সেই কোয়াসার (নীল)। বাইরে গ্যাসের মেঘ (লাল), যা বেরতে পারেনি গ্যালাক্সি থেকে। শিল্পীর কল্পনায়।
এ বার অদ্ভুত এক ঝাঁক ‘পাগলাটে’ গ্যালাক্সির খোঁজ মিলল ব্রহ্মাণ্ডে! এমন গ্যালাক্সির সন্ধান এর আগে মেলেনি কখনও। তাই তাবৎ জ্যোতির্বিজ্ঞানীদেরই চমকে দিয়েছে এই ঝাঁকে ঝাঁকে থাকা ওই গ্যালাক্সিগুলি!
দেখা গিয়েছে, বুড়োটে, অথর্ব হয়ে পড়েও অদ্ভুত আচরণ করছে গ্যালাক্সিগুলি। বার্ধক্য তাদের গ্রাস করতে পারে, কিন্তু তার পরেও বিবর্তন আর জীবনের সব নিয়মকানুনকে বুড়ো আঙূল দেখিয়ে সেই সব গ্যালাক্সি তাদের শেষ বার্ধক্যেও জন্ম দিতে পারে নতুন নতুন তারার। সেই সব নতুন তারাকে বেড়ে ওঠার জন্য ওই গ্যালাক্সিগুলি ‘ধাত্রী’র ভূমিকা নিতে পারে।
সেন্ট লুইসে গত ১২ জুন আমেরিকান অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটির (এএএস) ২৩৪তম বৈঠকে এই অভিনব আবিষ্কারের কথা জানিয়েছেন কানসাস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জ্যোতির্বিজ্ঞানী অ্যালিসন কার্কপ্যাট্রিক। গবেষকদলের অন্যতম সদস্য বস্টনের নর্থ ওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনাবাসী ভারতীয় অধ্যাপক স্বপ্নিল চৌধুরীও।
‘আনন্দবাজার ডিজিটালে’র পাঠানো প্রশ্নের জবাবে কার্কপ্যাট্রিক ও স্বপ্নিল ই-মেলে লিখেছেন, ‘‘এই প্রথম এমন ‘কোল্ড কোয়াসারে’র হদিশ মিলল। যা গ্যালাক্সির বিবর্তন সম্পর্কে আমাদের চালু ধারণাগুলিকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে।’’
‘কোয়াসার’ বলতে কী বোঝায়?
এই ঘটনার অভিনবত্ব কোথায়, বুঝতে গেলে জানতে হবে কোয়াসার আদতে কী জিনিস? কোয়াসার (কেউ কেউ উচ্চারণ করেন, ‘কোয়েজার’) আসলে একটি দৈত্যাকার ব্ল্যাক হোল বা সুপার-ম্যাসিভ ব্ল্যাক হোল। যা আমাদের সূর্যের ওজনের চেয়ে ভারী হয় কয়েক লক্ষ থেকে কয়েকশো কোটি গুণ। এমন দৈত্যাকার ব্ল্যাক হোল একটি করে সব গ্যালাক্সিতেই থাকে। রয়েছে আমাদের মিল্কি ওয়ে গ্যালাক্সিরও কেন্দ্রে। আমাদের সৌরমণ্ডল থেকে ২৬ হাজার আলোকবর্ষ দূরে। তার নাম- ‘স্যাজিটারিয়াস-এ*’।
‘কোয়াসার’: দেখুন ভিডিয়ো
আমরা জানি, ধারে-কাছে যা কিছু এসে পড়ে, তাকেই তার অত্যন্ত জোরালো অভিকর্ষ বলের টানে টেনে নেয় ব্ল্যাক হোল। এমনকী, আলোও সেই ‘নাগপাশ’ কাটিয়ে বেরিয়ে আসতে পারে না। কিন্তু ব্ল্যাক হোলের সেই ভুরিভোজের সময় প্রচুর কণা ও পদার্থ ছিটকে এসে পড়ার ফলে প্রচণ্ড শক্তির বিকিরণের জন্ম হয়। সেই বিকিরণের বলটা এতটাই জোরালো হয় যে, তা ব্ল্যাক হোলের জোরালো অভিকর্ষ বলকেও অগ্রাহ্য করতে পারে। ব্রহ্মাণ্ডের ঘন অন্ধকারে ঢাকা পড়ে যাওয়া কোয়াসারগুলিকে দেখা যায় সেই বিকিরণেই।
কোয়াসার থাকলে ঠান্ডা গ্যাস জমে কোথা থেকে?
কার্কপ্যাট্রিক ও স্বপ্নিল জানিয়েছেন, এত দিন জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের বিশ্বাস ছিল, কোনও গ্যালাক্সিতে কোয়াসারের হদিশ মেলা মানেই সেটা সেই গ্যালাক্সির পক্ষে একটি দুঃসংবাদ। কারণ, কোয়াসার তৈরি হয় ব্ল্যাক হোলের ‘নাগপাশ’ কাটিয়ে বেরিয়ে আসা অসম্ভব গরম জমাট বাঁধা গ্যাসের অত্যন্ত পুরু মেঘ থেকে। আর কোনও গ্যালাক্সিতে নতুন নতুন তারার জন্ম হওয়ার জন্য প্রয়োজন অনেক ঠান্ডা হয়ে আসা গ্যাস বা গ্যাসের মেঘ। কোনও পদার্থ যত ঠান্ডা হয়, ততই তা জমাট বাঁধতে থাকে। আর গ্যাসের পুরু মেঘ জমাট বেঁধেই জন্ম দেয় নতুন নতুন তারাদের।
গবেষকরা জানিয়েছেন, তাঁরা এগিয়েছিলেন ‘স্লোয়ান ডিজিটাল স্কাই সার্ভে’র দেওয়া তথ্যাদির ভিত্তিতে। সেই সব তথ্যের মাধ্যমেই তারা কোয়াসারগুলি খুঁজে দেখেছিলেন। রেডিও থেকে দৃশ্যমান আলো হয়ে একেবারে এক্স-রে পর্যন্ত আলোর সবক’টি তরঙ্গদৈর্ঘ্যেই।
আরও পড়ুন- গ্যালাক্সি থেকে ঘাড় ধাক্কা খেয়ে দিশেহারা হয়ে ছুটে বেড়াচ্ছে ব্ল্যাক হোল
আরও পড়ুন- সূর্যের রহস্যভেদ, আন্দিজের পাহাড়চূড়ায় উড়ল বাঙালির বিজয়পতাকা!
স্বপ্নিল বলছেন, ‘‘প্রথমে আমরা দেখি কোয়াসারগুলি ঢাকা রয়েছে ঘন গ্যাস বা গ্যাসের অত্যন্ত পুরু মেঘ ও ধুলোবালিতে। এতে আমরা অবাক হইনি। কারণ, এটা আগেও দেখা গিয়েছে। আমরা ভেবেছিলাম, কোয়াসারে কোনও গ্যালাক্সির বিলীন হয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়ায় এটা হয়তো মাঝের একটা ধাপ। ভেবেছিলাম, তখনও হয়তো কোয়াসারটি তার চার পাশের ঘন গ্যাস ও ধুলোবালির মেঘটাকে পুরোপুরি উড়িয়ে দিতে পারেনি। কিন্তু তা হলেও কোয়াসারটিকে লাল রঙের দেখাত। কিন্তু আমরা সেটিকে দেখি নীলাভ।’’
কোয়াসারের দুই প্রান্ত থেকে বেরিয়ে আসছে কণার স্রোত বা জেট
কেন নীল? প্রশ্নের উত্তরেই এল এই আবিষ্কার...
কলকাতার ইন্ডিয়ান সেন্টার ফর স্পেস ফিজিক্সের (আইসিএসপি) অধিকর্তা সন্দীপ চক্রবর্তী বলছেন, ‘‘ঘটনাটা নতুন তো বটেই। কোয়াসারের রং নীলাভ দেখা গিয়েছে মানেই বুঝতে হবে, সেই গ্যালাক্সিতে কোয়াসারের আশপাশে ঠান্ডা গ্যাস বা ধুলোবালির মেঘ জমে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে। সেই মেঘ যখনই নতুন নতুন তারার জন্ম দিচ্ছে, তখনই যে বিকিরণটা হচ্ছে, তার রং নীল। তাই নীল রং মানেই সেই গ্যালাক্সিতে শোনা যাচ্ছে যৌবনের পদধ্বনি। আর লাল রং দেখা মানেই সেই গ্যালাক্সির দিন ফুরিয়ে আসছে! সেই নীল আলোটা তৈরি হচ্ছে কারণ, সেই ছিটকে বেরিয়ে আসা অত্যন্ত গরম পদার্থ, ধুলোবালি ও গ্যাসের মেঘ আদতে বেরিয়ে যেতে পারেনি গ্যালাক্সি থেকে। সেগুলিই জমে নতুন নতুন তারার জন্ম দিচ্ছে।’’
ব্যাতিক্রম নাকি নিয়ম?
তবে স্বপ্নিল জানাচ্ছেন, এই অবস্থাটা খুব একটা দীর্ঘস্থায়ী হয় না। বড়জোর এটা হতে পারে ১ কোটি বছর ধরে। কোনও গ্যালাক্সির জীবন-চক্রের নিরিখে যা নেহাতই সামান্য বলা যায়। চোখের পাতা পড়তে যেটুকু সময় লাগে, ততটাই!
সন্দীপ বলছেন, ‘‘গ্যালাক্সির বিবর্তনের বিভিন্ন প্রক্রিয়ারই অন্যতম এই ঘটনা। এত দিন যা আমাদের চোখ এড়িয়ে গিয়েছে। কারণ, সূর্যের চেয়ে খুব বেশি ভারী কোয়াসারের বিবর্তন এর আগে সময়ের নিরিখে এতটা খুঁটিয়ে এর আগে আমরা দেখিনি। সে ক্ষেত্রে এই পর্যবেক্ষণ অবশ্যই একটি নতুন দিশা দেখিয়েছে। এই প্রক্রিয়ায় ভারী মৌল তৈরি হওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে প্রচুর পরিমাণে। ফলে, এই তারাগুলি থেকে তৈরি হওয়া গ্রহগুলিতে প্রাণের সম্ভাবনা থাকতে পারে কি না, তার খোঁজতল্লাশেও দিশা দেখাতে পারে এই পর্যবেক্ষণ।’’
ছবি ও ভিডিয়ো সৌজন্যে: নাসা
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy