বাচ্চা কাঁদছে। শুধুমাত্র মায়ের দুধে কি আর পেট ভরে!
মায়ের দুধের চেয়ে বাজারচলতি কৃত্রিম দুধের পুষ্টিগুণ অনেক বেশি।
স্তন্যপান করালে ওজন বেড়ে যাবে যে! ফিগারও নষ্ট হবে।
অথচ চিকিৎসকেরা সব সময়েই বুঝিয়ে এসেছেন, বাস্তবটা উল্টো। জন্মের পরে প্রথম ছ’মাস শুধু স্তন্যপান করালে শিশুর যথাযথ পুষ্টি, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাবৃদ্ধি তো বটেই, মায়ের ওজন বাড়া বা ফিগার নষ্ট হওয়ার বদলে বরং তাঁদেরও ফ্যাট ঝরে অনেক তাড়াতাড়ি। এ নিয়ে প্রচারও হয়েছে নিয়মিত। গত ২২ বছর ধরে বিশ্ব জুড়ে ফি বছর অগস্ট মাসের ১ থেকে ৭ তারিখ সপ্তাহভর সচেতনতা শিবির, আলোচনাচক্র। কিন্তু বোঝানো আর সচেতনতায় মিলমিশ হচ্ছিল না সে ভাবে। ফলে বছর কয়েক আগে পর্যন্তও পুরনো ধারণাগুলোই ঘুরে বেড়াত ঘরে ঘরে। স্তন্যপান নিয়ে ভারত তথা গোটা বিশ্বেই ভুল ধারণাগুলো জাঁকিয়ে বসেছিল বহুদিন। ফলে ছ’মাসের ঢের আগেই শিশুকে কৃত্রিম দুধ, বাজারচলতি শিশুখাদ্য বা অন্য খাবারে অভ্যস্ত করিয়ে ফেলতেন বহু মা-ই।
অবশেষে পাল্টাচ্ছে ছবিটা। ২৩তম আন্তর্জাতিক স্তন্যপান সপ্তাহ পেরিয়ে চিকিৎসক থেকে মায়েরা নিজেরা সকলেই মানছেন ভুল ধারণার দেওয়াল ভাঙা গিয়েছে অনেকটাই। মাতৃদুগ্ধের উপকারিতা উপলব্ধি করে অধিকাংশ মায়েরাই এখন চিকিৎসকদের পরামর্শ মতো ছ’মাস শিশুকে শুধু স্তন্যপানই করাচ্ছেন। তার ফলে এ দেশে এক্সক্লুসিভ ব্রেস্টফিডিং-এর হারও বাড়ানো গিয়েছে খানিকটা। কমেছে রোগে বা অপুষ্টিতে শিশুমৃত্যুর হার। এ রাজ্য বা কলকাতার ছবিটাও তার থেকে এতটুকু আলাদা নয়। এ প্রজন্মের মায়েরা অনেক বেশি সচেতন হয়ে যাওয়ায় ছ’মাস এক্সক্লুসিভ ব্রেস্ট ফিডিং-এর হারও বাড়ছে যথেষ্টই।
২০০৩ সালের একটি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ভারতে ছ’মাস একটানা শুধু স্তন্যপান করাতেন ২০ শতাংশ মা। অপুষ্টি বা রোগে ০-৫ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুমৃত্যুর হার ছিল প্রতি হাজারে ৯৫। শহর-শহরতলি-গ্রাম সর্বত্রই সচেতনতা বাড়ায় খানিকটা বদলে ফেলা গিয়েছে পরিসংখ্যান। দীর্ঘদিন ধরেই মাতৃদুগ্ধের উপকারিতার প্রচার এবং সচেতনতা কর্মসূচিতে যুক্ত চিকিৎসক পার্বতী সেনগুপ্ত বলেন, “অনেক ক্ষেত্রেই সন্তান কাঁদলে বা কম খেলে মা ভেবে ফেলেন তার পুষ্টির জন্য স্তন্যপান যথেষ্ট হচ্ছে না। এই ধরনের ধারণা ভেঙে সচেতনতা তৈরির জন্য চিকিৎসক-নার্সদের দল গড়ে বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। তাঁরাই অন্তঃসত্ত্বা এবং মায়েদের কাউন্সেলিং করেন।” পার্বতীদেবী জানাচ্ছেন, ফল মিলেছে তাতে। এ বছর ভারতে ছ’মাস পর্যন্ত এক্সক্লুসিভ ব্রেস্টফিডিং-এর হার হয়েছে প্রায় ২৪-২৫ শতাংশে। বাংলায় সেই হার আরও বেশি। অন্নপ্রাশনের নিয়ম থাকায় ছ’মাস থেকে ন’মাস বয়সে এ রাজ্যে সাধারণ খাদ্যাভ্যাস গড়ে উঠেছে প্রায় ৮০ শতাংশ শিশুর। ফলে শিশুমৃত্যুর হার কমে দাঁড়িয়েছে ৭৪-এ।
কলকাতার তিরিশের গৃহবধূ নন্দিনী যেমন ছ’মাসই টানা স্তন্যপান করিয়েছেন মেয়েকে। বললেন, “সন্তানের জন্য এটা বড্ড জরুরি। মায়ের জন্যও।” এক বছরের সন্তানের মা নম্রতা চাকরি করেন বেসরকারি সংস্থায়। ওয়ার্ক ফ্রম হোম পদ্ধতিতে বাড়ি থেকেই অফিসের কাজ সামলে সন্তানকে ছ’মাস টানা স্তন্যপান করিয়েছেন তিনিও। দু’জনেই জানালেন তাঁদের পরিচিত সকলেই এখন শারীরিক বাধা না থাকলে ছ’মাসের এক্সক্লুসিভ ব্রেস্ট ফিডিংয়ের দিকে ঝুঁকছেন।
স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ সুজাতা দত্ত বলছেন, “ছ’মাস শুধুমাত্র স্তন্যপানে শিশুর সঠিক পুষ্টির পাশাপাশি জ্বর-সর্দিকাশি, পেটের গণ্ডগোল, হাঁপানি, ত্বকের সমস্যা জাতীয় রোগে শিশুর আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা কমে। ছ’মাস টানা স্তন্যপান করালে মায়ের গর্ভাবস্থার বাড়তি ফ্যাটও ঝরে তাড়াতাড়ি। শারীরিক গঠনও ঠিক থাকে।” আগের চেয়ে অনেক মা-ই এখন ভুল ধারণা ঝেড়ে ফেলছেন বলেই জানালেন তিনি।
ওজন বেড়ে যাওয়া, শারীরিক গঠন বা ফিগার খারাপ হয়ে যাওয়ার ভয়টা সবচেয়ে বেশি ঘিরে ধরে মডেলিংয়ের দুনিয়ায়। ছবিটা পাল্টেছে সেখানেও। মডেলিং জগতের পরিচিত মুখ জেসিকা গোমসও সন্তানের মা। তিনিও বলছেন, “আমিই ছ’মাস এক্সক্লুসিভ ব্রেস্টফিডিং করিয়েছি। স্তন্যপান চালু রেখেছি প্রায় এক বছর পর্যন্ত। কোনও অসুবিধে হয়নি। বরং ফ্যাট ঝরে আগের চেহারায় ফেরাটাও সহজ হয় স্তন্যপান করালে। আজকাল তো চিকিৎসকেরা তিন-চার মাসের মাথায় জিমে যাওয়ারও অনুমতি দিয়ে দেন। অথচ আমিই দেখেছি আগে খামোকা ভুল ধারণার বশে স্তন্যপান বন্ধ করে দেওয়া তো বটেই, এমনকী মা হতেও চাইতেন না অনেক মডেল।”
তবে সমস্যা একটা আছে। এ কালের মায়েরা বেশির ভাগই কর্মরত। ফলে মাতৃত্বের ছুটি ফুরিয়ে যাওয়ায় অনেকেই ছ’মাস একটানা সন্তানকে শুধুমাত্র স্তন্যাপান করাতে পারেন না। বেসরকারি সংস্থার কর্মী শাঁওলি যেমন বলছেন, “চার মাসের বেশি ছুটি পাইনি। অগত্যা তার পরে এক মাস কৃত্রিম দুধ খাইয়ে পাঁচ মাস থেকেই ছেলেকে সলিড ফুড ধরিয়ে দিয়েছি।” নম্রতা জানাচ্ছেন, এ ক্ষেত্রে তাঁর বন্ধুরা অনেকেই দুধ পাম্প করেন। শিশুর দেখভালের দায়িত্বে যিনি থাকেন, তিনিই সময় মেনে খাইয়ে দেন ফ্রিজে রাখা সেই দুধ। তবে শাঁওলির মতে, এ পদ্ধতিটা কঠিন, সময়সাপেক্ষও বটে। পরিমাণে কমও হয়ে যায় অনেক ক্ষেত্রেই। তাই তাঁর মতো কেউ কেউ ছ’মাস এক্সক্লুসিভ ব্রেস্টফিডিং করিয়ে উঠতে পারেন না।
ছুটির সমস্যার কথা মানছেন চিকিৎসক পার্বতীদেবীও। তিনিও বলেন, “কর্মরত মায়েদের জন্য আলাদা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা আছে। মায়ের দুধ পাম্প করে রেখে দেওয়া যায় ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত। তবে শিশুর জন্মের পরে ছ’মাস পর্যন্ত মাতৃত্বের ছুটি পাওয়া গেলে বা সব অফিসে ক্রেশ থাকলে মা ও শিশু দু’জনের পক্ষেই ভাল হত। সরকার এ নিয়ে ভাবলে ভাল হয়।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy