অটিজ়ম একটা জেনেটিক ডিজ়অর্ডার। একটা অবস্থা, যেটা যার হয়, তার সারা জীবন থাকে। অঙ্কন: শৌভিক দেবনাথ।
সেই ছোটবেলা থেকেই বুঝতে পারি, আমি অন্যদের থেকে আলাদা। মেলামেশা করতে অসুবিধে হয় আমার। কথা বলতে গেলেও অসুবিধে হয়। কথা আমি গুছিয়ে বলে উঠতে পারি না। আসলে গোছাতেই পারি না। আমি বড় হচ্ছি, কিন্তু বুদ্ধি বাড়ছে না। আমি শরীরে বড়, কিন্তু মাথার ভিতরে ছোট।
যে দিন থেকে আমি একা একা বাড়ির বাইরে বেরোতে শুরু করলাম, সে দিন থেকেই বুঝলাম, উল্টো দিকের মানুষটার কোনও কথার জবাব দেওয়ার আগেই আর একটা প্রশ্ন চলে আসে আমার কাছে। আমার শরীরে তখন কেমন একটা হতে থাকে। অদ্ভুত এক অনুভূতি! কখনও ঘামি দরদর করে। কখনও মাথার ভিতর অসংখ্য পোকামাকড় কামড়ানোর মতো ব্যথা অনুভূত হয়। অথবা ইচ্ছে না থাকলেও হাত, আঙুল, পা নড়তে থাকে, কাঁপতে থাকে ঠকঠক করে।
স্কুলে শিক্ষকেরা রোজ শাস্তি দিতেন। দারোয়ানের সঙ্গে মশার মধ্যে বসে থাকতাম। ক্লাসে রোজ বকা খেতাম। বোর্ডের দিকে তাকাতে পারতাম না। তাই বোর্ডে চক দিয়ে কিছু লিখতে গেলেই উল্টো লিখে ফেলতাম। রোজ বকাঝকা বরাদ্দ ছিল আমার জন্য। অন্য মানুষের দুঃখ, আনন্দ বুঝতে পারতাম না। কারণ আমার আনন্দ আর দুঃখ পাওয়ার ব্যাপারটা সকলের চেয়ে আলাদা। স্কুলে প্রথম প্রথম বন্ধুদের ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেলে হাঁটু কেটে যায়, কপাল কেটে যেত— তবুও আমি হাসতাম। ব্যথাটা শিরশিরে ঠান্ডার মতো। রক্ত পড়লে কোল্ড ড্রিঙ্কসের বোতল উপচে পড়া ঠান্ডা ঠান্ডা লাগত। কিন্তু আমার আঁকার খাতা, ছোট রাবারের পুতুল, আমার সাইকেল কেউ হাত থেকে কেড়ে নিলে আমি কাঁদতাম। খুব কষ্ট পেতাম।
স্কুলে সবাই ‘পাগল’ বলত। একা দোকানে মিষ্টি কিনতে গেলে দোকানদার বলতেন, ‘‘এই তার-কাটা, তোর কী চাই?’’ এ সব শুনতে আর ভাল লাগত না। আমি তো বুঝতাম না, এই নামগুলো আমাকে কেন দেওয়া হচ্ছে। আমার মাথায় থাপ্পড় মেরে চলাটাই অনেকের অভ্যেস হয়ে গিয়েছিল। বড়রা সবাই জিজ্ঞেস করত, ‘‘তুমি কী হতে চাও?’’ আমার মনে হত, আমি ঝিঁঝিপোকার ডাক্তার হব। আস্তে আস্তে আমি বুঝতে পারছিলাম, কাছাকাছি থাকা ‘লিভিং’ কিছু আমার বন্ধু নয়। আমার বন্ধু প্রকৃতি, সাইকেল, বাইনোকুলার, ক্যালাইডোস্কোপ। যাদের চোখের দিকে তাকাতে হয় না। যাদের কোনও প্রশ্ন নেই।
মনখারাপ হলে আকাশ দেখা একটা ভাল অপশন মনে হয় আমার। বেড়াতে গেলে পাহাড়ে রোদ পড়লে শিঙাড়া মনে হয়। সব পাহাড়ে নীল রঙের মাউথওয়াশের মতো বৃষ্টি হয়। নদী, পাহাড় দাঁত মেজে হয়ে ওঠে ঝকঝকে। মনে হয়, সব পাহাড়ে শিবঠাকুর আর কিংকং ঘুমোচ্ছে।
এখন আমি আস্তে আস্তে চেষ্টা করছি চারদিকের অবস্থা বুঝে চলার। আমি যখন সাধারণ স্কুলে পড়তাম, তখন যদি স্কুলের সবাই ‘অটিজ়ম’ কী সেটা জানত, তা হলে আমার সুবিধে হত হয়তো। তা হলে টিচাররা শুধু শুধু আমার উপর রেগে যেতেন না। বন্ধুরা খ্যাপাত না। আমিও রোজ রোজ স্কুলে শাস্তি পেয়ে মশার মধ্যে বসে থাকতাম না।
আমি বিনায়ক রুকু। আমি জানি, আমার অটিজ়ম আছে। আমি জানি, অটিজ়ম একটা জেনেটিক ডিজ়অর্ডার। একটা অবস্থা, যেটা যার হয়, তার সারা জীবন থাকে। তবে আমিও এই গ্রহে সবার সঙ্গে মিলেমিশে থাকতে চাই। এই বছর কুড়ির জীবনে আমার অসুবিধেগুলো কাটিয়ে উঠতে চাই। তোমরা আমাকে একটু সাহায্য করবে তো?
(লেখক অটিস্টিক। ইন্ডিয়া অটিজ়ম সেন্টারে নিউরোডাইভার্সিটি লিড।)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy