Advertisement
০২ নভেম্বর ২০২৪
Mental Health

নতুন বছরে ছেলেকে নিয়ে নতুন করে শুরু হবে সংসার, মনোরোগ জয় করে ঘরে ফিরছেন ওড়িশার চুমকি

বাড়ি ওড়িশায়। মনোরোগ থেকে সেরে ওঠার পরে একটি গোটা বছর ধরে ছিলেন কলকাতার বন্ডেল রোডে ‘প্রত্যয়’-এর বাড়িতে। নতুন বছর আসার আগে স্বামী-পুত্রের সঙ্গে ঘরে ফিরছেন তিনি।

Recovered mental health patient returns home to Orissa from the assisted living space Pratyay in Kolkata

—প্রতীকী চিত্র।

আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৭ ডিসেম্বর ২০২৩ ১৮:৩২
Share: Save:

স্বামী আছেন, আছে সন্তান। সংসারে ফেরার ইচ্ছাও ছিল। পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছিল মনোরোগ। লুম্বিনী পার্ক মানসিক হাসপাতালে তাই দু’দফায় কেটে গিয়েছে বেশ কয়েক বছর। তার পর সেরে উঠেও ঘরে ফেরার পথ সহজ হয়নি। গত এক বছর ধরে নানা ভাবে চেষ্টা চালিয়ে অবশেষে স্বামী-সন্তানের মুখ দেখতে পেলেন চুমকি। নতুন বছরে নতুন করে সংসার করার স্বপপূরণের আশ্বাস পেয়ে এখন বাড়ি যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন তিনি।

চুমকির ভাল নাম সত্যভামা পুরোহিত। বাড়ি ওড়িশার সোনাপুর জেলার বৈদ্যনাথ গ্রামে। মনোরোগ থেকে সেরে ওঠার পরে একটি গোটা বছর ধরে ছিলেন কলকাতায় বন্ডেল রোডে ‘প্রত্যয়’-এর বাড়িতে, যেখানে মানসিক রোগ থেকে সেরে ওঠা আরও অনেকেই থাকেন। মানসিক হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে মূলস্রোতে ফেরার আগে অনেকেই এই বাড়িতে থেকে নিজেকে প্রস্তুত করেন। নানা ধরনের কাজ শেখা, নিজের যত্ন নেওয়া, সকলের সঙ্গে মিলেমিশে থাকা— সবের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার অভ্যাস করার চেষ্টা চলে এখানে। অনেকের ক্ষেত্রে আবার মনোরোগ থেকে সেরে ওঠার পরেও বাড়িতে ঠাঁই হয় না, পরিবার সঙ্গ দেয় না— তেমন বহু জনেও এই বাড়িতে থাকেন। কিছুটা সময় এখানে কাটিয়ে বোঝার চেষ্টা করেন, বাড়ি ফিরবেন, না কি নতুন করে নিজের জীবন শুরু করবেন। চুমকির ক্ষেত্রে অবশ্য সে সব ধন্দ ছিল না। তিনি বাড়ি ফিরতেই চেয়েছিলেন বলে জানালেন ‘প্রত্যয়’-এর প্রজেক্ট ম্যানেজার অভিজিৎ রায়। তবে মনোরোগীদের বাড়ি ফেরানো সহজ কাজ নয়। নানা নিয়মকানুন আছে। বহু জায়গায় চিঠি লেখালেখির ব্যাপার থাকে। অভিজিৎ জানান, গত কয়েক মাস ধরে নানা দফতরে ঘুরে চলছিল চুমকির বাড়ি ফেরার ব্যবস্থা। ইতিমধ্যে চুমকি মন দিয়েছিলেন সাবান তৈরি আর পুতুল বানানোর কাজ শেখায়। ‘প্রত্যয়’-এর বাকি আবাসিকদের সঙ্গে সে কাজই করতেন তিনি।

Recovered mental health patient returns home to Orissa from the assisted living space Pratyay in Kolkata

স্বামী-সন্তানের সঙ্গে সত্যভামা পুরোহিত ওরফে চুমকি। —নিজস্ব চিত্র।

এ বছরের ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাস নাগাদ প্রথম খবর যায় তাঁর স্বামী নীলাম্বর পুরোহিতের কাছে। তিনিও জানান, স্ত্রীকে ঘরে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চান। তাঁদের সন্তানেরও ভাল হবে তাতে। কিন্তু তার পর বহু দিন আর তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ হয় না। তখন এক ভাবে ধরে নেওয়া হয় যে, অন্য বহু পরিবারের মতো বুঝি আসলে স্ত্রীকে বাড়ি নিয়ে যেতে চান না নীলাম্বর। হয়তো তাঁদের পরিবারেও ততটা দরকার নেই চুমকিকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার। তবে বছর ঘোরার আগেই সেই আশঙ্কা ভুল প্রমাণিত হয়। সত্যভামাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে এসেছেন স্বামী। সঙ্গে এসেছে তাঁদের দশ বছরের পুত্র প্রিন্স পুরোহিতও। সব দেখে মনোসমাজকর্মী রত্নাবলী রায় বলেন, ‘‘অনেক ক্ষেত্রেই সেরে ওঠা মনোরোগী মহিলারা পরিবারে সস্তা শ্রমের যোগানদার হিসাবে বিবেচিত হন। সত্যভামা হয়তো এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। যদি শেষ পর্যন্ত তা হয়, তা হলে, সত্যভামার পরিবার, তাঁর স্বামী ও সন্তান অভিনন্দনযোগ্য কাজ করছেন। কিন্তু তাতে চিকিৎসা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সত্যভামাকে তাঁর চারপাশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে তোলাটা এবং তার দায় তাঁর স্বামী, সন্তানের উপর চাপিয়ে দেওয়ার বিধি-ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্নটার সমাধান হয় না।’’

Recovered mental health patient returns home to Orissa from the assisted living space Pratyay in Kolkata

মাকে নিয়ে বাড়ি ফিরবে প্রিন্স। —নিজস্ব চিত্র।

সত্যভামাদের পরিবারের গল্পটি সরলরেখায় দেখা যায় না। বছর ৩৫-এর নীলাম্বরের যেমন স্ত্রীকে নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা ছিল, তেমনই ছিল পুত্র প্রিন্সকে সারিয়ে তোলার তাগিদ। বছর দশের প্রিন্স রক্তের ক্যানসারে আক্রান্ত। কয়েক মাস আগে গুজরাতে ছেলের চিকিৎসা শুরু হয়। সে সময়ে চিকিৎসার খরচ বাবদ কিছু টাকাও পেয়েছিলেন। ফলে ছেলের দিকেই মন দিতে হয়েছিল। স্ত্রীকে নিতে আসার ব্যবস্থাপনা করতে পারেননি। এখন সে সব থেকে মুক্ত হয়ে সোজা কলকাতায় চলে এসেছেন নীলাম্বর। সত্যভামাকে সঙ্গে নিয়েই একেবারে গ্রামে ফিরবেন তিনি। নতুন বছরে নতুন ভাবে সংসার শুরু করবেন দু’জনে। অসুস্থ প্রিন্সও মায়ের যত্ন পাবে ভেবে আনন্দে আছেন বাবা। নীলাম্বর বলেন, ‘‘চুমকি বাড়ি গেলে ছেলেকে দেখতে পারবে। প্রিন্সকে নতুন করে আবার স্কুলে ভর্তি করব। ও আজকাল সারা দিন মোবাইল নিয়ে খেলে। মায়ের নজরে থাকলে সে সব আর করতে পারবে না।’’ চুমকিও ঘরে ফিরে সংসারে মন দিতে উৎসাহী। নিজের সংসারে ফিরে কী কী রান্নাবান্না করবেন, এখনই সে সব ভাবতে শুরু করেছেন তিনি। তাতে চুমকি মানসিক ভাবে আরও ভাল থাকবে বলেই অভিজিৎদের বিশ্বাস। রত্নাবলী বলেন, ‘‘মনোরোগের প্রাতিষ্ঠানিক চিকিৎসার যে ধাঁচা, সমাজ বিচ্ছিন্নতা তার অন্যতম শর্ত। ফলে, চিকিৎসকের মতে কোনও মনোরোগী যখন সুস্থ, হাসপাতালে থাকার আর কোনও প্রয়োজন নেই, তখন তিনি তাঁর আজীবনের চেনা চারপাশ থেকে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন। ফলে শুধু পরিবারের কাছে তাঁকে পৌঁছে দেওয়াটা তাঁর জন্য এবং তাঁর পরিবারের জন্যও সব সময়ে কাঙ্ক্ষিত সমাধান হতে পারে না। পরিবারের কাছে, তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক চিকিৎসা পরবর্তী যা ইতিকর্তব্য, সেগুলির জন্য পর্যাপ্ত রসদ না-ও থাকতে পারে।’’ সে রসদ জোগানোর চেষ্টা করেন মনোসমাজকর্মীরা। চুমকির ঘরে ফেরার ব্যবস্থা হওয়ায় তাই বিশেষ ভাবে আশাবাদী তাঁরা। আশা রাখছেন সকলকে নিয়ে ভাল থাকবেন সত্যভামা।

অন্য বিষয়গুলি:

Mental Health .patient Ratnabali Roy
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE