সর্বোপরি অটিস্টিক শিশুদের মানসিক ও সামাজিক ভাবে গ্রহণ করার মানসিকতা তৈরি করা আবশ্যিক। প্রতীকী ছবি।
এ বারের শিশু দিবসে একটু অন্য রকম শিশুদের কথা ও তাদের প্রতি সমাজের দায়িত্ব ও কর্তব্যের কথা ভাবা যাক। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)-র তথ্য বলছে, পৃথিবীর প্রতি একশো শিশুর ১ জন অটিজ়ম স্পেক্ট্রাম ডিজ়অর্ডার (এএসডি)-র শিকার। আমেরিকার পরিসংখ্যান সবচেয়ে ভয়াবহ, সেখানে সংখ্যাটি প্রতি চুয়াল্লিশ জন শিশুর মধ্যে ১ জন (২০১৮র পরিসংখ্যান অনুযায়ী)। ভারতের এ বিষয়ে কোনও প্রামাণ্য সরকারি তথ্য না থাকলেও সংখ্যাটি ১ শতাংশের বেশি বলেই ধারণা।
আমি নিজে এক জন অটিস্টিক সন্তানের বাবা। প্রতি দিন বেড়ে চলা অটিস্টিক শিশুর সংখ্যা আমাকে বিপন্ন করে তোলে। কেন অটিজ়ম হয়, তার কোনও উত্তর আমাদের এখনও জানা নেই। তবে যা জানা আছে সেটি হল এই যে, অটিজ়ম হলে কী করা যেতে পারে। প্রথম ধাপেই যা করণীয় তা হল, এই পরিস্থিতিকে গ্রহণ করা বা মেনে নেওয়া। এই কাজটি না করতে পারলে বাকি কিছুই সম্ভব নয়। এই কাজের শুরু কিন্তু অভিভাবকদের দিক থেকেই। তার পরের পর্যায়ে আসে পরিবার, বৃহত্তর পরিবার এবং সবার শেষে সমাজ। বাবা, মা এবং পরিবার হয়তো কিছু সময় নেয় শুরুতে, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেটুকু হয়েই যায়।
মেনে নেওয়ার পরে শুরু হয় প্রশিক্ষণ। প্রশিক্ষণের একটাই লক্ষ্য, সন্তানকে স্বাবলম্বী করে তোলা, যাতে অভিভাবকের অবর্তমানে সে সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে। ব্যাপারটা সহজ নয়, কিন্তু চেষ্টা চালিয়ে যেতেই হয়। শুরুর কয়েক বছর পরে অভিভাবকদের সামনে সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় অবহেলা, যা শিশুটিকে পেতে হয় সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলি থেকে। এই সবের মাঝে যে সমস্যা সবচেয়ে বড় হয়ে দেখা দেয়, তা আসে তার স্কুল থেকে। এই বিষয়েই কিছু বলতে চাই নিজের অভিজ্ঞতা থেকে।
অটিস্টিক শিশুর অভিভাবকদের অন্যতম চিন্তার বিষয় হল স্কুল। কোন ধরনের স্কুল ঠিক হবে শিশুর জন্য? তথাকথিত রেগুলার স্কুল, না কি স্পেশাল স্কুল? এই প্রশ্নের সম্মুখীন আমরা সবাই হয়েছি। খুব স্বাভাবিক কারণেই আমরা রেগুলার স্কুলের দিকেই ছুটি। এই প্রসঙ্গে এটা বলা প্রয়োজন যে, আমাদের দেশে 'ইনক্লুসিভ এডুকেশন' প্রচলিত এবং বিভিন্ন শিক্ষা নিয়ামক সংস্থাগুলিতে এই বিষয়ে নির্দিষ্ট নির্দেশিকা রয়েছে। যেমন, সিবিএসই বলছে, প্রতিটি স্কুল অটিস্টিক শিশুদের ভর্তি নিতে এবং শিক্ষা প্রদানে বাধ্য। স্কুলগুলিকে অটিস্টিক শিশুদের উপযোগী পরিকাঠামো তৈরি, স্পেশাল এডুকেটরের ব্যবস্থা অবশ্যই করতে হবে। এ ছাড়া বাকি শিক্ষক-শিক্ষিকাদের নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও করতে হবে, যাতে তাঁরা এই সব শিশুদের শিক্ষাদানে সমর্থ হন। সরকারি স্কুলগুলি থেকে কার্যত (কিছু ব্যাতিক্রম আছে) এই ব্যবস্থা আশা করা মুশকিল, তাই বেসরকারি স্কুলগুলিই প্রধান ভরসা। সাধারণত একেবারে শিশু বয়সে যে কোনও স্কুলেই ভর্তি করা সম্ভব।
প্রথম কয়েক বছর ঠিকঠাক কেটে গেলেও সমস্যা শুরু হয় সন্তান বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে। এই সময়ে হঠাৎ এক দিন স্কুল হাত তুলে নেবে এবং আপনি জানবেন যে, আপনার সন্তানের তথাকথিত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ইতি। মজার বিষয় হল, এই পুরো প্রক্রিয়াটাই হয় ধাপে ধাপে এবং মৌখিক। এ রকম পরিস্থিতিতে অভিভাবকদের করার কিছুই থাকে না। স্কুলের সঙ্গে লড়াই করার বদলে অন্য স্কুল খোঁজা শুরু হয়। এই রকম পরিস্থিতি আমাদের ক্ষেত্রেও হয়েছে একটি বিখ্যাত সর্বভারতীয় বিদ্যালয় গোষ্ঠীর গুয়াহাটির একটি শাখা বিদ্যালয় থেকে। সেই সময়ে আমাদের সন্তান আহীরকে একটি স্পেশাল স্কুলে ভর্তি করিয়ে আমাদের লড়াই শুরু হয়। দীর্ঘ তিন মাসের লড়াইয়ে সিবিএসই এবং কেন্দ্রীয় শিক্ষা মন্ত্রককে জানানোর করার পর অবশেষে স্কুল বাধ্য হয় আহীরকে তার ক্লাসরুম ফিরিয়ে দিতে। তার পর শুরু হয় অসহযোগিতা। শুধু অভিভাবক নন, এ বারে শিশুটির সঙ্গেও। আজ এই মুহূর্তে আমরা জানি, পরের শিক্ষাবর্ষেই আমাদের আবার নতুন কোনও স্কুলের সন্ধান করতে হবে।
শুধু মাত্র অটিস্টিক শিশুদের সঙ্গে এমন হয় তা নয়, সব বিশেষ ভাবে সক্ষম শিশুর ক্ষেত্রেই ব্যাপারটা কম-বেশি এক রকম। এ রকম ঘটনার সন্মুখীন হয়েছেন অধিকাংশ অভিভাবক। কিন্তু কেন এমন হয়? আসলে এর মূলে রয়েছে গ্রহণ করতে না পারা। স্কুল কর্তৃপক্ষ বা তার শিক্ষককরা অনেকেই আহীরদের ‘সমস্যা’ বলে ভাবেন এবং এই শিশুদের শিক্ষার দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করেন। গ্রহণ করতে না পারলে এই শিশুদের সমস্যা এবং প্রয়োজনকে বোঝাও সম্ভব নয়। প্রশ্ন হল, কেন এমন হবে? অন্য সমস্ত শিশুর মতো আহীরদেরও বিদ্যালয়-শিক্ষার অধিকার রয়েছে। দীর্ঘ অপেক্ষার পর যে শিক্ষার অধিকার আইন প্রণীত হয়েছে, তাতেও একই কথা বলা আছে। সরকারের তরফে তার ব্যবস্থাও রয়েছে। কিন্তু সেই নিয়ম মানা হচ্ছে কি না, তা পর্যবেক্ষণের কোনও ব্যবস্থা নেই। আর ঠিক এই জায়গাতেই সুযোগ নেয় স্কুলগুলি। এর সঙ্গে যোগ হয় অভিভাবকদের অসহায়তা। স্কুল কর্তৃপক্ষ এবং শিক্ষকরা এটা ভুলে যান যে, ক্লাসের সব থেকে কমজোরি শিশুটির হাতটাই বেশি শক্ত করে ধরা প্রয়োজন।
সমস্যা হল, তা হলে আহীররা কী করবে? স্পেশাল স্কুল একমাত্র রাস্তা। কিন্তু সেই স্কুলই বা কোথায়? বড় শহরে যতটুকু সুবিধা রয়েছে, ছোট শহর বা গ্রামের দিকে তেমন কোনও ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। এ ক্ষেত্রে মূলত বেসরকারি এবং ব্যক্তিগত উদ্যোগেই কিছু প্রশিক্ষণ কেন্দ্র বা স্পেশাল স্কুল চালু হয়েছে বিভিন্ন জায়গায়। সরকারি সাহায্য থাকলেও সরকারি প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা নগণ্য। তাই বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আহীররা বিদ্যালয় শিক্ষা থেকে বঞ্চিতই থেকে যায়। যারা বিভিন্ন বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার সুযোগ পায়, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অপর্যাপ্ত ব্যবস্থা ও পরিকাঠামোর অভাবে তাদের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ পুরোটা হয়ে ওঠে না। অথচ, এই প্রশিক্ষণ ও শিক্ষাদান সম্ভব। ওদের সমাজে স্বাভাবিক জীবনে প্রতিষ্ঠিত করাও সম্ভব। পশ্চিমি দেশগুলিতে এই ধরনের সফল উদ্যোগ আমি দেখেছি। প্রয়োজন শুধু এদের গ্রহণ করা।
যে তথ্য দিয়ে শুরু করেছিলাম তাকে আর একটু বিস্তারিত করলে দেখা যাবে, আমেরিকায় ২০০০ সালে প্রতি দেড়শো শিশুর ১ জন অটিজমের শিকার ছিল। আঠেরো বছরে সংখ্যাটা ৩.৪ গুণ বেড়েছে। যে হেতু আমার দেশে এই পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না, তাই এখানে যে তা একই রকম ভাবে বাড়ছে না, এমন ভাবা বোকামো হবে। আমাদের দেশে ০-১০ বছরের শিশুর সংখ্যা চুয়াল্লিশ কোটি। আজকের দিনের পরিসংখ্যান অনুযায়ী হিসাব করলে অটিস্টিক শিশুদের সংখ্যা দাঁড়ায় চুয়াল্লিশ লক্ষ। এর সঙ্গে ১০ বছরের বেশি বয়সের সংখ্যাটা যোগ করলে (১ কোটি আশি লক্ষ) এক গভীর সঙ্কটের আভাস পাওয়া যায়। অটিজ়মের কারণ জানা নেই বলেই বিষয়টি বেশি চিন্তার। সুতরাং, আমাদের আরও ভাল করে পরিস্থিতির পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। সামাজিক স্তরে এই সম্বন্ধে সচেতনতা বাড়ানো, প্রয়োজনীয় শিক্ষা, প্রশিক্ষণের ব্যাবস্থা ও তার আনুষঙ্গিক পরিকাঠামো নির্মাণ একান্ত প্রয়োজন। সর্বোপরি এই শিশুদের মানসিক ও সামাজিক ভাবে গ্রহণ করার মানসিকতা তৈরি করা আবশ্যিক। শুধু সরকার নয়, সাধারণ মানুষকেও এগিয়ে আসতে হবে, শক্ত করে ধরতে হবে আহীরদের হাত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy