Advertisement
১৮ নভেম্বর ২০২৪

নিজেরে হারায়ে খুঁজি

কোথায় যেন হাহাকার লুকিয়ে তাঁর এই গানে! আদপে ওঁর সঙ্গীতজীবনটাও কি তেমনই? চলে যাওয়ার এক বছর পর মাধুরী চট্টোপাধ্যায়কে ফিরে দেখলেন শঙ্করলাল ভট্টাচার্যকোথায় যেন হাহাকার লুকিয়ে তাঁর এই গানে! আদপে ওঁর সঙ্গীতজীবনটাও কি তেমনই? চলে যাওয়ার এক বছর পর মাধুরী চট্টোপাধ্যায়কে ফিরে দেখলেন শঙ্করলাল ভট্টাচার্য

যৌবনের প্রান্তবেলায় মাধুরী

যৌবনের প্রান্তবেলায় মাধুরী

শেষ আপডেট: ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০০:০০
Share: Save:

আজকাল প্রায়ই টেলিভিশনে নানা গানের প্রতিযোগিতায় অন্ত্যাক্ষরী বা আধুনিক আসরে মেয়েরা দেখি দিব্যি ভালবেসে যত্ন করে গেয়ে দিচ্ছে ‘নিজেরে হারায়ে খুঁজি’, ‘ওই যে সবুজ বনবীথিকায়’, ‘তোমায় আমায় প্রথম দেখা গানের প্রথম কলিতে’ বা ‘অলি অমন করে নয়’।

এমন একটা হাল্কা, মধুবাতাস বয় তখন মনের ভেতরে যে, মনে মনে মেয়েটিকে একটি অযাচিত ভোট দিয়ে ফেলি। শুধু গানগুলোকে গাওয়ার জন্য, বাছার জন্যই!

একই সঙ্গে নিজের কপালকেও একটু ধন্যবাদ দিই এককালে জলসায় বা রেডিয়ো-র সামনে বসে সলিল চৌধুরী বা নচিকেতা ঘোষের এই সব কম্পোজিশন মাধুরী চট্টোপাধ্যায়ের মতো এক গায়ে কাঁটা ধরানো, তড়িচ্চুম্বক কণ্ঠে শোনার সুযোগ হয়েছিল বলে। মাধুরীর গান নিয়ে বলতে গেলে ওঁর নির্ভার হাওয়ার মতো ভাসানো, নিখুঁত, রিনরিনে ধ্বনি সম্পর্কে ইলেকট্রোম্যাগনেটিজমের উপমাটা এসেই পড়ে। যে কারণেই হয়তো সলিলবাবু গানের পর গানে খুঁজে নিয়েছিলেন ওঁর গলাই। গীতা দত্ত প্রসঙ্গে বলা জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের একটা শব্দ ওঁর কণ্ঠ সম্পর্কেও বলে ফেলতে পারি— পবিত্র!

এই অদ্ভুত কণ্ঠের মাধুরীকে অবশ্য মেয়েবেলায় প্রথম যাঁর কণ্ঠ টেনেছিল তা প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। কাছেই কোনও জলসায় গাইতে এসেছিলেন প্রতিমা। কে গাইছে, কী গাইছে, কোনও ধারণাই নেই মেয়েটির। কিন্তু সে বাড়ির দরজা খোলার চেষ্টা করে যাচ্ছে বেরোবে বলে। এমনই নিশির ডাক সে দিন প্রতিমার গান ওঁর কাছে। একটা বয়সে মাধুরীর নিজের গলাতেও ওই হন্টিং, আচ্ছন্ন করা, হাতছানি দেওয়া আওয়াজটা ধরা দিয়েছিল।

ওই গলা শুনেই একদিন আকাশবাণীর এক কর্মকর্তা ওঁর জন্য অডিশন ফর্ম পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। অডিশন দেওয়া নিয়ে কোনও ভয়ডর ছিল না। খেয়াল শিল্পী উমা দে, তবলা বাদক উস্তাদ কেরামতুল্লা খান ও পণ্ডিত হরিহর শুক্লর ছাত্রী মাধুরীর যত্ত ভয় গার্স্টিন প্লেসের অল ইন্ডিয়া রেডিয়োর স্টুডিয়ো নিয়ে। উৎপলা সেনের কাছে তত দিনে শোনা হয়ে গেছে ওটাই নাকি হানাবাড়ি। কোনও এক সাহেবের ভূত চরে বেড়ায়!

শেষে তখনকার ডাকসাইটে মিউজিক ডিরেক্টর দুর্গা সেনকে সঙ্গে করে জীবনের প্রথম রেডিয়ো প্রোগ্রাম করতে গেলেন মাধুরী চোদ্দো বছর বয়সে। সালটা ১৯৫৫। রেডিয়োয় আবির্ভাবের পক্ষে বেশ কম বয়সই। কারণ, তাতেই নাম ছড়ানোটা শুরু হয়, এবং মাত্র চার বছরের মধ্যে বয়স যখন আঠেরো, ডাক এলো মেগাফোন থেকে নচিকেতা ঘোষের সুরে দুটো পুজোর গান রেকর্ডের। ‘অলি অমন করে নয়’ আর ‘তোমায় আমায় প্রথম দেখা’। জীবনের প্রথম রেকর্ডেই যে বাংলার চিরদিনের দুটো আধুনিক ধরা পড়বে এতটা বোঝারও কি বয়স তখন মাধুরীর?

গান দুটো সত্যিই কেমন হল তখন একটাই মাপকাঠি। রেডিয়ো এবং বাড়িতে বাড়িতে রেকর্ডটা ক্রমান্বয়ে বেজে চলা এবং আঠেরো-উনিশ বছর বয়সি মেয়েটির ঘন ঘন জলসায় ডাক পাওয়া থেকেই বোঝা যায় গান দুটো কত জনপ্রিয় ছিল। শেষে ১৯৬১তে রবীন্দ্র শতবর্ষে সলিল চৌধুরীর কথা ও সুরে রেকর্ড করা ‘নিজেরে হারায়ে খুঁজি’ যা সেই থেকে অর্ধশতাব্দী ধরে ওঁর স্বাক্ষরগীতি হয়ে রইল।

গানটার সুবর্ণ জয়ন্তী মিলিয়ে যেতে না যেতেই মাধুরী নিজেও যে ৭২ বছর বয়সে মিলিয়ে যাবেন অতীতে, এটা ভেবেই কষ্ট পাচ্ছেন ওঁর অনুরাগীরা। এই তো মোটে এক বছরের কিছু বেশি হল উনি নেই (মৃত্যু: ১৯ অক্টোবর ২০১৩), অথচ কত দিন যাবৎই তো উনি বলতে গেলে অন্তরালে। ঢালাও সম্মান ও পুরস্কারের বাজারেও সলিল, রবীন (চট্টোপাধ্যায়), নচিকেতা, শ্যামল, সতীনাথের সুরকে অমর করে যাওয়া মাধুরীর নামটা কারও মনেই আসেনি।

সে নয় গেল। কিন্তু চলে যাওয়ার পরও কন্যা রূপা চট্টোপাধ্যায়ের (গায়িকাও বটেন) হাজারো চেষ্টা সত্ত্বেও মাধুরীর মরদেহ রবীন্দ্রসদন চত্বরে কিছুক্ষণ রাখার ব্যবস্থা করা যায়নি! তাতে ফল হল এই যে রূপার মোবাইলে পরদিন মেসেজ আসা শুরু হল শিল্পী ও অনুরাগী মহল থেকে, সদনে এনে ওঁকে একটু শেষ দেখার সুযোগ দিলে না!

মায়ের মৃত্যুবার্ষিকীর পর চোখের জল সামলে এটাই বলেছিলেন রূপা।

রূপাকে স্তোক দেওয়ার চেষ্টা করিনি কারণ অভাবনীয় সাফল্য এবং অক্ষমণীয় বিস্মরণের মাঝেই কোথাও মাধুরীর বরাবর চলাচল। ওঁর জীবনের প্রথম দিনগুলোই এই মেরুবিচরণের ইঙ্গিত করে। কারণ গোঁড়া ব্রাহ্মণ পরিবারের মেয়েটির জন্ম হল তখনকার দেদার সাহেবপাড়া পার্কস্ট্রিটের এক নার্সিং হোমে। তারিখটা রবীন্দ্র প্রয়াণবর্ষ ১৯৪১-এর ১৬ ডিসেম্বর।

সেখান থেকে মেয়েটিকে এনে তোলা হল মামার বাড়ি বলরাম বসুু ঘাট রোডে। যে রাস্তাটি আবার ঠাকুর রামকৃষ্ণের স্মৃতিধন্য। আর ঘটনা এই যে মৃত্যুর ক’বছর আগে রোম্যান্টিক বাংলা গানের গায়িকা বলতে গেলে গানের জীবনকে বিদায়ই জানালেন, ‘জয় শ্রীরামকৃষ্ণ, কালো মেয়ের পায়ের তলায়’ শীর্ষক একগুচ্ছ শ্যামাসংগীতের সিডি করে।

রোম্যান্টিক বাংলা গান থেকে শেষের শ্যামাসংগীত অবধি মাধুরীর বাংলা গানের বৈচিত্রও কম নয়। যাঁরা খোঁজ রাখেন তাঁরা জানেন। বাবা শিবনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় (মাধুরী বিবাহসূত্রে চট্টোপাধ্যায়, ওঁর প্রথম ডিস্ক বন্দ্যোপাধ্যায় পদবিতেই বেরিয়েছিল, পুনর্মুুদ্রণে চট্টোপাধ্যায় হয়) ছিলেন বড় কীর্তনীয়া। পাঁচ হাজার শ্রোতাকেও মাইক ছাড়া গান শুনিয়েছেন। বাড়ি এমনিতেই ছিল গানের বাড়ি। সবাই গান করে, কিন্তু পেশাদার ভাবে গাইবার অনুমতি কারও নেই। গান নিয়ে বাইরে গানের জগতে আসা হয়েছিল শুধু মাধুরীরই।

তাই বাড়ির ধারা আর তালিমের দাক্ষিণ্যে মাধুরীর গাওয়া হয়েছে রাগপ্রধান, ভজন, গীত, গজল, নজরুলগীতি থেকে রবীন্দ্রসঙ্গীত। মেগাফোনে প্রথম রেকর্ডিংয়ের আগে ওঁর পরীক্ষা নিয়েছিলেন রবীন চট্টোপাধ্যায় ও রাধাকান্ত নন্দী। রবীনবাবু প্রশ্ন করেছিলেন ‘তুমি এমনিতে কার গান গাও?’ তাতে মাধুরীর উত্তর ছিল অদ্ভুত।

বলেছিলেন, “আমি প্রতিমাদি, লতাজি, আশাজি, রফি সাহেব, শ্যামলবাবু, সতীনাথবাবু সবার গান গাই।’’ তখন পরীক্ষা হিসেবে আশার একটা গান গেয়ে শোনাতে হয়েছিল। ‘আমি সুখেদুখে যে মালা পরেছি/ তাই তো দিয়েছি পরায়ে’ আজকের আশা ভোঁসলের বাংলা গানের বিপুল ভক্তবাহিনীর ক’জন যে ওঁর এই অপরূপ মাণিক্যটিকে স্মরণ করতে পারেন, বলা মুশকিল।

পূর্বের গানের ধারক হিসেবেও মাধুরীর একটা সুখ্যাতি ছিল গোড়ার থেকেই। একটা উদাহরণ দিই...

প্রণব রায়ের কথায় আর কমল দাশগুপ্তের সুরে ‘এমনই বরষা ছিল সে দিন’ তো কমলবাবুর স্ত্রী ফিরোজা বেগমের কণ্ঠে একটা ক্ল্যাসিক হয়ে আছে। কিন্তু গানটি প্রথম রেকর্ড হয় যূথিকা রায়ের কণ্ঠে সেই ১৯৩৬ সালে। ফিরোজার রেকর্ড হওয়ার আগেই কিন্তু গানটির দ্বিতীয় বিখ্যাত পরিবেশনা মাধুরীর। সেই রেকর্ড শুনে স্বয়ং ফিরোজাও দারুণ তারিফ করেছিলেন, ‘তুই তো দারুণ ভাল গেয়েছিস রে!’

অথচ মাধুরীর যা কপাল চিরদিন! কমলবাবুর স্মরণে সেই গান রেকর্ড করতে ঢুকবেন, দেখলেন আগের সব রথীমহারথীরা এমনকী নামী যন্ত্রীরাও দল বেঁধে স্টুডিয়ো ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। বেচারি মাধুরী তখন স্টুডিয়োর বাইরে এক ধারে বসে কেঁদেই যাচ্ছেন। ঝোঁক হয়েছে রেকর্ড না করেই চলে যাবেন। অনেক বুঝিয়ে ওঁকে রাজি করানো গেল। পরে নানা শিল্পীর গায়নে রেকর্ড হওয়া সেই অ্যালবামে একটা নতুন মণি হয়ে যুক্ত হল, ‘এমনই বরষা ছিল সে দিন/ শিয়রে প্রদীপ ছিল মলিন/ তব হাতে ছিল অলস বিন/মনে কি পড়ে প্রিয়?’

শুধু এই গানই বা কেন, ওঁর রেন্ডারিংয়ে শ্যামল মিত্র বা সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের ক্লাসিক নির্মাণ যে ভাবে ফিরে এলো বাঙালি জীবনে সেই শিহরন কি সহজে ভুলে যাওয়া যাবে? বাজার ধরার জন্য পুরনো কথা, সুর ও শিল্পীর চর্চা নয় এ সব নিখাদ শ্রদ্ধাঞ্জলি। শ্রদ্ধাঞ্জলি হিসেবেই বেরিয়েছিল নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি।

সেই রকম দুটো গানেরই কথা বলব। গৌরীপ্রসন্নর কথায় শ্যামলবাবুর নিজের সুরে, ‘একটি কথাই লিখে যাব শুধু জীবনের লিপিকাতে/ তুমি যে আমার/ তুমি যে আমারই ওগো।’ এবং শ্যামল গুপ্তের কথায়, সতীনাথের নিজের সুরে গাওয়া ‘যে দিন জীবনে তুমি প্রথম দিলে গো দেখা/ সে দিন বুঝিনি আমি আবার হব যে একা।’

মাধুরীর নিবেদনে সেরা শংসাপত্র এটাই যে বহুশ্রুত, বহুপ্রিয় গান দুটিকে একেবারে অরিজিনাল হিসেবে শোনা গিয়েছিল এবং এখনও যায়। দুটি প্রধান পুরুষকণ্ঠের গানকে একেবারে নির্মল নারীকণ্ঠের নিবেদনে রূপান্তরিত করলেন মাধুরী।

‘নিজেরে হারায়ে খুঁজি’র শিল্পীর জীবনের বড় আশীর্বাদ নিজের কণ্ঠটিকে কখনও হারিয়ে ফেলেননি। মৃত্যুর দিনও সকালে গলা সেধেছেন। তার ক’মাস আগেও আসরে গেয়েছেন। গলা ওঁর চিরদিনই রিনরিনে। কিন্তু মসৃণ, গোল আওয়াজ শেষ দিকেও অমনই রয়ে গেল কী করে, তা অবাক করে।

তবু গানের চলন, ধরন, গোত্রে মাধুরী নিঃসংশয়ে বাংলা আধুনিকের স্বর্ণযুগে সুবর্ণ মুহূর্তেরই শিল্পী। তখনকার তুলনাহীন সব কণ্ঠের মধ্যেও ভীষণ স্বতন্ত্র এক ধ্বনি হিসেবে ধরা দিতেন। অনুরোধের আসরে লতা, গীতা, সন্ধ্যা, আশা, আলপনা, উৎপলা, নির্মলাদের থেকেও ভারী ভিন্ন এক চেহারা।

যদি কারও সঙ্গে মিল কিছু আসত তো তা ওঁর সেই ‘নিশির ডাক ’প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। এখন টিভির অনুষ্ঠানে অনুষ্ঠানে আজকের মেয়েদের ওঁর গান তুলতে দেখে ধারণা হয় মাধুরী চট্টোপাধ্যায় নিজেও এক নিশির ডাক হয়ে উঠেছেন।

সামান্য ঝিলিকেও উনি ফিরে ফিরে আসেন। কিন্তু তার পরেও, অন্যদের পেশকারিতেও কোথাও যেন একটু অধরাই থেকে যান। সরস্বতীর দেওয়া এই পুরস্কার ও দানটুকু কেউ কাড়তে পারেনি।

মাধুরীদি

স্মৃতিচারণায় সঙ্গীত-আয়োজক শান্তনু বসু

আশির দশকের শেষ। টেকনিশিয়ান স্টুডিয়োয় কোনও এক ফিল্মের গানের রেকর্ডিং।

মাধুরী চট্টোপাধ্যায় গাইতে এলেন। সেই প্রথম ওঁর সঙ্গে আলাপ। তার পর ধীরে ধীরে ঘনিষ্ঠতা। রেকর্ডিং-এ তো দেখা হতই। রেডিয়োয় হত। কোনও কোনও অনুষ্ঠানেও ওঁকে পেয়ে যেতাম।

নচিকেতা ঘোষের কথা খুব বলতেন। আর সলিল চৌধুরী। মেগাফোন কোম্পানি থেকে ওঁর প্রথম যে রেকর্ড বেরোয়, তার এক পিঠে ছিল ‘তোমায় আমায় প্রথম দেখা’। উল্টো পিঠে ‘অলি অমন করে নয়’। পুলক বন্দ্যোপাধায়ের লেখা। সুর নচিকেতা ঘোষের। দুটো গানই অসম্ভব হিট হয় সে সময়। সেই থেকে নচিকেতা ঘোষের প্রতি ওঁর শ্রদ্ধা অপরিসীম। আমি জানতাম। কিন্তু সলিল চৌধুরীর কথাটা শোনার খুব ইচ্ছে। একদিন জিজ্ঞেসই করে ফেললাম, ‘‘ওঁর সঙ্গে আপনার কী করে আলাপ?’’

বললেন, ‘‘এটা পুরোপুরি কমল ঘোষের জন্য।’’ কমল ঘোষ, মেগাফোনের মালিক। ‘‘দ্বিতীয় বছর গান তৈরির আগে কমলদা ডেকে পাঠালেন। যেতেই বললেন, ‘এ বার তোমায় সলিলের সুরে গাইতে হবে।’ আমি তো শুনে ভেতরে ভেতরে কেঁপে গেলাম। সলিলদা তখন আমাদের কাছে একটা স্ফুলিঙ্গের মতো। লতা মঙ্গেশকর, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ওঁর সুরে গাইছেন। তাঁর সঙ্গে আমি কাজ করব! কমলদা বসতে বললেন। একটু বাদেই সলিলদা এলেন। সাদা পাঞ্জাবি। সাদা ট্রাউজার। খুব ভয়ে-ভয়ে ছিলাম। কিন্তু উনি এমন ব্যবহার করলেন, মনেই হল না, আজই আমায় প্রথম দেখলেন।’’

সে বার দুটি গানের রেকর্ড হয়েছিল। ‘নিজেরে হারায়ে খুঁজি’ আর ‘এ বার আমার সময় হল যাবার’। বার বার বলতেন, ‘‘নচিদা আর সলিলদার ওই চারটে গানই আমায় মাধুরী চট্টোপাধ্যায় করে দিল।’’

কী যে অমায়িক ছিলেন মাধুরীদি! এত সহজ স্বাভাবিক। গানের কলি একটু বললে, কিংবা নিজে কোনও গান নিয়ে বলতে বসলেই দু-চার কলি গেয়ে শোনাতেনই। পুরো ব্যাপারটা মিলে এত মিষ্টতা থাকত!

একবারের কথা মনে পড়ে। রাহুলদেব বর্মনের গানের রিমেক হবে। বহু নামকরা শিল্পী অংশ নেবেন। তার মধ্যে মাধুরীদিও আছেন। উনি গাইবেন ‘তোমাতে আমাতে দেখা হয়েছিল’। আমি আয়োজক।

এসে বললেন, ‘‘শোনো, তুমি আমায় একটু শিখিয়েটিখিয়ে নেবে।’’ শুনে আমি তো হা-হা করে উঠলাম, ‘‘আপনাকে আবার শেখাব কী?’’

তাতে বললেন, ‘‘না, শোনো, আসলে গানটা তো একেবারেই আমার স্কুলিং-এর নয়।’’ একটাই রিহার্সাল দিলেন। তারপর ফাইনাল টেক।

গানের শুরুতে একটা তালছাড়া অংশ আছে। আমরা মিউজিক করার সময় সেই জায়গাটা একটু ছেড়ে রাখি। ‘টেক’ যখন শেষ করলেন, দেখা গেল এক মিলিমিটারও এদিক-ওদিক হয়নি। এতটাই তৈরি হয়ে এসেছিলেন উনি।

যত আলাপ গড়িয়েছে, একটা কথা ভেবে অবাক হতাম প্রায়ই, মাধুরীদির মতো শিল্পী ফিল্মে তেমন ভাবে গান গাননি। জানতে চাইলে যা উত্তর দিয়েছিলেন, কোনও দিনই ভুলব না— ‘‘দেখো, আমার সময়ে নায়িকা বলতে সুচিত্রা, সুপ্রিয়া এঁরা। ওঁদের লিপে সন্ধ্যাদি (মুখোপাধ্যায়) এত ভাল গাইতেন, সঙ্গীত পরিচালক আমার কথা ভাববেনই বা কেন!’’

প্রায়ই বলতেন শ্যামল মিত্রের কথা। ওঁর সুরে মাধুরীদির দুটো গান অলটাইম হিট-এর তালিকায় পড়ে।— ‘খেলা ভাঙারই খেলা’ আর ‘বৃষ্টি এল বৃষ্টি’। বলতেন, ‘‘শ্যামলদা আমায় যখন গান তোলাতেন, এত যত্ন নিতেন, মনে হত, গানটা ওঁর সন্তান, তাকে তিনি তাঁর বোনের হাতে তুলে দিচ্ছেন।’’

মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় বলতে ছিলেন অ়জ্ঞান। ‘উত্তরপুরুষ’ ছবিতে মানবেন্দ্রবাবু ওঁকে দিয়ে একটা কীর্তনাঙ্গের গান গাইয়েছিলেন।— ‘একবার ব্রজে চলো ব্রজেশ্বর’। মাধুরীদির বাবা শিবনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, আর ওঁর এক গানের গুরু ছিলেন রথীন ঘোষ। এই দু’জনের কাছেই উনি কীর্তনের তালিম নিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘‘ওঁদের কাছে যা শিখেছিলাম, গানটাতে সবটুকু উজাড় করে দিয়েছিলাম। মানবদা (মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়) খুব খুশি হয়েছিলেন। সত্যিই মানবদার মতো মানুষ আর হবে না।’’

অনেকের সঙ্গে কাজ করেছেন। কিন্তু তিনজনের কাছে গান গাওয়া আর হল না। খুব ইচ্ছে ছিল, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সুধীন দাশগুপ্ত আর মান্না দে-র সুরে কাজ করার। হেমন্তবাবুকে যে জন্য চিঠিও পাঠিয়েছিলেন। উত্তর এসেছিল, ‘‘দেখবি, সময় এলে ঠিক হয়ে যাবে।’’ সে সময় আর আসেনি। আমৃত্যু সেই খেদ বয়ে বেড়িয়েছেন।

যে দিন ‘সঙ্গীত সম্মাননা’ পেলেন, ফোন করেছিলাম, কী খুশি! খুব অসুস্থ। ক্লান্ত গলা। বললেন, ‘‘জানো, এই আমার প্রথম সরকারি স্বীকৃতি। এত বছর পরে। যখন প্রায় অথর্ব হয়ে গেছি।’’

জীবনের শেষ দিকে সত্যিই খুব ভুগছিলেন। তার শুরুটার সঙ্গেও দুর্ভাগ্যক্রমে আমি জড়িয়ে। একটি সংস্থা প্রতি বছর ‘হেমন্ত শ্রদ্ধাঞ্জলি’র আয়োজন করত। সে বার নেতাজি ইন্ডোরে অনুষ্ঠান-এর রিহার্সাল। দুপুরের দিকে মাধুরীদি এলেন। একটু দূরেই আমি বসে। চোখাচোখি হল। হাসলেন। গাইলেন ‘পৃথিবীর গান আকাশ কি মনে রাখে’। অনবদ্য গাইলেন। সে দিনই বাড়ি ফেরার পথে সেরিব্রাল অ্যাটাক। হাসপাতালে ভর্তি।

সুস্থ হয়ে প্রথম যে দিন প্রথম অনুষ্ঠান করলেন, সে দিনও আমি উপস্থিত। প্রবীণ সঙ্গীত পরিচালকদের অনেককে সম্মান জানানো হবে। রবীন্দ্রসদনে। আমায় বলে রাখা হয়েছিল, মাধুরীদি আসতে পারেন। সেই অনুযায়ী মিউজিক সেট করে রাখতে।

প্রায় সবাই যখন ধরে নিয়েছেন উনি আর আসতে পারবেন না, তখনই এলেন। দুর্বল শরীর। ধরে ধরে স্টেজে বসানো হল। পিন-পড়া স্তব্ধতা তখন। আমায় ডেকে বললেন, ‘‘দেখো, লয়টা যেন বেড়ে না যায়!’’

গাইলেন দুটি গান, ‘এই তুমি আমি এক দিন চলে যাব’ আর ‘তোমায় আমায় প্রথম দেখা’। থামলেন মাধুরীদি। হাততালি আর থামতে চায় না। ছ’সাত মিনিট টানা। সবাই উঠে দাঁড়িয়েছেন। সবার চোখে জল। প্রবীণ শিল্পীরাও কাঁদছেন।

আমার পাশে বসা মাধুরীদি কিন্তু তখনও বলে চলেছেন, ‘‘ঠিক গেয়েছি তো গো?’’ আমি তখন কথা বলার মতো অবস্থায় ছিলাম না।

সাক্ষাৎকারভিত্তিক লেখা: দেবশঙ্কর মুখোপাধ্যায়

অন্য বিষয়গুলি:

sankarlal bhattacharya madhuri santonu basu
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy