অলঙ্করণ: শৌভিক দেবনাথ
প্রতি বছর ১৫ অগস্ট আমার বাবার ঠাকুমার কথা খুব মনে হয়। নেলি বেলা। সম্পন্ন বাঙালি খ্রিস্টান পরিবারে যখন তিনি জন্মেছিলেন, তখন ওই নামই ছিল তাঁর। জীবনের বিভিন্ন সময়ে তিনি জলপাইগুড়ি, কলকাতার ধর্মতলা অঞ্চলে থেকেছেন। শেষপর্যন্ত জামির লেনে (বালিগঞ্জ) থিতু হন। সেখানেই একটা বাড়ি তৈরি করিয়েছিলেন। আমাদের পারিবারের বাড়ি বলতে সেটাই। আমার শৈশবের অনেক স্মৃতিই সেই বাড়িকে ঘিরে। ১৯৬৯ সালে যখন নেলি মারা যান, আমি স্কুলে পড়ি। কিন্তু ততদিনে আমার জীবনে ভীষণ ভাবে ছাপ ফেলে দিয়েছেন সেই ব্যক্তিত্বময়ী। পরিচিত মাতৃমূর্তি— স্নেহশীল অথচ দৃঢ়। আমাদের তিন ভাইকে উনিই বাংলা শিখিয়েছিলেন।
নেলি বেলা ও’ব্রায়েন। ভারতে আসা আইরিশদের দ্বিতীয় প্রজন্মের সঙ্গে বিবাহসূত্রে ওই নামে পরিচিত হন। আমার সেই কচি মনে তিনি ছিলেন এক চলমান ইতিহাস। অপাপবিদ্ধ ছোট্ট আমি-র চোখে যেন মাদার ইন্ডিয়া। ১৯৪৭ সালে অগস্টে যখন দেশ ভেঙে দু’টুকরো হল, একটা মিলেমিশে থাকা সমাজ চিরদিনের মতো বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল, সেদিন তিনি একাকী নীরবে চোখের জল ফেলেছিলেন।
নেলি ১৯৪৭ –এ কেঁদেছিলেন। তার পর কেঁদেছেন প্রতিদিন। ’৪৭ থেকে ’৬৯— জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। ভারতের মাটিতে যে রেখা টেনে দিয়েছিল বিভাজন, তার জন্য কেঁদেছেন। সেই সঙ্গে তাঁর চোখ ভিজে উঠত প্রথম সন্তান প্যাট্রিকের জন্য। যিনি বিভাজনের পর প্রথমে পেশাওয়ারে পরে লাহৌরে বসবাস করতেন।
আসলে দেশভাগের ইতিহাস সর্বত্রই লেখা হয়েছে এই উপমহাদেশের হিন্দু-মুসলমানের প্রেক্ষিত থেকে। খ্রিস্টানদের ভূমিকা সেখানে সামান্যই। আমি যে অ্যাংলো ইন্ডিয়ান গোষ্ঠীর প্রতিনিধি, সেটা ভারতে বসবাসকারী খ্রিস্টানদের একটা ক্ষুদ্র অংশমাত্র। এই বিশাল কর্মকাণ্ডের পাশেপাশে চলা একটা প্রায় চোখে না পড়া অংশ।
তবু দেশভাগের নাটকীয় প্রভাব পড়েছিল আমাদের বৃহত্তর পরিবারে। আমার ঠাকুর্দা অ্যামোস, নেলির দ্বিতীয় সন্তান। ওরা তিন ভাই ছিলেন। বড় ভাই প্যাট্রিক ছিলেন সিভিল সারভেন্ট। পেশওয়ার এবং লাহৌরে কাটিয়েছিলেন অনেকদিন। কর্মজীবনে একসময় তিনি নর্থইস্ট ফ্রন্টিয়ার প্রভিন্সের গভর্নর ওলাফ ক্যারো এবং পরবর্তীকালে স্যর জর্জ ক্যানিংহামের ব্যক্তিগত সহকারী হিসাবে কাজ করেছেন। তাঁর বাকি জীবন অবশ্য কেটেছিল কলকাতায়, আমার ঠাকুমার সঙ্গে।
একদিন, এই ও’ব্রায়েন পরিবারই ভিন্ন ভিন্ন দেশের নাগরিক হয়ে গেল। হয়তো সেই সিদ্ধান্তের ফল যে কতটা সুদূরপ্রসারী হতে পারে তার কথা না ভেবেই। কয়েকমাসের মধ্যেই যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে। পাকিস্তানে রইলেন সেই প্যাট্রিক। তাঁর পরিবার ছিল আকারে বেশ বড়। তাঁর এক মেয়ের বিয়ে হয় এক ফাইটার পাইলটের সঙ্গে। ভারতীয় বায়ুসেনার সঙ্গেই থেকে গিয়েছিলেন তিনি। সেই পাইলটের আরেক ভাইও ফাইটার পাইলট ছিলেন। তিনি চলে গেলেন পাকিস্তান এয়ারফোর্সে।
।। ২ ।।
নেলির কষ্টটা একবার ভাবুন। ভাবুন তাঁর সেই নাতনির কথা, যিনি ভারতে রয়ে গেলেন। আমার বাবার জাঠতুতো বোন। আমি শুনেছি, রাতের পর রাত তিনি কাটিয়েছেন এই দুশ্চিন্তায়, তাঁর স্বামী ঘরে ফিরবেন, না তাঁর দেওর। হয়তো ভাবতেন অন্য এক সম্ভাবনার কথাও। যদি দুই ভাই একই পক্ষে থাকতেন তা হলেই বা কী ক্ষতি ছিল! কয়েকমাস আগেও ওঁরা যেমন ছিলেন। তা হলে হয়তো, বিক্ষুব্ধ আকাশের বুকে পরস্পরের মুখোমুখি হতে হত না।
সৌভাগ্যের কথা, যুদ্ধে এঁদের কেউই মারা যাননি। তবে একটা দূরত্ব তৈরি হয়েছিল। বাবা-মেয়ের মধ্যে, বোনের সঙ্গে বোনের, তুতো ভাইয়েদের মধ্যে। আমার ঠাকুর্দা এবং তাঁর পাকিস্তানি ভাই, নেলি এবং তাঁর ছেলে প্যাট্রিকের মধ্যে যোগাযোগ কার্যত ছিন্ন হয়ে যায়।
আমি এবং আমার ভাইয়েরা সম্পূর্ণ আলাদা একটা পরিবেশে বড় হয়েছি। কলকাতার মধ্যবিত্ত হিন্দু অধ্যুষিত একটা পাড়ায়। আমরাই ছিলাম পাড়ার একমাত্র খ্রিস্টান পরিবার। যে রাস্তার ধারে আমাদের বড়ি, সেটা আবার একজন মুসলিম ব্যক্তির নামে। এটা ভারতেই সম্ভব। যার জন্য দেশটা এত চিত্তাকর্ষক।
নেলি ১৯৩৮ সালে বড়িটা বানান। তাঁর জীবনটা খুব সহজ ছিল না। অল্প বয়সে স্বামীকে হারিয়েছিলেন। তখন মাথার উপর তিন সন্তানকে মানুষ করার দায়িত্ব। তবে সেসব দায়িত্ব পালন করেও তিনি ডাক্তারি পড়তে শুরু করেন। ভেতরে একটা দৃঢ় সংঙ্কল্প ছিল। কলকাতার মেডিক্যাল কলেজে প্রথম দিকের দু’চার জন মহিলা শিক্ষার্থীর মধ্যে তিনিও ছিলেন একজন। পরবর্তীকালে চিকিৎসক হিসাবেও নামডাক হয়। ভাল পসার জমাতে পেরেছিলেন বলেই এই বড়িটা বানাতে পেরেছিলেন সেদিন। যা আজও আমাদের পারবারিক আবাস। হোম।
১৯৪০ সালে ‘গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং’ বা দেশভাগের প্রাক্কালে এই শহরে তখন দাঙ্গা চলছে। সেই দাঙ্গাবিধ্বস্ত শহরে তিনি একা একাই শিয়ালদহ থেকে বালিগঞ্জ রেললাইন বরাবর বহু জায়গায় চিকিৎসা করতে যেতেন। কেউ কখনও তাঁর পথ আটকে দাঁড়ায়নি। না হিন্দু, না মুসলিম। গলায় ঝোলানো স্টেথোস্কোপটি ছিল তাঁর বিশ্বাসযোগ্যতা। তাঁর দৃপ্ত পদক্ষেপ দেখে তাঁর উদ্দেশ্য নিয়ে মানুষ কোনওদিন সন্দেহ করেননি। তাঁকে কোথাও থেমে যেতে হয়নি বা অন্যত্র চলে যেতে হয়নি।
নেলি বেলা ও’ব্রায়েন ১৯৬৯ সালে ৭৮ বছর বয়সে মারা যান। তাঁর শেষ শয্যা ঘিরে রেখেছিলেন শোকসন্তপ্ত সন্তান, নাতিপুতিরা। তাঁর শেষযাত্রায় শামিল হয়েছিলেন জামির লেনের প্রতিবেশীরাও। তিনি তো শুধু আমার বাবার ঠাকুমা ছিলেন না, ছিলেন সকলের। সেদিন শয্যার পাশে শুধু ছিলেন না প্যাট্রিক। যে সন্তানকে মা দেখেননি ২৩ বছর।
।। ৩ ।।
সময় চলে যায়। ১৯৮৪ সাল। আমার ভাই অ্যান্ডি তখন ক্রীড়াসাংবাদিক। হকি চ্যাম্পিয়নস ট্রফি কভার করতে করাচি গিয়েছিল। মনে মনে ঠিক করেছিল, পাকিস্তানে ও’ব্রায়েনদের হারিয়ে যাওয়া শাখাটিকে খুঁজে বার করবেই। কী আশ্চর্য, শেষমেশ খুঁজেও পেয়েছিল। আবার নতুন করে যোগাযোগ তৈরি হল। বাবার জ্যাঠামশাই প্যাট্রিক ততদিনে মারা গিয়েছেন। তবে পরিবারের বাকিরা ছিলেন সকলেই। তাঁরা এই ভারতীয় তুতো ভাইটিকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানাতে ভেলেননি। এখনও তাঁরা জামির লেনের এই বাসস্থানকে ‘বাড়ি’ বলেই উল্লেখ করেন। পাকিস্তানে বসবাসকারী নেলির প্রপৌত্র-পৌত্রীদের কাছেও তিনি আজও কিংবদন্তী।
যাইহোক, এর পাশাপাশি একটা অন্যতর বাস্তব আছে। পাকিস্তানে আমার বাবার প্রজন্মের যাঁরা ছিলেন, তাঁদের বেশিরভাগ পুরুষই ইংল্যন্ড বা কানাডায় চলে গিয়েছেন। আর ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলিম হয়েছেন মহিলারা।
অ্যান্ডি ফিরে এসে পাকিস্তানে অ্যাংলো ইন্ডিয়ান পরিবারের সেই করুণ কাহিনি বলেছিল। শুধু অ্যাংলো ইন্ডিয়ান বললে হয়তো ঠিক বলা হয় না। বলা উচিত, লাহৌর এবং করাচির মুসলিম-আইরিশ-বেঙ্গলি ক্ল্যান।
অ্যান্ডির কথা শুনে আমরা চুপচাপ বসেছিলাম। হৃদয়ঙ্গম করতে বেশ সময় লেগেছিল সেদিন। ভাবছিলাম ভারতে আমাদের অতিবাহিত সময়ের কথা, জীবনের কথা। আমাদের চার্চে যাওয়ার স্বাধীনতা, আমাদের নিজস্ব বিশ্বাস মেনে রীতিনীতি পালনের কথা, নিজেদের মতো জীবনযাপনের স্বাধীনতার কথা, এই দেশে সংখ্যালঘুরা যে স্বাধীনতা ভোগ করেন, তার কথা। বলতে কী, একজন ভারতবাসী হিসাবে আমি যতটা গর্ববোধ করি, বোধহয় আর কোনও কিছুতেই ততটা করি না।
মাঝেমাঝেই পাকিস্তানে বসবাসকারী আমার ভাইদের কথা মনে হয়। তারা কি মূলধারার রাজনীতিতে যোগ দিতে পারবে কোনওদিন? বিশেষত আমাকে যে ভাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আন্দোলনে গ্রহণ করা হয়েছে? তাদের কি সেভাবে গ্রহণ করবে কেউ? সম্মানিত আর পাঁচজন রাজনীতিকের মতো তাঁরা কি পাক সংসদে পা রাখার সুযোগ পাবে কোনওদিন?
আমি মনে করি, আমি ভাগ্যবান। আমি ভাগ্যবান, নেলি আমাকে উৎসাহিত করেছিলেন বাংলা শিখতে, পাড়ার সরস্বতী পুজোয় অংশগ্রহণ করতে। উনি আমাকে বলতেন, ‘‘এটা জ্ঞান আর শিক্ষার উৎসব।’’ আমাকে উৎসাহ দিতেন, আমাদের বৃহত্তর গোষ্ঠীর সঙ্গে মিশে যেতে। আমি ভাগ্যবান, ভারত এবং বাংলা আমাকে এ সবই করতে দিয়েছে বিনা বাধায়, কোনও রকম অন্যায় প্রত্যাশা ছাড়াই। আমি ভাগ্যবান, এই ভারতের নেলির কাছে লালিতপালিত হয়েছি, বেড়ে উঠেছি নেলির ভারতে।
জয়তু স্বাধীনতা দিবস।
( এটা আমি লিখেছিলাম সাত বছর আগে। স্বাধীনতা দিবস ২০১৯-এ আরও একবার সেটাই তুলে দিলাম। একটা দেশের জীবনে সাতটা বছর দীর্ঘ সময়। অনেক কিছু অপরিবর্তিত রয়ে গিয়েছে। আবার বদলে গিয়েছে অনেক কিছুই।)
অলঙ্করণ: শৌভিক দেবনাথ
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy