কবালের যন্ত্রণা ‘বদনামী’তে। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
যে দিকে চোখ যায়, পপলারের জঙ্গল আর আখের খেত। চড়চড়ে রোদটা পড়ে গিয়েছে ঘণ্টা দেড়েক আগেই। হাওয়া নরম হতে শুরু করেছে। সমৃদ্ধ হরিৎক্ষেত্র জুড়ে যেন রমরম করছে একটা বিকেল। ফুরফুরে আবহটা নিমেষে থম মেরে গেল রাস্তার পাশের বোর্ডটা ধীরে ধীরে বড় হয়ে উঠতেই। কবাল— বছর ছয়েক ধরে নামটা কুখ্যাত হয়ে রয়েছে আশপাশের বেশ কয়েকটা জেলায়। কিন্তু সে কুখ্যাতি সত্যের কতটা কাছাকাছি, বুকে কতখানি ভারী পাথর চাপিয়ে দিনগুলো কাটাচ্ছে কবাল, তা না জানা পর্যন্ত অনেক বিস্ময় বাকি থেকে যায়।
গ্রামের যত ভিতরে ঢুকেছে রাস্তা, ততই সঙ্কীর্ণ হয়েছে। দু’ধার থেকে ঠেসে এসেছে বাড়ি-ঘর, দোকান-দহলিজ, রোয়াক-পৈঠে। শতাব্দীর চেয়েও প্রাচীন কিছু ভীমাকৃতি ইমারত, অধিকাংশই ইট বার করা, গাঁথনি ক্ষয়ে যাওয়া, রাস্তার দিকের দেওয়ালগুলোয় কোনও জানালা নেই। পরিবারের ‘আব্রু’ রক্ষার্থেই ওই রকম ব্যবস্থা সম্ভবত। কংক্রিটের ড্রেনেজ কোনও এক কালে তৈরি হয়েছিল, এখন জায়গায় জায়গায় অবলুপ্ত। যেখানে অস্তিত্বশীল, সেখানে উপচে রয়েছে রাস্তার কোনায়, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আবর্জনার স্তূপও।
মুজফ্ফরনগর থেকে রওনা হওয়ার আগে কবাল সম্পর্কে যা শুনতে হয়েছিল এবং ভিতরে ঢুকতেই গ্রামের যে চেহারাটা নজরে এল, তাতে মন দুর্বল হওয়া অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের ঘিঞ্জি এই গ্রামে জীবনের উৎফুল্ল স্রোতটাও নাছোড়বান্দা। রবিবারের জমজমাট বিকেল, মোড়ে মোড়ে ছেলে-ছোকরার হইচই, ফুটন্ত তেলের কড়াই থেকে ঝাঁঝরিতে উঠে আসছে ছোটখাটো বাতাবি লেবুর সাইজের সিঙাড়া, ভিড় জমছে রোলের ঠেক ঘিরে। কোথাও কোনও খামতি নেই, জীবনের কোনও খাতে যেন কিচ্ছুটি কম পড়েনি।
কিন্তু কম পড়ার প্রশ্ন উঠছেই বা কেন? কী নিয়ে কুখ্যাতি কবালের? কুখ্যাতি ২০১৩ সালে মুজফ্ফরনগর এবং পার্শ্ববর্তী এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে পড়া ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক হিংসার কারণে। এই কবাল থেকেই শুরু হয়েছিল দাঙ্গাটা। আর সে প্রসঙ্গ উঠলেই মাথাটা নামিয়ে নিচ্ছেন হাজি মহম্মহ হামিদ বা রবীন্দ্র কুমার।
আরও পড়ুন: বিশ্বাসহীনতার গল্প শোনায় ‘চায়ে পে চর্চা’র গ্রাম ডাভড়ি
হাজি হামিদ (বাঁ দিক থেকে তৃতীয়)। দাঙ্গার ঘটনায় তাঁর নামে এখনও মামলা ঝুলছে।—নিজস্ব চিত্র।
প্রায় রাস্তার উপরে উঠে আসা বুক সমান উঁচু ভাঙাচোরা, ধুলো-মলিন রোয়াকে চেয়ার পেতে বকবক করছিলেন পাঁচ-ছ’জন। সবার পরনে সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবি, সবারই একগাল দাড়ি, সবার মাথায় টুপি। হামিদ এঁদের মধ্যমণি। দাঙ্গার ঘটনায় এখনও মামলা ঝুলছে তাঁর নামে। নিজেই জানালেন সে কথা। বললেন, ‘‘আমার নামে মামলা চলছে, বিক্রমের নামেও চলছে। তবে গ্রামে সমস্যা আর কিছু নেই। ও সব কথা তুলে আর লাভ নেই।’’ বিক্রম কে? বিক্রম হলেন এলাকার অমিতবিক্রম বিজেপি নেতা তথা খতৌলীর বিধায়ক বিক্রম সিংহ সাইনি।
হাজি হামিদ না হয় সাধারণ নাগরিক, বিক্রম সাইনি তো তা নন। তিনি বিধায়ক, তা-ও আবার রাজ্যের বর্তমান শাসক দলের। সেই বিক্রম এখনও রেহাই পাননি মামলা থেকে। সমস্যা নেই বললেই কি মেনে নেওয়া যাবে? হামিদ আবার জোর দিয়ে বললেন, ‘‘আমাদের গ্রামে আগেও সমস্যা ছিল না, এখনও নেই। দাঙ্গাটা করানো হয়েছিল, রাজনীতির প্রয়োজনে করানো হয়েছিল।’’ কারা করিয়েছিল? ‘‘সব পক্ষের দোষ ছিল।’’
কথোপকথনের মাঝেই ভেসে আসে আজান। হামিদরা উঠে যান রোয়াক ছেড়ে, জৈন মন্দিরটার সামনে দিয়ে এগিয়ে যান মসজিদের দিকে আর বলে যান, ‘‘বসুন, নমাজ পড়ে এসে বাকি কথা বলছি।’’
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
দাঙ্গার সময় কবাল।— ফাইল চিত্র।
নমাজিরা উঠে যেতেই কবাল আবার বুঝিয়ে দেয় তার অতিথিপরায়ণতা। বছর চব্বিশের শাহজেব উঠে আসেন নিজের দোকান ছেড়ে, আগন্তুকের একাকিত্ব দূর করতে পাশে বসে নানা গল্প করতে থাকেন। যেখানে বসে কথা হচ্ছে, তার পঁচিশ হাত দূরে ভগবতী মন্দিরের চৌপালটা থেকে ২০১৩ সালে কী ভাবে শুরু হয়েছিল সেই হিংসা, এক সাইকেল আরোহী পড়ুয়াকে একটা বাইক ধাক্কা দেওয়ার পরে এক বিকেলে কী ভাবে পর পর খুন হয়ে যেতে হয়েছিল দুই তরুণকে— সে আখ্যানও বিবৃত করেন। আর তার মাঝেই নমাজ শেষ হয়ে যায়।
‘‘যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে। ও সব নিয়ে আমরা আর ভাবি না। এখানে আর কখনও ওই রকম ঘটনা ঘটবে না। কিন্তু গ্রামটাকে বদনাম করে দিয়েছে।’’ দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন হামিদ। আর তাঁদের বিদায় জানিয়ে খানিকটা এগোতেই আশ্চর্য হতে হয় ওই একই কথার প্রতিধ্বনি শুনে। মন্দির চৌপাল থেকে বাঁ দিকে বাঁক নিয়ে ১০-১৫ কদম এগোলেই হরিজন মহল্লা। দড়ির খাটিয়ায় বসে রবীন্দ্র কুমার বলেন, ‘‘চিরকাল মিলেমিশে থেকেছি, কে হিন্দু, কে মুসলিম, কে জৈন— আলাদা করে ভাবতেই হয়নি কোনও দিন। শুধু শুধু গোটা গ্রামটা বদনাম হয়ে গেল।’’
খোলা নর্দমায় জমে থাকা জল থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে মশা উড়ছে। রাস্তার পাশে খাটাল, গোময়-গোমূত্রের বাষ্পে বাতাস ভারী। কিন্তু সে সবে কোনও সমস্যা নেই কবালের, কোনও যন্ত্রণা নেই। কবালের যন্ত্রণা ‘বদনামী’তে।
দুঃস্বপ্নটাকে ছ’বছর পিছনে ছেড়ে এসেছে কবাল। গত ছ’বছরে এক বারের জন্যও সাম্প্রদায়িক উত্তাপ ছড়ায়নি এ গ্রামে। কিন্তু দুর্নামটা তাও পিছু ছাড়েনি। ভোটের মরসুমে সেই যন্ত্রণা যত মাথাচাড়া দিচ্ছে, কবালের মহল্লায় মহল্লায় ততই কপাল খুলছে মলুক নাগরের। মলুক দাপুটে বিএসপি নেতা, বিজনৌর লোকসভা কেন্দ্রে মহাগঠবন্ধনের প্রার্থী। ছেলে-ছোকরা হোক বা শরীর ঝুঁকে যাওয়া লোলচর্ম বৃদ্ধ— কবালে অধিকাংশের মুখে মলুক নাগরের নাম। নরেন্দ্র মোদীর নামটা এলে নরম হয়ে যান, এমন লোক নেই, তা নয়। কিন্তু সংখ্যায় কম। আর মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ বা স্থানীয় সাংসদ কুঁয়র ভারতেন্দ্র সিংহের নাম শুনলেই ঠিকরে আসছে বিরক্তি।
সেই দাঙ্গার আতঙ্কিত মুখ। কাবালবাসীর মনে আজও সে স্মৃতি টাটকা।—ফাইল চিত্র।
বিজনৌর কি তা হলে এ বার বিএসপির? ‘‘বিএসপি নয়, মহাগঠবন্ধন,’’ মুচকি হাসি নিয়ে সংশোধনী প্রবীণ কুমারের। এই প্রথম বার ভোট দেবেন প্রবীণ, ভোট নিয়ে খুব উৎসাহ, আরও বেশি উৎসাহ জোট নিয়ে। তাই বিএসপি বা এসপি বা আরএলডি-র নাম আলাদা করে উচ্চারণ করতে চান না, গঠবন্ধনে জোর দেন।
মুজাফ্ফরনগর-বিজনৌর জুড়ে কি তা হলে এই রকম একতরফা ঝড়? মোটেই না। কবালের পাশের গ্রাম মালিকপুরে পুরো উল্টো স্রোত। জাঠ প্রধান মালিকপুরে গেরুয়া ঝান্ডা পতপত করে উড়ছে। আর সে কথা শুনলেই কবাল আরও ফুঁসে উঠছে। ২০১৩ সালে যিনি কবালের সরপঞ্চ ছিলেন তাঁর ছেলে গজগজ করতে করতে বলছেন ‘‘যে ছেলেটার সাইকেলে বাইকের ধাক্কা লাগায় আগুন জ্বলে গিয়েছিল কবালে, সে তো ওই মালিকপুরেরই ছিল। কিন্তু ধাক্কাটা এখানে লেগেছিল বলে দাঙ্গাটা বাঁধিয়ে দিল এখানে এসে। বদনাম হলাম আমরা।’’
দুর্নাম ঘুচবে কী ভাবে? জানে না কবাল। কিন্তু জানে যে, জাতপাত নিয়ে মাতামাতি করা চলবে না। অতএব এ গাঁয়ে বিজেপির মতোই কল্কে পাচ্ছেন না কংগ্রেস প্রার্থীও। নাসিমুদ্দিন সিদ্দিকি ছোটখাট নাম নন। গোটা উত্তরপ্রদেশ চেনে তাঁকে। আগে বিএসপিতে ছিলেন। উত্তরপ্রদেশ বিধান পরিষদের বিরোধী দলনেতা ছিলেন। এ বার বিজনৌরে কংগ্রেস প্রার্থী। রাজ্যের সবচেয়ে প্রভাবশালী সংখ্যালঘু নেতাদের অন্যতম। কিন্তু কবালের সংখ্যালঘু মহল্লার বিন্দুমাত্র উৎসাহ নেই তাঁকে নিয়ে।
এর পরেও বইতে হবে দুর্নামের বোঝা? আর কত দিন বইতে হবে? প্রশ্নচিহ্ন ঘোরাফেরা করে চোখেমুখে।
সন্ধে নেমে গিয়েছে হরিৎ ক্ষেত্রে। পপলারের পাতায় শিরশিরে আওয়াজ তুলে হালকা হাওয়া বইতে শুরু করেছে। কিন্তু সে হাওয়া কবালে ঢুকতে পারছে না যেন কিছুতেই। অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্নামের দীর্ঘশ্বাস ঘুরপাক খাচ্ছে বিজনৌরের গ্রামটায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy