সরকারি হাসপাতালের নন-প্র্যাকটিসিং পদে থেকে চিকিৎসকদের প্রাইভেট প্র্যাকটিস করার নজির এর আগেও মিলেছে। কিন্তু এ বার তাতে জড়াল খোদ স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের নাম। মিলল লিখিত প্রমাণও। উপাচার্য ভবতোষ বিশ্বাস অবশ্য অভিযোগ নস্যাৎ করে পাল্টা যুক্তি দিয়েছেন, “আপনারা খোঁজ নিয়ে দেখুন আমি উপাচার্য হিসেবে আমার কাজটা সঠিক ভাবে করছি কি না।”
কিন্তু উপাচার্যের কাজ ‘ঠিকমতো’ করুন বা না করুন, বিষয়টি যে সরকারকে যথেষ্ট বিড়ম্বনায় ফেলেছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য বলেছেন, “আচমকা বিষয়টা শুনলাম। এ নিয়ে এখনই কিছু বলা সম্ভব নয়।” স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্তব্য, “তা কী করে হয়? এটা তো নন-প্র্যাকটিসিং পদ!”
কিন্তু প্রশ্ন উঠছে আরও একটি বিষয়ে। তা হল ব্যস্ত, পেশাদার ডাক্তারদের প্রশাসনিক পদে বসানোর সিদ্ধান্ত কি ঠিক? যাঁরা ব্যস্ত ডাক্তার, তাঁদের রোগী দেখার চাপ থাকে। রোগীদেরও তাঁদের জন্য চাহিদা থাকে। যে কারণে বাম আমলে সরকারি ডাক্তারদের প্রাইভেট প্র্যাকটিস বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েও সরকারকে তা শিথিল করতে হয়েছিল। সেই ব্যবস্থাই এখনও চলছে। কিন্তু উপাচার্য তো নিছক কোনও আলঙ্কারিক পদ নয়। উপাচার্যের চেয়ারটি মর্যাদার প্রতীক। তাই আর পাঁচ জনের ক্ষেত্রে যে শিথিলতা কার্যকর হয়, উপাচার্যের মতো পদাধিকারীর ক্ষেত্রে তা বর্তায় না। আর সেই জন্যই এই পদটিকে নন-প্র্যাকটিসিং রাখা হয়েছে। প্রশ্নটাও সেখানেই। ব্যস্ত ডাক্তারদের এমন নন-প্র্যাকটিসিং পদে বসানো হবে কেন?
স্বাস্থ্যকর্তারা জানাচ্ছেন, ব্যস্ত ডাক্তারদের অনেকেই আবেদন করেছেন। ভবতোষবাবুর যোগ্যতা মিলে যাওয়ায় ওঁকে বেছে নেওয়া হয়েছে। সে ক্ষেত্রে প্রশ্ন হল, এমন আবেদন বিবেচনা করা হবে কেন? যিনি মাঠে ভাল খেলছেন, তাঁকে মাঠ থেকে তুলে কোচ করে দেওয়ার যুক্তি কী? তা হলে কি তিনি কোনও দায়িত্বের প্রতিই সুবিচার করতে পারবেন?
স্বাস্থ্য দফতরের এক শীর্ষ কর্তার কথায়, “এই ঘটনায় সরকারের মাথা হেঁট হয়ে গেল। এই পদে বসানোর আগে আমরা বারবার জানতে চেয়েছিলাম, কেরিয়ারের তুঙ্গে থেকে এ ভাবে প্র্যাকটিস ছেড়ে দিতে আপত্তি নেই তো? উনি স্পষ্ট ভাবেই জানিয়েছিলেন, প্র্যাকটিস করবেন না। তার পরেও এমন কথার খেলাপ মেনে নেওয়া যায় না। আমরা ঠেকে শিখলাম।”
গত ১৭ অগস্ট ভবতোষবাবুকে উপাচার্য পদে বসানোর সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছিল স্বাস্থ্য দফতর। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আস্থাভাজন’ বলে পরিচিত কার্ডিওথোরাসিক সার্জন ভবতোষবাবু এর আগে আর জি করে হার্ট ইনস্টিটিউটের প্রধান ছিলেন। সেখানেও সরকারি কাজে পুরো সময় না দিয়ে বেসরকারি হাসপাতালে প্র্যাকটিস ও অস্ত্রোপচারে তিনি বেশি মনোযোগী হচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠত। উপাচার্য পদে তাঁকে নিয়োগের সিদ্ধান্ত ঘোষণা হওয়ার পরে সেই পুরনো প্রসঙ্গ সামনে এনেছিলেন অনেকেই। তখন অবশ্য স্বাস্থ্যকর্তারা সেই অভিযোগকে আমল দিতে চাননি। কিন্তু এ বার উপাচার্য পদে কাজ শুরু করার পরেও ফের ভবতোষবাবুর প্রাইভেট প্র্যাকটিসের খবর তাঁদের অস্বস্তিতে ফেলেছে।
আলিপুরের এক হার্ট রিসার্চ সেন্টারে ভবতোষবাবু নিয়মিত রোগী দেখেন এবং অস্ত্রোপচার করেন বলে এখনও ঘোষণা করা আছে তাদের ওয়েবসাইটে। কোন্নগরে এবং সল্টলেকে তাঁর চেম্বার রয়েছে বলে জানা গিয়েছে। বালিগঞ্জ ফাঁড়ির কাছে এক নার্সিংহোমেও তিনি রোগী দেখেন। রবিবার সকালে তাঁকে সেখানেই পাওয়া গিয়েছিল। সকাল ১০টা থেকে বসার কথা ছিল। তিনি এলেন ১২টা নাগাদ। জানা গেল, বিকেল পর্যন্ত রোগী দেখবেন তিনি। রোগীরা জানালেন, সপ্তাহের অন্য দিন দুপুর এবং সন্ধ্যার দিকে আলিপুরের হাসপাতালেই বেশি পাওয়া যায় তাঁকে।
সপ্তাহের সাত দিনই প্রাইভেট প্র্যাকটিস চালিয়ে স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ করেন কখন? ভবতোষবাবুকে এই প্রশ্ন করা হলে তিনি উত্তেজিত হয়ে পাল্টা প্রশ্ন করেন, “আমার গায়ে কাদা ছেটানোর চেষ্টা কারা করছে? তাদের নাম কী? কাকে কান নিয়ে গিয়েছে শুনলেই কি আপনারা কাকের পিছনে ছুটবেন?” তা হলে কি প্রাইভেট প্র্যাকটিস চালানোর বিষয়টা অস্বীকার করছেন? ভবতোষবাবুর জবাব, “আপনারাই তদন্ত করে দেখুন।” একই সঙ্গে তাঁর সংযোজন, “স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের আগের উপাচার্যদের আমলে কী হয়েছে, আর আমি কী কাজ করছি তার তুলনা করে দেখুন। তা হলেই উন্নতিটা বুঝতে পারবেন।”
স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে বছর কয়েক ধরেই নানা বিতর্কে জড়িয়েছে রাজ্য। সদ্য-প্রাক্তন উপাচার্য অমিত বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্যের স্বাস্থ্যনীতি নিয়ে গত তিন বছর রাজ্য সরকারের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়েছেন। সম্প্রতি এমসিআই রাজ্যের বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজের আসন বাতিল করার পরে রাজ্যের মেডিক্যাল শিক্ষার পরিকাঠামো নিয়ে সোচ্চার হয়েছিলেন তিনি। তাঁর মেয়াদ ফুরোনোর পরে ভবতোষবাবুকে উপাচার্য বেছে নেওয়ার সিদ্ধান্তে সরকারের সাবধানী মনোভাবই প্রতিফলিত হয়েছে বলে মনে করেছেন অনেকে।
স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্য প্রাক্তন উপাচার্য অমিত বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন সম্মানজনক পদে থেকে এটা যে কেউ করতে পারেন, সেটাই অবিশ্বাস্য।” আর এক প্রাক্তন উপাচার্য প্রদীপকুমার দেব বলেন, “আমি নিজে এটা করতাম না। ব্যস, এর বাইরে কিছু বলার নেই।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy