অরফ্যানগঞ্জ বাজার এলাকায় বেআইনি খাটাল। সোমবার। নিজস্ব চিত্র
গোবিন্দপুর প্রাথমিক স্কুলের পাশেই ভাঙা একটা গেট। ভিতরে ঢুকলেই সামনে একটা ঝুপড়ি। আর সেই ঝুপড়ি পেরিয়ে ভিতরে ঢুকলেই নজরে আসবে তিনটি আলাদা আলাদা চালা। সেই চালার নীচে নিশ্চিন্তে দাঁড়িয়ে জাবর কাটছে ৩০-৩৫টি গরু-মোষ! আশপাশে ছড়িয়েছিটিয়ে খাটিয়ায় বিশ্রামরত গরু-মোষের মালিকেরা।
কোনও ধ্যাড়ধ্যাড়ে গোবিন্দপুরে নয়। বরং দক্ষিণ কলকাতার অভিজাত পাড়া লেক গার্ডেন্সের মধ্যেই এই ছবি! শুধু এটিই নয়, বিরাট বিরাট খাটাল রয়েছে লেক গার্ডেন্স উড়ালপুলের নীচে, অরফ্যানগঞ্জ বাজার, হেস্টিংসসর্বত্রই। এমনকী, যমজ শহর হাওড়াতেও খাটালের কমতি নেই। রাজ্য সরকারের প্রশাসনিক ভবন থেকে এক কিলোমিটারের মধ্যেই গরু-মোষের রমরমা কারবার।
সম্প্রতি উত্তরবঙ্গে এনসেফ্যালাইটিস ছড়ানোর প্রেক্ষিতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, শহরে তো গরু-মোষ নেই। শুয়োর রয়েছে। সেই শহুরে শুয়োর উচ্ছেদ করার নির্দেশ দেন তিনি। গত ২৩ মার্চ আনন্দবাজার পত্রিকায় শহরে খাটালের রমরমার কথা প্রকাশিত হয়েছিল। তার পরেও টনক নড়েনি প্রশাসনের। সোমবারও শহর ঘুরে উঠে এল একই ছবি।
চিকিৎসকদের একাংশ বলছেন, শুধু শুয়োর থেকেই নয়, সাধারণ গবাদি পশুর থেকেও এনসেফ্যালাইটিস ছড়িয়ে পড়তে পারে। সে ক্ষেত্রে শহরে খাটাল রাখা নিয়ে যথেষ্ট উদ্বেগের কারণ রয়েছে বলে তাঁরা মনে করছেন। কিন্তু শুয়োর ধরতে আদাজল খেয়ে লাগলেও প্রশাসন-পুরসভা কেন খাটাল উচ্ছেদ করছে না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। প্রশাসনের একাংশ অবশ্য বলছেন, শহরে খাতায়-কলমে খাটাল নেই! কিন্তু প্রায়দিন বিকেলেই দল বেঁধে গরু-মোষকে ময়দানে ঘাস খাওয়াতে নিয়ে আসেন মালিকেরা। সেটা কী ভাবে নজর এড়িয়ে যায়, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে।
কী ভাবে আশঙ্কা তৈরি করছে গরু-মোষ? পতঙ্গবিদ ও চিকিৎসকেরা বলছেন, জাপানি এনসেফ্যালাইটিস রোগের বাহক কিউলেক্স বিশনুই মশা সাধারণত গৃহস্থবাড়ির ভিতরে থাকে না। নোংরা খোঁয়াড় কিংবা খাটালে থাকা গবাদি পশুদেরই কামড়ায়। জাপানি এনসেফ্যালাইটিস রোগের ভাইরাস শুয়োর বা গবাদি পশুর দেহে ঢুকে বংশবৃদ্ধি করে। তার পরে সেই পশুকে মশা কামড়ালে সেই ভাইরাস ঢোকে মশার দেহে। সেই মশা আবার কোনও ব্যক্তিকে কামড়ালে তিনি জাপানি এনসেফ্যালাইটিসে আক্রান্ত হন। সাধারণত খোঁয়াড় বা গোয়ালঘরের কাছাকাছি থাকা ব্যক্তিরাই এই রোগে বেশি আক্রান্ত হন।
শহরের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা খাটালে ঘুরেও গরু-মোষের সঙ্গে মানুষের সহাবস্থান দেখা গিয়েছে। অনেকেই মনে করছেন, ওই খাটালের কোনও গরু-মোষের দেহে জাপানি এনসেফ্যালাইটিস ভাইরাস বাসা বাঁধলে তা থেকে শহরে রোগ ছড়িয়ে পড়াও অস্বাভাবিক নয়। শিবপুরের ডিউক রোডেই যেমন ঘিঞ্জি এলাকাতেই অবাধে খাটাল চলছে! একই অবস্থা উত্তর হাওড়াতেও। পুর সূত্রের খবর, শুধু ওই এলাকাতেই ৭০০ খাটাল রয়েছে। হাওড়া পুরসভা জানিয়েছে, তাদের এলাকায় থাকা সব খাটালকেই উচ্ছেদের নোটিস দেওয়া হয়েছে। কাল, বুধবার থেকে শুয়োর ধরতেও নামছে হাওড়া পুরসভা। সেই শুয়োর কোথায় রাখা হবে? হাওড়ার মেয়র রথীন চক্রবর্তী বলেন, “শহরের সব শুয়োরকে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় এনে মশারির ভিতরে রাখা হবে। মশা মারার ধোঁয়াও ছড়ানো হবে। শুয়োরদের নজরে রাখতে বসবে সিসিটিভি।”
শুয়োর ধরপাকড় শুরু হয়েছে কলকাতাতেও। তবে এ দিনও ব্রহ্মপুর, সর্দারপাড়া, মালিপাড়া, রেনিয়া এলাকায় অবাধে ঘুরে বেড়িয়েছে শুয়োর। প্রাণীবিকাশ দফতর সূত্রের খবর, কলকাতা পুর-এলাকায় প্রায় আড়াই হাজার শুয়োর রয়েছে। তার মধ্যে হাতেগোনা কয়েকটি ধরা হয়েছে। সেগুলিকে ধাপার কাছে একটি গাড়ির মধ্যে পুরে রাখা হয়েছে। গাড়িটি যেখানে রাখা হয়েছে, তার পাশেই একটি বড়সড় আবাসন। সেখানকার এক বাসিন্দা বলেন, “আমাদের ঘরের পাশে গাড়িবোঝাই শুয়োর রাখায় বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে আতঙ্কে রয়েছি।” সল্টলেকেও কেষ্টপুর ও ইস্টার্ন ড্রেনেজ চ্যানেলের দু’ধারে এবং মূল সল্টলেকের ভিতরেও ১, ১৭, ১৮, ১৯ নম্বর ওয়ার্ড ও দত্তাবাদেও শুয়োর চরে বেড়ায়। সেখানে মশা মারার কামান দাগা শুরু হলেও এখনও শুয়োর ধরা শুরু হয়নি।
শুয়োর ধরা না হয় শুরু হয়েছে। কিন্তু পুর-প্রশাসন খাটাল উচ্ছেদ করছে না কেন? কলকাতা পুরসভার মেয়র পারিষদ (জঞ্জাল) দেবব্রত মজুমদার বলছেন, “কলকাতা শহরে তেমন কোনও খাটাল নেই।” তা হলে লেক গার্ডেন্স, হেস্টিংস, খিদিরপুরের খাটালগুলি কি কলকাতার বাইরে? এর উত্তর মেলেনি। কলকাতা পুরসভা শহরে খাটাল দেখতে না পাওয়ায় অনেকটাই আশ্বস্ত খাটাল মালিকেরা। তবে সংবাদমাধ্যমে ছবি বেরোলে সমস্যা হতে পারে, এটা অবশ্য খাটাল-মালিকেরা ভালই জানেন। গোবিন্দপুর স্কুলের পাশে ওই খাটালের ছবি তুলতে সঙ্গী চিত্রসাংবাদিক ক্যামেরা বার করতেই হাঁ-হাঁ করে তেড়ে এলেন এক মালিক শিবনাথ যাদব। বললেন, “ছবি তুলবেন না।” কেন? শিবনাথের ব্যাখ্যা, শহরে খাটাল বেআইনি। এই ছবি খবরের কাগজে বেরোলে তাঁদের উচ্ছেদ করা হতে পারে। তা হলে খাটাল রেখেছেন কেন? “এখান থেকে তুলে দিলে যাব কোথায়? গরু-মোষ চলে গেলে খাবই বা কী?”
অতএব সংবাদপত্রে ছবি না বেরোলে শিবনাথেরা যে নিশ্চিন্তেই খাটাল চালিয়ে যাবেন, সে ব্যাপারটা ভালই বোঝা গেল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy