আধুনিক প্রযুক্তিরই হাত রয়েছে সফল হাঁটু প্রতিস্থাপনের নেপথ্যে।
বছর পঞ্চাশের সীতারানি দেবীর বহু দিন ধরেই কোমরে সমস্যা। হাঁটাচলা প্রায় বন্ধ হতে বসেছিল। বেসরকারি সংস্থার চাকরি ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন বছর দুই আগে। বাস থেকে ওঠা-নামা কার্যত অসম্ভব হয়ে উঠেছিল তাঁর পক্ষে।
চিকিৎসকেরা বলেছিলেন, হিপ প্রতিস্থাপন করাতে হবে। চিন্তায় ছিলেন, সংসারটা বুঝি ভেসেই যাবে। তবু গত বছর ভর্তি হন শহরেরই একটি বেসরকারি হাসপাতালে। হয় অস্ত্রোপচার। নিজেই জানালেন, এ বছর আবার নতুন করে আংশিক সময়ের চাকরি খুঁজছেন তিনি।
সীতারানির বয়স কম। তাই কি সহজ হয়েছে এ পথে চলা? সে চিন্তায় জল ঢেলে দিব্যি তিনতলার ছাদে উঠে প্রতিদিন গাছের যত্ন নিতে ঘণ্টা তিনেক কাটাচ্ছেন ৮১-র বৃদ্ধ বীরেশ্বর পাল। জানালেন, অনেক দিন ধরেই হাঁটুর সমস্যায় ভুগছিলেন। বছর দুই আগে সাহস করে অস্ত্রোপচার করিয়েই ফেলেছেন। বীরেশ্বর বলছিলেন, ‘‘হাঁটু প্রতিস্থাপনের পরে যেন নতুন জীবন পেয়েছি।’’
আরও পড়ুন: বন্ধ্যত্বের সমস্যায় আগে দরকার কাউন্সেলিং, বলছেন চিকিৎসকেরা
কয়েক বছর আগেও হাঁটু ও হিপ প্রতিস্থাপন নিয়ে নানা আশঙ্কা ছিল অনেকের মনে। ব্যয়সাপেক্ষ এই অস্ত্রোপচার যদি সফল না হয়, তা নিয়েই মূলত চিন্তায় পড়তেন রোগীর পরিজনেরা। তবে সে ভয় কেটে গিয়েছে বহু দিন হল। বরং রিপোর্ট বলছে, টোটাল হিপ রিপ্লেসমেন্ট হল এ শতকের সবচেয়ে সফল অস্ত্রোপচার। তা হার মানিয়েছে অন্য সব ধরনের অস্ত্রোপচারকে।
বছর কয়েক আগেও এত বড় অস্ত্রোপচারের জন্য এ শহরের রোগীরা পাড়ি দিতেন দক্ষিণে। কিন্তু শহরের বিভিন্ন হাসপাতাল সূত্রের খবর, গত দশ বছরে একেবারে বদলে গিয়েছে এখানকার পরিষেবা ব্যবস্থা। ফলে ভিন্ রাজ্য, এমনকি ভিন্ দেশের রোগীরা চিকিৎসার জন্য ভিড় করছেন কলকাতায়। একটি নামী বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসক বুদ্ধদেব চট্টোপাধ্যায় জানালেন, হাঁটু বা হিপ প্রতিস্থাপন হল অতি ‘হাই টেক’ অস্ত্রোপচার। এ ক্ষেত্রে যেটা সবচেয়ে ভয়ের, তা হল সংক্রমণের আশঙ্কা। তিনি বলেন, ‘‘সংক্রমণ এড়াতে প্রয়োজন পরিচ্ছন্ন পরিবেশ।
এখানে এখন বহু হাসপাতালেই সেই ব্যবস্থা আছে।’’ চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, আগে এ শহরে প্রতিস্থাপনের কাজ শেখার ব্যবস্থা কম থাকায় উন্নত মানের পরিষেবা দেওয়া সম্ভব হত না। এখন সে বাধা কেটে গিয়েছে। অস্ত্রোপচার থেকে ওটি-র রক্ষণাবেক্ষণ, সব দিকেই বিশেষ নজর থাকছে এ শহরে। প্রতিস্থাপনের জন্য ওটি পরিচ্ছন্ন রাখতে থাকছে আধুনিক ফিল্টার। এই সব উচ্চ মানের ব্যবস্থাপনাই কমিয়ে দিয়েছে সংক্রমণের আশঙ্কা। ফলে হাঁটু ও হিপ প্রতিস্থাপনে সাফল্যের হারও আগের থেকে অনেক বেড়ে গিয়েছে।
এ শহরের আর একটি নামী হাসপাতালের চিকিৎসক রণেন রায় জানালেন, বছর দশেক আগে এখানে এমন অস্ত্রোপচার হত বছরে ৫০০-৬০০টি, এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১০০০-এর মতো। তাঁর বক্তব্য, বাইরে থেকে রোগী আসার প্রবণতাই বলে দিচ্ছে এ শহরের চিকিৎসা ব্যবস্থার কতটা উন্নতি হয়েছে। তিনি বলেন, ‘‘এখানে এখন হাঁটু ও হিপ প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে প্রায় ৯৯ শতাংশ অস্ত্রোপচারই সফল হয়।’’
আরও পড়ুন: সিওপিডি-তে মৃত্যু প্রতি ১০ সেকেন্ডে! বাঁচব কী ভাবে?
এই সাফল্যের পিছনে আধুনিক প্রযুক্তিরই হাত রয়েছে বলে জানাচ্ছেন চিকিৎসকেরা। বুদ্ধদেববাবু জানান, এখন নানা রকম নকশা ও উপকরণে তৈরি সামগ্রী ব্যবহার করা হচ্ছে। অর্থাৎ, যে নকশার জিনিস প্রয়োজন, রোগী বিশেষে তা-ই ব্যবহার করা হচ্ছে। তা ছাড়া, হিপ প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে ব্যবহার হচ্ছে সেরামিক্সের সামগ্রী। এ সব উন্নত মানের উপকরণ ব্যবহারের ফলে প্রতিস্থাপনের পরে ডিজ়লোকেশনের ভয় কমে গিয়েছে। তাই এমন অস্ত্রোপচার এখন আগের থেকে অনেকটাই ঝুঁকিমুক্ত। সঙ্গে ফিজ়িয়োথেরাপির ব্যবস্থাও হয়েছে আগের থেকে অনেক বেশি। অস্ত্রোপচার পরবর্তী যা যা যত্ন প্রয়োজন, তা আলাদা
করে অধিকাংশ হাসপাতালেই দেওয়া হচ্ছে।
এ শহরের বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালের পাশাপাশি রাজ্যের সরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলিতেও হচ্ছে প্রতিস্থাপনের কাজ। স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা প্রদীপ মিত্র জানালেন, রাজ্যের একাধিক সরকারি হাসপাতালেই আছে বিনা খরচে হাঁটু ও হিপ প্রতিস্থাপনের ব্যবস্থা। তাঁর দাবি, ‘‘বেশ কয়েক বছর ধরেই এই কাজ হচ্ছে। অস্ত্রোপচারের সাফল্যের হারও ভালই।’’ স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের দাবি, শহরের অধিকাংশ হাসপাতালেই দিনে বেশ কয়েকটি করে হিপ প্রতিস্থাপনের অস্ত্রোপচার হয়। সফল ভাবে হাঁটু প্রতিস্থাপনও হয় সপ্তাহে অন্তত তিন-চারটি।
চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, বিভিন্ন বয়সের রোগীরাই প্রতিস্থাপনের পরে সুস্থ জীবন ফিরে পাচ্ছেন। তবে সাধারণত ষাট বছরের কম বয়সের রোগীদের হাঁটু প্রতিস্থাপন করতে খুব উৎসাহ দেওয়া হয় না এখনও। হিপ প্রতিস্থাপনের সংখ্যা অবশ্য কমবয়সিদের মধ্যেই বেশি। কারণ, অ্যাভাস্কুলার নেক্রোসিস এবং অ্যাঙ্কাইলোসিং স্পন্ডিলোসিসের দুর্ভোগ বেড়েছে এখনকার তরুণদের একটি বড় অংশের মধ্যে। তার জেরে হিপ প্রতিস্থাপন প্রয়োজন পড়ছে অনেকেরই। অস্ত্রোপচারের পরে দিব্যি স্বাভাবিক জীবনযাপন করছেন তাঁরা।
আরও পড়ুন: ক্যানসার চিকিৎসাকে নাগালে আনতে পারে ‘টিম ওয়ার্ক’
চিকিৎসকেদের বক্তব্য, নিয়ম মেনে চললে এ ধরনের অস্ত্রোপচারের পরে অন্তত ২০-২৫ বছর নিশ্চিন্তে স্বাভাবিক ভাবে চলাফেরা করা যায়। কারও কারও ক্ষেত্রে দরকার পড়লে এর পরবর্তী ধাপেও করা হয় অস্ত্রোপচার। তা-ও খুব একটা ঝুঁকির্পূণ নয়। তবে প্রথম ধাপের খরচ যেমন এক-একটি
হাঁটুর ক্ষেত্রে দু’লক্ষ টাকার আশপাশে পড়ে। পরের ধাপের অস্ত্রোপচারে তার থেকে তুলনায় কিছুটা বেশি খরচ হয়। হিপ প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রেও তা-ই। মোটামুটি আড়াই লক্ষ টাকা খরচে প্রথম ধাপের টোটাল হিপ রিপ্লেসমেন্ট হয়। পরে আবার
কখনও করতে হলে খরচ খানিক বাড়তেও পারে হাসপাতাল বিশেষে।
তবে বারবার অস্ত্রোপচার করার প্রয়োজন পড়ে না অধিকাংশ ক্ষেত্রেই, জানাচ্ছেন চিকিৎসকেরা। শুধু খেয়াল রাখতে হয়, ডাক্তারের কথা মতো ব্যায়াম যেন কখনও বাদ না পড়ে। পাশাপাশি পরামর্শ, হিপ বা হাঁটু প্রতিস্থাপনের পরেই অতিরিক্ত ভারী কাজ না করা ভাল। নিজে কতটা ভার বহন করতে পারছেন, তা ধীরে ধীরে বুঝে নিতে হবে নিজেকেই। আর অবশ্যই থাকতে হবে খুব পরিচ্ছন্ন পরিবেশে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy