সদর হাসপাতালের ব্লাড ব্যাঙ্কের সামনে দাওয়ায় শুকনো মুখে বসেছিলেন আড়শা থানার পাতুয়াড়া গ্রামের বাসিন্দা বিশ্বজিত্ গড়াই। তাঁর ছেলে থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত। রক্তের প্রয়োজন। কিন্তু পুরুলিয়া সদর হাসপাতালের ব্লাড ব্যাঙ্ক জানাচ্ছে, তাঁদের ভাঁড়ারে রক্ত নেই।
বেশ কয়েক মাস ধরেই রক্তাল্পতায় ভুগছে পুরুলিয়া জেলার একমাত্র এই ব্লাড ব্যাঙ্ক। বুধবারই বাঘমুণ্ডির বাসিন্দা মাস পাঁচেকের একটি শিশুকেও রক্ত দিতে পারেনি এই ব্লাড ব্যাঙ্ক। শিশুটির অবস্থা দেখে নিজেই রক্ত দেন হাসপাতালের সহকারী সুপার শান্তুনু মুখোপাধ্যায়। কোনও ভাবে সে দিন রক্তাল্পতায় ভোগা শিশুটিকে বাঁচানো গেলও হাসপাতালের ব্লাড ব্যাঙ্কের রক্তাল্পতা কী ভাবে কাটিয়ে ওঠা যাবে, তার কোনও দিশা দেখতে পাচ্ছেন না স্বাস্থ্যকর্তারা।
হাসপাতালের ব্লাড ব্যাঙ্ক সূত্রে জানা গিয়েছে, জেলার একমাত্র ব্লাড ব্যাঙ্ক হওয়ায় এখানে প্রতি মাসে গড়ে ৮০০ ইউনিট বা প্যাকেট রক্তের চাহিদা রয়েছে। এ দিকে এই জেলার থ্যালাসেমিয়া রোগীর সংখ্যাও কমবেশি ৪৫০। তাঁদেরও রক্তের চাহিদা রয়েছে। এরপর রয়েছে অন্যান্য রোগীদের চাহিদা। অথচ জেলার বিভিন্ন এলাকায় স্বেচ্ছায় রক্তদান শিবিরের সংখ্যা গত এক বছরে বেশ কমে গিয়েছে। পুজোর পর থেকে শিবির কিছুটা বাড়লেও তারপর থেকে শিবিরের সংখ্যা বেশ কমে গিয়েছে।
গত বছরের অগস্ট মাসে জেলার ১৫টি শিবির থেকে ৭০৮ ইউনিট রক্ত পাওয়া গিয়েছিল। সেপ্টেম্বর মাসে ১৪টি শিবির থেকে ৫৬৯ ইউনিট রক্ত মেলে। অক্টোবরে তা আরও কমে যায়। ওই সময় দুর্গাপুজো থাকলেও আশ্চর্যজনক ভাবে শিবির খুব কম হয়েছে। মোটে ৩টি শিবির হয়। সেখান থেকে মাত্র ১৩০ ইউনিট রক্ত পাওয়া যায়। অথচ কয়েক বছর আগেও পুজো ও শীতকালে রক্তদানের প্রচুর শিবির হতো। নভেম্বরে শিবির বেড়ে হয় ৫টি। জোগাড় হয় ২৭১ ইউনিট রক্ত। ডিসেম্বর মাসে ৮টি শিবির থেকে ৪৩৯ ইউনিট রক্ত পাওয়া যায়। ব্লাড ব্যাঙ্কের মেডিক্যাল অফিসার সান্ত্বনা দত্তের কথায়, “এই যদি পরিস্থিতি হয়, তা হলে ব্যাঙ্ক চালাতে কী অবস্থা হচ্ছে তা সকলেই অনুমান করতে পারবেন।
এই সঙ্কটের কারণ কী? ব্লাড ব্যাঙ্কের যে সব কর্মী শিবিরে রক্ত সংগ্রহ করতে যান, তাঁদের অভিমত, নতুন করে রক্তদানে আগ্রহী সংগঠক উঠে আসছে না। ফলে এই সঙ্কট থেকে মুক্তি কঠিন হয়ে উঠেছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে যাঁরা রক্ত চাইতে আসছেন, তাঁদের দাতা নিয়ে আসতে বলা হচ্ছে। গত বছরে প্রায় ১৭০০ দাতার রক্ত নিয়ে তাঁদের পরিজনদের দেওয়া হয়েছে। তার আগের বছর (২০১৩ সাল) এই সংখ্যাটা ১০০০ ছিল। অথাত্ রক্তের সঙ্কট ক্রমশ বাড়ছে।
জেলার যে সংগঠনগুলি নিয়মিত স্বেচ্ছায় রক্তদান শিবিরের আয়োজন করে তার অন্যতম একটি সংস্থার কর্ণধার সন্দীপ গোস্বামীর কথায়, “আমরা অনেকদিন ধরেই শিবির করে আশছি। কিন্তু দেখেছি রক্তদানে আগ্রহী করার ব্যাপারে প্রচারের ঘাটতি রয়েছে। এ জন্য সরকার কোনও বরাদ্দও করে না। কোনও পোস্টার বা প্রচারপত্রও বিলি করা হয় না।” তাঁর অভিযোগ, আগে রক্তদাতাদের জামায় আটকানোর জন্য একটি পিতলের ব্যাজ দেওয়া হতো। রক্তদাতারা ওই ব্যাজটি অত্যন্ত সম্মানজনক বলে মনে করতেন। কিন্তু সেই ব্যাজ সরবরাহ প্রায় এক বছর বন্ধ। এ ছাড়া দূরে শিবির করে সেখান থেকে রক্ত নিয়ে আসার জন্য গাড়ির জ্বালানিও তেমন মেলে না। হাসপাতাল সূত্রের খবর, দূরের শিবির থেকে রক্ত আনার জন্য শিবির প্রতি ৫০ লিটার বরাদ্দ রয়েছে। এক স্বাস্থ্য কর্মীর প্রশ্ন, “এই জ্বালানিতে কতটুকু যাওয়া যায়? দূরের শিবির হলে যে সংস্থা আয়োজন করে, তাদেরই জ্বালানির ব্যয়ভার বহন করতে হবে।”
জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক মানবেন্দ্র ঘোষ জানাচ্ছেন, জেলার জনসংখ্যার নিরিখে যদি এক শতাংশের কম মানুষও রক্তদানে এগিয়ে আসেন, তাহলেই ব্লাড ব্যাঙ্কে রক্তের কোনও অভাব থাকবে না। তা হলে কেন এই হাল? সিপিএমের যুব সংগঠন ডিওয়াইএফ রাজ্যে বামফ্রন্ট ক্ষমতায় থাকার সময় সারা বছরভর রক্তদানের কর্মসূচি চালাত। কোথায়, কবে শিবির করা হবে তা নিয়ে আগে ক্যালেন্ডারও তারা প্রকাশ করত। কিন্তু ওদের সেই শিবির বছর দুয়েক ধরে বন্ধ। ওই সংগঠনের জেলা সভাপতি বিমলেন্দু কোনারের কথায়, “নানা কারণে আমরা শিবিরগুলি বন্ধ করেছি। তারমধ্যে রাজনৈতিক কারণও ছিল। তবে এই বছর থেকে ফের শিবির করব।” যুব তৃণমূলের জেলা সভাপতি গৌতম রায়ের কথায়, “আমরা বিক্ষিপ্ত ভাবে রক্তদান শিবিরের আয়োজন করি। তবে নিয়মিত নয়। আমরাও ভাবছি এ বার থেকে আরও বেশ কিছু শিবির করব।” তাঁরা আশ্বাস দিলেও বাস্তবে ক’ফোঁটা রক্ত ব্লাড ব্যাঙ্কে জমা হয়, আগামী দিন বলবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy