মুনিরকার এই স্ট্যান্ড থেকেই বাসে উঠেছিলেন নির্ভয়ারা। ছবি: পিটিআই।
পরিকল্পিত বা অপরিকল্পিত হিংস্রতায় মানুষের কোনও তুলনা নেই। অথচ মানুষেরই সব নৃশংস কাণ্ডকারখানায় অনায়াসে ‘পাশবিক’ বিশেষণ যোগ করা দেয় মানুষ। ঘটনাচক্রে, নির্ভয়া আর তাঁর বন্ধুর জীবনের সেই ভয়ঙ্করতম রাতে জড়িয়ে রয়েছে এমন একটা সিনেমা, যা এক মানবকিশোরের একা একদল পশুর মধ্যে ঘটনাচক্রে গিয়ে পড়ার কাহিনী। এবং তার পর, একসঙ্গে বেঁচে থাকার কাহিনী। দিনটা ছিল ২০১২ সালের ১৬ ডিসেম্বর। রবিবার। ছুটির দিনে নির্ভয়া তাঁর বন্ধুর সঙ্গে নাইট শো-তে ‘লাইফ অব পাই’ দেখতে গিয়েছিলেন। দুই বন্ধুর কেউই তো জানতেন না— কোন ‘পশু’দের পাল্লায় পড়ে কোন পথে যেতে চলেছে তাঁদের নিজেদের ‘লাইফ’।
পড়াশোনা করছিলেন নির্ভয়া। ফিজিওথেরাপির চার বছরের কোর্সের লাস্ট ইয়ারে ইনটার্নশিপ চলছিল। থার্ড ইয়ার পাশ করেছিলেন ৭৩ শতাংশ নম্বর পেয়ে।
সেই রাতে দক্ষিণ দিল্লির সাকেতের একটি হল থেকে বন্ধু অবিন্দ্র প্রতাপ পাণ্ডের সঙ্গে সিনেমা দেখে যখন বেরোলেন, ঘড়িতে তখন প্রায় সাড়ে ৯টা। রাস্তাঘাটে লোকজন কম। কিছু গাড়ি চলছিল, কিন্তু বাস প্রায় নেই বললেই চলে। অটো ধরে দু’জনে চলে আসেন মুনিরকার বাস স্ট্যান্ডে। কিছু ক্ষণ পরে সেখান দিয়ে আসছিল একটি শাটল বাস। দু’জনকে দেখে দাঁড়িয়ে গেল বাসটি। দু’জনে এগিয়ে গেলেন বাসের দিকে। বাস লিফ্ট দিতে রাজি হল। নির্ভয়া এবং অবিন্দ্র ইতস্তত করেও শেষ পর্যন্ত রাজি হয়ে গেলেন। উঠে পড়লেন বাসে।
চলন্ত বাসে তখন নির্যাতন চলছে। সেই রাতের সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়া বাসের ছবি।
বাসে ওঠার পরই বিপদের গন্ধ পান দু’জন। ভিতরে বসে ছিল পাঁচ জন। চালককে নিয়ে সংখ্যাটা ছয়। বাসের ভিতরে উগ্র মদের গন্ধ। তাঁরা বাসে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই এক জন বাসের দরজাটা বন্ধ করে দিয়েছিল। সন্দেহ গাঢ় হল একটু পরেই। তাঁরা যাবেন দ্বারকা এলাকায়। কিন্তু বাস তো সে দিকে যাচ্ছে না! অন্য দিকে চলেছে।
চিত্কার করে ওঠেন অবিন্দ্র। শুরু হয় কথা কাটাকাটি, তার পর হাতাহাতি। অবিন্দ্রর সঙ্গে যখন দু’-তিন জনের এই রকম ধস্তাধস্তি শুরু হয়েছে, বাকিরা তখন নির্ভয়াকে ধরে শারীরিক হেনস্থা শুরু করে দিয়েছে। চিত্কার করে চলেছেন অবিন্দ্র। তাঁকে থামাতে দুষ্কৃতীরা অবিন্দ্রর মাথায় লোহার রডের ঘা বসিয়ে দিয়েছে। প্রতিরোধের শক্তি হারিয়ে অসহায় অর্ধচৈতন্য অবস্থাতেই দেখতে পাচ্ছেন ধীরে ধীরে নির্ভয়ার শরীরটাকে ছিঁড়ে খাচ্ছে ওই লোকগুলো। আর ছুটে চলেছে বাস।
মহীপালপুরের এখানেই বাস থেকে ছুড়ে ফেলা হয় নির্ভয়া এবং অবিন্দ্রকে। ছবি: পিটিআই।
বলির জন্য হাঁড়িকাঠে আটকানো প্রাণীর মতো হাত পা ছুড়ে বিফল প্রতিরোধের চেষ্টা চালাচ্ছিলেন নির্ভয়া। কিন্তু এতগুলো লোকের যৌথ হিংস্রতার সামনে কত ক্ষণই বা যুঝতে পারা সম্ভব! প্রতিরোধের শক্তি যখন নিঃশেষ হয়ে এল, তার পর শুরু হল পালা করে ধর্ষণ। তার মধ্যেই ছিল এক নাবালক। এবং সবচেয়ে বেশি মারমুখী ছিল এই নাবালকই। পরে পুলিশের তদন্তে উঠে আসে, এই ছেলেটিই গণধর্ষণের পর কাতরাতে থাকা নির্ভয়ার যৌনাঙ্গে মরচে ধরা একটি এল আকৃতির রড ঢুকিয়ে দিয়েছিল। তাতেও ক্ষান্ত না হয়ে, ওই রড ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে এতটাই ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছিল নির্ভয়াকে, যে তাঁর অন্ত্রের মাত্র পাঁচ শতাংশ মাত্র অবশিষ্ট ছিল। ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল যৌনাঙ্গের বাইরের এবং ভিতরের অংশ। আর মরচে ধরা ওই রডের কারণেই সেপ্টিসেমিয়ায় আক্রান্ত হয়েছিলেন নির্ভয়া। মৃত্যুও হয় তাতেই।
তখনও বেঁচে। দিল্লির হাসপাতাল থেকে সিঙ্গাপুরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে নির্ভয়াকে। ছবি: রয়টার্স।
এর পর ছিল প্রমাণ লোপাটের পালা। মদ্যপ ধর্ষকরা এর পর দরজা খুলে চলন্ত বাস থেকে মহীপালপুরের রাস্তায় ফেলে দিয়েছিল নির্ভয়া ও তাঁর বন্ধুকে। নির্ভয়ার শরীর থেকে বেরিয়ে আসা ছিন্নভিন্ন অন্ত্রের অংশও একটা প্লাস্টিক ব্যাগে ভরে ছুড়ে ফেলে দিয়েছিল রাস্তায়। মৃত্যু নিশ্চিত করতে গাড়ির চাকা দিয়ে পিষে ফেলারও চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু ওই অবস্থাতেও বন্ধু অবিন্দ্র নির্ভয়াকে জড়িয়ে ধরে গড়াতে গড়াতে কোনও রকমে ফুটপাথে উঠতে পেরেছিলেন।
কিছু ক্ষণের মধ্যেই ফুটপাথে পড়ে থাকা দু’জনকে নজরে পড়ে যায় এক পথচারীর। রক্তে ভেসে যাওয়া ফুটপাতে অর্ধমৃত অবস্থায় পড়ে থাকা তরুণ-তরুণীকে দেখেই পুলিশে খবর দেন তিনি। পুলিশ এসে দু’জনকে উদ্ধার করে সফদরজঙ্গ হাসপাতালে ভর্তি করে। কিন্তু চিকিৎসায় কার্যত কোনও সাড়া না দেওয়ায় এবং অবস্থার অবনতি হতে থাকায়, ২৭ ডিসেম্বর নির্ভয়াকে এয়ার অ্যাম্বুল্যান্সে করে নিয়ে যাওয়া হয় সিঙ্গাপুরের একটি অত্যাধুনিক হাসপাতালে। সেখানেই ২৯ ডিসেম্বর মৃত্যু হয় তাঁর।
গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ
১৬ ডিসেম্বরের সেই রাতের ঘটনা জানার পর, দেশ শুধু শিউরেই ওঠেনি, গর্জে উঠেছিল প্রতিবাদে। কখনও সেই গর্জন শোনা গিয়েছে মোমবাতি হাতে নীরব মিছিলের মুখরতায়, কখনও সোচ্চার আওয়াজে। নির্ভয়ার মৃত্যুর পর উস্কে উঠল প্রতিবাদ-বিক্ষোভের আগুন। দোষীদের দ্রুত বিচার ও ফাঁসির দাবিতে চলতেই থাকল প্রতিবাদ। তার জেরে মনমোহন সিংহের নেতৃত্বে ইউপিএ সরকার নির্ভয়ার তদন্তে গঠন করল বিচারবিভাগীয় কমিটি। নেতৃত্বে প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি জে এস ভার্মা। সেই কমিটির সুপারিশেই পরে তৈরি হয়েছিল ‘নির্ভয়া আইন’। গঠিত হয়েছিল ফাস্ট ট্র্যাক কোর্ট। সেই আদালতই ২০১৩ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর জীবিত চার সাবালক অপরাধী মুকেশ সিংহ, বিনয় শর্মা, পবন গুপ্ত এবং অক্ষয় ঠাকুরকে মৃত্যুদণ্ড দেয়। বাকি এক জন রাম সিংহ তার আগেই আত্মহত্যা করে তিহাড় জেলে। নাবালক অভিযুক্তের বিচার হয় জুভেনাইল বোর্ডে। তিন বছরের শাস্তির মেয়াদ শেষ করে সে মুক্তি পায় ২০১৫ সালে।
চার অপরাধীর সাজা কমানোর আর্জি প্রথমে দিল্লি হাইকোর্ট এবং পরে সুপ্রিম কোর্টে খারিজ হয়ে যায়। অপরাধীদের দিক থেকে এর পর দফায় দফায় কখনও রায় সংশোধন, কখনও ক্ষমাভিক্ষা ইত্যাদির আর্জি চলতে থাকে। কেটে যায় আরও অনেকটা সময়।
একে একে সব আর্জি খারিজ হয়ে যাওয়ার পর, শেষ পর্যন্ত চার জনের ফাঁসির আদেশ কার্যকর হয়ে গেল। সম্পূর্ণ হল অপরাধ থেকে শুরু করে বিচারের বৃত্ত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy