কোথা থেকে এল করোনাভাইরাস?
ফেলু মিত্তির-ব্যোমকেশ বক্সীর দিন শেষ। বাংলায় এক নতুন গোয়েন্দার আবির্ভাব ঘটেছে। যুগের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এ এক ধরনের, অন্য ধাঁচের, অন্য রকমের গোয়েন্দাগিরি। গণ্ডগোল মেটাতে গ্যাংটকে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। ব্যোমকেশের মতো মহাবালেশ্বর দেখতেও যেতে হয় না। এই গোয়েন্দা শুধু কম্পিউটরের ইঁদুরে হাত রেখে রহস্যভেদ করেছে। সরেজমিনে যাওয়ার প্রয়োজন হয়নি।
তবে কি এই গোয়েন্দা এফবিআই?
ড্রাগ মাফিয়াদের গুপ্ত ব্যবসার খবর উদ্ধার করেননি এই গোয়েন্দা। কিন্তু সিআইএ-এফবিআই যা পারেনি, ইনি তা পেরেছেন। ভেদ করেছেন এই সময়ের সবচেয়ে বড় রহস্য— কোথা থেকে এল করোনাভাইরাস। তিনি বলছেন, চিন সরকারই হল নতুন মগনলাল মেঘরাজ!
গত বছর করোনা অতিমারি শুরুর পর্বে অনেকে বলছিলেন, চিনের উহানের এক গবেষণাগার থেকে ছড়িয়েছিল ওই ভাইরাস। কিন্তু সন্দেহ প্রকাশ করা ছাড়া তেমন কোনও তথ্য বার করতে পারেননি কেউ। ডোনাল্ড ট্রাম্পও না। কিন্তু এবার সেই সন্দেহে যথেষ্ট ঘি ঢালতে পেরেছেন নয়া গোয়েন্দা।
ফেলুদা-ব্যোমকেশ মাঝেমধ্যে ছদ্মবেশ ধারণ করতেন। যেমন করতেন বিলেতের শার্লক হোম্সও। আর এই গোয়েন্দার পুরো জীবনটাই ছদ্মবেশ। কোথায় থাকেন, কী করেন, তা কেউ জানে না। তিনি জানাতেও চান না। তাই নিজের নাম দিয়েছেন ‘দ্য সিকার’। ছদ্মনাম। টুইটার হ্যান্ডলের সেই নাম ব্যবহার করে নেটমাধ্যমেই চলছে তাঁর গোয়েন্দাগিরি। সেখানেই দেখা যাচ্ছে, এই পশ্চিমবঙ্গেরই কোনও এক অঞ্চল থেকে চলছে তাঁর কোভিডান্বেষণ। পড়ে ফেলছেন চিন দেশে প্রকাশিত দিস্তা দিস্তা গবেষণাপত্র। সেখান থেকে নিত্যনতুন তথ্য বার করছেন। সঙ্গী মগজাস্ত্র। তার সাহায্যে চলছে শূন্যস্থান পূরণ।
দেখা যাচ্ছে, করোনার সব রাস্তাই গিয়ে মিলছে সেই উহানের গবেষণাগারেই!
যে ভাইরাসের উপদ্রবে বিশ্ব জুড়ে এমন অতিমারি, তার ঘরের ঠিকানা জানার অধিকার সকলের। তাই মুখোশে মুখ ঢেকে চলছে জনসেবার চেষ্টা। এ ধরনের কাজের ইতিহাস প্রাচীন। বিভিন্ন সমাজে রয়েছে এর উদাহরণ। পরিচয় গোপন রেখে অসহায়দের পাশে দাঁড়ানোর কথা দেখা যায় সিনেমা-সাহিত্যেও। ৪০-এর দশকে হলিউডের জনপ্রিয় ছবি ‘দ্য মার্ক অব জোরো’ থেকে সাম্প্রতিকতম বাংলা ধারাবাহিক, ২০১১ সালের ‘প্রলয় আসছে’-তেও রয়েছে এমনই গল্প। তবে এ সন্ধানকারী নিজের চিত্রনাট্য লিখছেন নিজেই।
গত মে মাসে একটি নতুন গবেষণাপত্র হাতে আসে ‘দ্য সিকার’-এর। ২০১৩ সালে লেখা। কোভিড ছড়ানো শুরুর সময়ে ‘উহান ইনস্টিটিউট অব ভাইরোলজি’র দিকে আঙুল উঠেছিল। পরে তা ‘রাজনৈতিক চক্রান্ত’ বলে উড়িয়ে দেন অনেকে। সেই পুরনো দাবির পক্ষে আবার কিছু প্রমাণ এনেছে সেই গবেষণাপত্র। উহানের কাছের ইউনান এলাকার একটি খনির কথা উল্লেখ করা হয়েছে তাতে।
যে ভাইরাস তাণ্ডব বাধিয়েছে গোটা দুনিয়ায়, তার উৎস সন্ধানে জোট বেঁধেছেন একদল নেটাগরিক। তাঁরা পরিচিত ‘ড্রাস্টিক’ বলে। পুরো নাম ‘ডিসেন্ট্রালাইজড র্যাডিক্যাল অটোনমাস সার্চ টিম ইনভেস্টিগেটিং কোভিড-১৯’। বিভিন্ন দেশের মানুষ রয়েছেন এই দলে। নানা ধরনের পেশার সঙ্গে যুক্ত তাঁরা। স্বেচ্ছায় সত্যের সন্ধান চালাচ্ছে দলটি। তার সদস্য পশ্চিমবঙ্গের এই সন্ধানকারীও। প্রযুক্তির মেঘের আড়াল থেকে লড়ে যাচ্ছেন শতাব্দীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর খোঁজার লড়াই। প্রথম দিকে ‘ড্রাস্টিক’-এর কাজের খবর আবদ্ধ ছিল টুইটার জগতেই। সেখানে চলছিল তদন্তের সূত্র আদানপ্রদান। পশ্চিমবঙ্গের ‘দ্য সিকার’-এর কীর্তিতে পাওয়া গেল সোনার খনি। তা পড়ে সাড়া পড়ে গিয়েছে গোটা বিশ্বে।
কোভিডের উৎস অন্বেষণের সূত্রে বারবার উঠে এসেছে চিনের বিজ্ঞানী শি চেংলির নাম। বাদুড় থেকে পাওয়া করোনাভাইরাস নিয়ে গবেষণা করেন বলে ‘ব্যাটওম্যান’ বলে পরিচিত তিনি। তিনিই ‘উহান ইনস্টিটিউট অব ভাইরোলজি’র অধিকর্তা। কোভিড ছড়ানো মাত্র তাঁর গবেষণা নিয়ে নানা ধরনের হইচই শুরু হয়। নিজের ল্যাবরেটরির যোগ যে নেই এই কাণ্ডে, তা বারবার প্রমাণ করার চেষ্টা করেন তিনি। তবে নিজের পক্ষে সওয়াল করার সময়ে শি চেংলি ওই খনির কথা একবারও উল্লেখ করেননি। ২০১২ সালে ওই খনিতে কাজ করার সময়ে ছ’জন শ্রমিক গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। খনিতে অনেক বাদুড় ছিল। কুনমিং মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে কাশি, জ্বর, শ্বাসের কষ্ট নিয়ে ভর্তি হন ওই শ্রমিকরা। তিন মাসের মধ্যে মৃত্যু হয় তিন জনের। ২০১৩ সালে স্নাতকোত্তর স্তরের এক পড়ুয়ার লেখা সেই গবেষণাপত্র ওই ঘটনাটি নিয়ে বেশ কড়া কিছু প্রশ্ন তোলে।
এর সঙ্গে কি সম্পর্কিত অতিমারির করোনাভাইরাস ‘সার্স কোভ-২’?
সেই প্রশ্নের উত্তরের দিকে আরও এক ধাপ এগিয়ে যান বাঙালি ‘দ্য সিকার’। সাহায্য করে সেই গবেষণা। জানা গিয়েছে, মৃত এক শ্রমিকের রক্তের নমুনা পাঠানো হয়েছিল উহান ইনস্টিটিউট অব ভাইরোলজিতে। ধরা পড়েছিল ‘সার্স’ ভাইরাসের উপস্থিতি। সে কথা প্রকাশিত হয় পরবর্তী আরেক গবেষণাপত্রে। সেটিও হাতে এসেছে ‘ড্রাস্টিক’-এর সদস্যদের। বলা হচ্ছে, কোভিডের নানা প্রজাতির ভাইরাসের ঘর এখন উহানের ওই গবেষণাগার।
গত বছর চিনে যখন করোনা ছড়াতে শুরু করে দিয়েছে, শি চেংলির একটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছিল ‘র্যাটজি ১৩’ নামে একটি ভাইরাসের কথা। তার সঙ্গে ‘সার্স কোভ-২’ ভাইরাসের প্রায় ৯৬ শতাংশ মিল রয়েছে বলেও মেনে নেওয়া হয়। ভাইরাসটি কোথায় পাওয়া গিয়েছিল, তা কিন্তু চেংলি প্রকাশ করেননি। পরে ‘ড্রাস্টিক’-এর এক সদস্য অন্য একটি ভাইরাসের খোঁজ পান। তার নাম ‘রেবিটিকোভ / ৪৯৯১’। জানা যায়, ২০১৩ সালে ইউনান এলাকায় সেই ভাইরাসের সন্ধান পান চেংলি। ক’দিন পরে বোঝা গেল ওই দুই নামের ভাইরাস একই প্রজাতির। এ সবের মাস দুয়েকের মধ্যেই ২০১৩ সালের গবেষণাপত্রটি বার করে ফেলেন বাংলার কোভিডান্বেষী। মেলাতে শুরু করেন ধাঁধা!
বাঙালি এই গোয়েন্দার কর্মকাণ্ড দেখে হতবাক গোটা বিশ্ব। দেশবিদেশের পত্রপত্রিকায় কেন্দ্রীয় চরিত্র এখন অজ্ঞাতনামা এই গোয়েন্দা। সম্প্রতি ‘নিউজউইক’ পত্রিকা তাঁকে এক কৃতী স্বশিক্ষিত ইন্টারনেট বিশেষজ্ঞ বলে চিহ্নিত করেছে। লিখেছে, ‘সম্পূর্ণ একার চেষ্টায় এই ব্যক্তি নেটদুনিয়ার সুপ্ত অলিগলি খুঁজে বার করেছেন।’ আমেরিকার আরেক পত্রিকা ‘ভ্যানিটিফেয়ার’ও তাঁর অন্বেষণের ভঙ্গি দেখে মুগ্ধ। সেখানে প্রখ্যাত সাংবাদিক ক্যাথেরিন ইবান লিখেছেন, ‘এ পর্যন্ত সবচেয়ে চমকপ্রদ তথ্য প্রকাশ করেছেন পূর্ব ভারতের এই নাম না জানা গোয়েন্দা।’
কোভিড রহস্যের সমাধান হয়ে গিয়েছে বলে এখনই কেউ দাবি করছেন না। তবে ‘দ্য সিকার’-এর ফাঁস করা তথ্য যে দিশা দেখাবে আগামী তদন্তের, তা বিলক্ষণ বুঝতে পারছেন সকলে। এর পরে ‘উহান ইনস্টিটিউট অব ভাইরোলজি’-র বিরুদ্ধে তদন্তের নির্দেশ এলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই।
ফেলুদা-ব্যোমকেশের দিন শেষ হতে পারে। কিন্তু বাংলায় নতুন গোয়েন্দার আবির্ভাব ঘটেছে। বাঙালির অনেক কিছু গিয়েছে। কিন্তু বুদ্ধির জোর এখনও অটুট!
গ্রাফিক—শৌভিক দেবনাথ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy