছটফট করে, সেই আগুনই ক্রমে নানা ফাটল ধরে ক্রমশ নিজের প্রকাশমুখ খুঁজে নিয়ে অপ্রতিহত শক্তিতে উৎসারিত হয়। বিষাক্ত ধূম্রমেঘ ছড়িয়ে পড়ে পরিবারের নানা স্তরে। লাভাস্রোতে ছাই হয়ে যায় পিতাপুত্রের সম্পর্ক। হরিলাল তার পিতার মতো ব্যক্তিত্বশালী নয়, কিন্তু সে পিতার মতোই হতে চায়। সে পিতাকে ভালবাসে। অন্য দিকে মহাত্মা নিজের সন্তানকে স্নেহ করা সত্ত্বেও তাকে নিজের আদর্শের নিগড়ে বেঁধে রাখতে চান। তাঁর আদর্শবাদ ঠিক কোন মুহূর্তে স্বৈরাচারী হয়ে ওঠে এ কথা যেন তিনি বুঝেও বুঝতে চান না। কারণ তিনি নিজের কাছে নিজেই মহাত্মা হয়ে উঠতে চেয়েছেন বারংবার।

এই নাটকে মহাত্মা গান্ধীর স্নেহশীলতা অথচ তাঁর একরোখা অনড় অটল জেদকে অসাধারণ দক্ষতার সঙ্গে ফুটিয়ে তুলেছেন অনির্বাণ চক্রবর্তী। গান্ধীজির চরিত্রের ভিতরে যে জটিল বৈপরীত্য— তা তিনি খুঁড়ে তুলেছেন নিপুণ ভাবে। এমনিতেই তাঁর অভিনয়ের মধ্যে একটা সহজাত ‘ইকোনমি অফ এক্সপ্রেশন’ রয়েছে, যা গান্ধীজির চরিত্রটির সঙ্গে মিলেমিশে গিয়েছে। অন্য দিকে সুজন মুখোপাধ্যায় যেন হরিলাল গান্ধীই। তিনি যে কারও চরিত্রে অভিনয় করছেন, তা মনে হচ্ছিল না। হরিলালের ছেলেমানুষি, অভিমান, রাগ, ভালবাসা, চিৎকার— এ সব কিছুর মধ্যে যে একটা অনিয়ন্ত্রিত ‘এক্সেস’ রয়েছে, অতিরিক্ত আবেগ রয়েছে, সেটাকেই তিনি মঞ্চে জ্বালিয়ে তুলেছেন। হরিলাল মঞ্চে পুড়ছেন, হতাশায়, বিষাদে, ক্রোধে। সুজন মুখোপাধ্যায়ের অসামান্য অভিনয় সেই বিষাদ পোড়া ছাই ছড়িয়ে দিয়েছে দর্শকের চেতনায়।‌ এর পরেই যাঁর কথা উঠে আসে, তিনি কস্তুরবার ভূমিকায় নিবেদিতা মুখোপাধ্যায়। পিতাপুত্রের নিরন্তর টানাপড়েনে সারাজীবন ধরে দগ্ধ হয়েছে যে নারী— সে যখন বুকফাটা আর্তনাদ করে নানা প্রশ্নের উত্তর চায়, তখন গোটা প্রেক্ষাগৃহ নিশ্চল স্তব্ধতায় শিউরে ওঠে। কস্তুরবা চরিত্রে নিবেদিতার অভিনয় বহুদিন বাংলা নাটকের একটি স্মরণীয় চরিত্র হয়ে থেকে যাবে। এই তিনজনের পাশাপাশি যাঁর কথা বলতে হয়, তিনি গুলাব গান্ধীর ভূমিকায় মেরি আচার্য। এক পারিবারিক ভাঙনের অন্ধকারে তাঁর অভিনয় পিলসুজের আলোর মতো কোমল। তাঁর অভিনয়ের নানা পরতে সংযম ও সূক্ষ্মতা প্রকাশ পেয়েছে। বাকি অভিনেতারা প্রত্যেকেই নিজেদের কাজ সুষ্ঠু ভাবে করেছেন।

‘মহাত্মা বনাম গান্ধী’র একটি বড় সম্পদ হল প্রবুদ্ধ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গীত, তা চিত্তকে ঋদ্ধ করে। এ ছাড়া সৌমেন চক্রবর্তীর আলো, সুশোভন গুহ ও বিলু দত্তর মঞ্চসজ্জা নাটকটিকে নিবিড় ঘনত্ব প্রদান করেছে। মহম্মদ আলী ও অয়ন ঘোষের রূপসজ্জা এই নাটকের চরিত্রগুলোকে রক্তমাংসের করে তুলেছে।

পরিশেষে বলা দরকার যে ‘মহাত্মা বনাম গান্ধী’ নাটকের নির্দেশক সুজন মুখোপাধ্যায় যে ভাবে নাটকটিকে ভেবেছেন এবং পরিমার্জনা করে উপস্থাপিত করেছেন, তা মুগ্ধ করে। যে-নাটকের পরতে পরতে রক্তক্ষরণ রয়েছে, দমচাপা গোঙানি ও বুকফাটা চিৎকার রয়েছে— সেই নাটকটিকে তিনি এমন ভাবে নির্মাণ করেছেন যে তার প্রতিটি ব্যঞ্জনা দর্শকের চেতনায় আঘাত করল অথচ তা মেলোড্রামা হয়ে উঠল না। নাট্যনির্দেশক হিসেবে তাঁর এই সংযম প্রশংসাযোগ্য।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

drama

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}