ছবি: সংগৃহীত।
আরজি কর-কাণ্ড চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে খাস কলকাতা থেকে শহরতলি-মফস্সল— নারীর সুরক্ষার বিষয়টি প্রশ্নাতীত নয়। বরং নারীকে সম্ভ্রমহীন করে তোলাতেই যেন সমাজের কিছু মানুষের সুখ। সব ঘটনা প্রকাশ্যে আসে না। তাই বলে যে ঘটনা ঘটে না, এমন নয়। তবে এ বার সময় এসেছে নিরাপত্তা ছিনিয়ে নেওয়ার। সেই লক্ষ্যেই শুরু হয়েছে প্রতিরোধ-প্রতিবাদ। এই পরিস্থিতিতে অনেকেরই প্রশ্ন, শুধু প্রতিবাদ আর আন্দোলন করলেই কি নারীর নিরাপত্তা সুনিশ্চিত হবে? শুধু স্লোগান তুললেই কি ধর্ষণ, নির্যাতন, নারীর অসম্মান আটকানো যাবে? এই প্রশ্নগুলির উত্তর খুঁজে চলেছেন অনেকেই। এমন হাজার প্রশ্নের ভিড়ে খানিকটা হলেও পথ দেখালেন ‘রাত দখল’ কর্মসূচির আহ্বায়কেরা।
নারীসুরক্ষা সুনিশ্চিত করার দাবিতে ১৪ অগস্ট রাত দখলের ডাক দেওয়া হয়েছিল। সেই রাতে কলকাতা থেকে কোচবিহারের রাস্তা ছিল মেয়েদের দখলে। সমাজের বিভিন্ন স্তরের এবং বয়সের মহিলাদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে শক্তি পায় এই আন্দোলন। এই কর্মসূচির ডাক দিয়েছিলেন যাঁরা, নারীর নিরাপত্তার দাবিতে আরও এক ধাপ এগোনোর ভাবনায় তাঁরা তৈরি করলেন ‘বিকল্প মানুষের ইতিবাচক সমন্বয় মঞ্চ’। এই মঞ্চের তরফে জানানো হয়েছে, রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় সরকারকে নারীদের সুরক্ষার ব্যাপারে ভরসা করা যায় না। রাজ্যের পূর্বতন সরকারও এ ক্ষেত্রে ব্যর্থ। তাই নারীদের দাবিদাওয়াগুলি এক জায়গায় করে তুলে ধরার কাজ করবে এই মঞ্চ। রাত দখল কর্মসূচির ডাক দিয়েছিলেন রিমঝিম সিংহ। এই মঞ্চের অন্যতম সদস্য রিমঝিম। শুক্র-সন্ধ্যায় সাংবাদিক সম্মেলন থেকে রিমঝিম বলেন, ‘‘এই মঞ্চ তৈরির অন্যতম লক্ষ্য ধর্ষণমুক্ত সমাজ গড়ে তোলা। দুর্নীতি আর নির্যাতনের বিরদ্ধে যাঁরা আওয়াজ তুলেছেন, তাঁদের স্বর যেন হারিয়ে না যায়, সেই লক্ষ্যেই কাজ করবে এই মঞ্চ। ১৪ তারিখ রাতে প্রায় ৩০০টি জায়গায় রাত দখল আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন বহু মানুষ। তাঁদের বিকল্প স্বর হয়ে এই মঞ্চ গড়ে উঠুক।’’
এই মঞ্চ নারীর যন্ত্রণা, বঞ্চনা, সুবিধা-অসুবিধার কথা প্রকাশ্যে আনবে এবং ন্যায্য অধিকার বুঝে নেওয়ার লড়াই চালিয়ে যাবে। কিছু দাবিকে সামনে রেখে মঞ্চ কাজ শুরু করবে। দাবিগুলি এ রকম— ১) স্কুল পাঠ্যক্রমে লিঙ্গসাম্য এবং যৌনশিক্ষা ২) রাতে কর্মক্ষেত্রে মহিলাদের জন্য সুরক্ষিত বিশ্রামকক্ষ এবং শৌচালয় ৩) সারা রাত গণ পরিবহণের বন্দোবস্ত ৪) ‘নির্যাতিতাকে দোষারোপ’ বা ‘ভিক্টিম ব্লেমিং’ বন্ধ করা ৫) কর্মক্ষেত্রে ‘আইসিসি’( ইন্টারনাল কমপ্লেনিং কমিটি) এবং আঞ্চলিক স্তরে ‘এলসিসিসি’ (লোকাল কমপ্লেনিং কমিটি) তৈরি হয়েছে, সেগুলিতে নির্বাচিত প্রতিনিধি রাখা।
এ ছাড়া রাজ্যের বিভিন্ন জায়গা থেকে বহু পরিকাঠামোগত অসুবিধার কথা উঠে এসেছে। মহিলা থানাগুলির নিষ্ক্রিয়তা, রাতের রাস্তায় আলোর অভাব, মূত্রনালির সংক্রমণ থেকে বাঁচতে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন শৌচালয়, রাস্তায় পুলিশের টহলদারির মতো বেশ কিছু বিষয় উঠে এসেছে। সেগুলিকেই মূলত এক জায়গায় করে কাজ করবে এই মঞ্চ। মহিলাদের জন্য সুলভ শৌচালয় তৈরির দাবি উঠেছে ডানকুনি থেকে। মফস্সল ছাড়া খাস কলকাতেও এই সমস্যা রয়েছে। শহরের অন্যতম প্রাণকেন্দ্র কলেজ স্ট্রিট। রাত পর্যন্ত জমজমাট থাকে এই পাড়া। কিন্তু, মহিলাদের জন্য আলাদা শৌচালয় এখানে অপ্রতুল। পুরুষদের সমস্যা না থাকলেও মহিলাদের বিপাকে পড়তে হয়। কলেজ স্ট্রিট একটা উদাহরণ। কলকাতার অন্য অনেক জায়গায় গিয়েও এমন সমস্যায় পড়তে হয় নারীকে। সে দিকে নজর দেওয়া জরুরি। অনেকেই ব্যাগে স্যানিটারি ন্যাপকিন রাখেন। কিন্তু, সকলের এই অভ্যাস নেই। শহরের শৌচালয়গুলিতে কিন্তু স্যানিটারি ন্যাপকিনের বন্দোবস্ত চোখে পড়ে না। হঠাৎই ঋতুস্রাব শুরু হলে, কী ভাবে সামলাবেন মেয়েরা? একবিংশ শতকে পৌঁছেও এই ভাবনা নাড়া দেয়নি সমাজকে।
রাত দখল কর্মসূচিতে মহিলাদের অংশগ্রহণ ছিল চোখে পড়ার মতো। কিন্তু এই কর্মসূচির পরে বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠেছিল, প্রতিটি রাতই কি নারীর জন্য সুরক্ষিত করা গেল? কলকাতার মতো শহরে রাত এগারোটা বাজলেই বন্ধ হয়ে যায় মেট্রো। শোনা যায় না বাসের হর্ন। রাতের ফাঁকা ট্রেনে মেয়েদের বাড়ি ফেরা যে কতটা ঝুঁকির, ইতিপূর্বে ঘটে যাওয়া বেশ কিছু ঘটনা তার প্রমাণ। বা়ড়ি ফেরার জন্য তখন ভরসা একমাত্র ক্যাব। রাতের রাস্তায় ক্যাবচালকের হাতে যৌন হেনস্থার ঘটনারও সাক্ষী থেকেছে এ শহর। রাতে মেয়েদের কাজ না দেওয়া এই সমস্যার সমাধান হতে পারে না। বরং রাতবিরেতে সুরক্ষিত গণ পরিবহণ থাকলে নির্ভয়ে পথ চলতে পারেন মেয়েরা। মহিলা থানাগুলির নিষ্ক্রিয়তা নিয়েও উঠেছে অভিযোগ। মফস্সলের বিভিন্ন জায়গায় সক্রিয় মহিলা থানা তৈরি করার দাবি উঠেছে। এই দাবি সঙ্গত। এই শহরেও মহিলা থানাগুলির নিষ্ক্রিয়তা চোখে পড়ার মতো।
নারী শুধু কর্মক্ষেত্রে, রাস্তাঘাটে কিংবা গণ পরিবহণে সুরক্ষাহীন নয়। নারী নিরাপত্তার অভাব রয়েছে বাড়িতেও। না হলে গার্হস্থ্য হিংসা, বৈবাহিক ধর্ষণের মতো ঘটনার ভূরি ভূরি উদাহরণ থাকত না। সমাজের এই অন্ধকার দিকগুলি নিয়েও কথা বলবে এই মঞ্চ। জানালেন মঞ্চেরই এক সদস্য রুবিয়া মণ্ডল। তাঁর কথায়, ‘‘গার্হস্থ্য হিংসার ইতিহাস বহু কালের। নারীর নির্যাতিত, অত্যাচারিত হওয়ার শুরু বাড়ি থেকেই। তাই ধর্ষণের পাশাপাশি এই ধরনের নির্যাতনের বিরুদ্ধেও প্রতিরোধ গড়ে তুলবে এই মঞ্চ।’’
উল্লেখ্য, ৯ অগস্ট আরজি কর-কাণ্ডের প্রথম শুনানি হওয়ার কথা সুপ্রিম কোর্টে। তার আগের রাতে ফের রাত দখলের ডাক দেওয়া হয়েছে এই মঞ্চের তরফে। এই কর্মসূচির নাম রাখা হয়েছে ‘নতুন গানের ভোর’। শাসকের ঘুম ভাঙাতেই এই প্রয়াস। বিভিন্ন বাংলা ব্যান্ড, নৃত্যশিল্পী, সর্বোপরি সাধারণ মানুষকে এই আন্দোলনে অংশ নেওয়ার জন্য আহ্বান জানানো হয়েছে। ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ ছবির গান গেয়ে রাজার ঘুম ভাঙানোর আঙ্গিকেই সাজানো হয়েছে এই ভাবনা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy