Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

বন্ধ্যাকরণের পরেও সম্ভব সন্তান লাভ

একই দুর্ঘটনায় তিন সন্তানকে হারিয়েছেন দমদমের হেলা দম্পতি। সন্তানশোকের তীব্রতায় এই মুহূর্তে তাঁরা সম্পূর্ণ আচ্ছন্ন। ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবার ন্যূনতম চেতনাটুকুও অবশিষ্ট নেই। কিন্তু পরিবারের অন্যদের এখন আর এক প্রশ্ন তাড়া করে বেড়াচ্ছে। তিন সন্তান হওয়ার পরে মালা হেলা বন্ধ্যাত্বকরণ অস্ত্রোপচার অর্থাৎ, লাইগেশন করান।

সোমা মুখোপাধ্যায় ও অরুণাক্ষ ভট্টাচার্য
কলকাতা শেষ আপডেট: ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০১:২৫
Share: Save:

একই দুর্ঘটনায় তিন সন্তানকে হারিয়েছেন দমদমের হেলা দম্পতি। সন্তানশোকের তীব্রতায় এই মুহূর্তে তাঁরা সম্পূর্ণ আচ্ছন্ন। ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবার ন্যূনতম চেতনাটুকুও অবশিষ্ট নেই। কিন্তু পরিবারের অন্যদের এখন আর এক প্রশ্ন তাড়া করে বেড়াচ্ছে। তিন সন্তান হওয়ার পরে মালা হেলা বন্ধ্যাত্বকরণ অস্ত্রোপচার অর্থাৎ, লাইগেশন করান। আচমকা সন্তানহীন মালার ভবিষ্যতে কি মা হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে?

চিকিৎসকেরা জানান, মহিলাদের লাইগেশন কিংবা পুরুষদের ক্ষেত্রে ভ্যাসেকটমির পরেও সন্তান হতে পারে ‘রিক্যানালাইজেশন’ নামে একটি অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে। তবে সাফল্যের হার খুবই কম। মহিলাদের পক্ষে তা যথেষ্ট ঝুঁকিপূর্ণও বটে।

স্ত্রীরোগ চিকিৎসক সঞ্জীব মুখোপাধ্যায় জানান, কিছু ক্ষেত্রে সন্তানের মৃত্যু হলে লাইগেশন করা মায়েরা ফের সন্তানধারণে ওই অস্ত্রোপচার করাতে চান। প্রাথমিক ভাবে তাঁদের নিরুৎসাহিতই করা হয়। কারণ এর সাফল্যের হার বড়জোর ২০-৩০ শতাংশ। তিনি বলেন, ‘‘লাইগেশনে দু’টি ফ্যালোপিয়ান টিউব কিছুটা কেটে বেঁধে দেওয়া হয়। যাতে ডিম্বাণু ও শুক্রাণু মিলিত না হতে পারে। রিক্যানালাইজেশন-এর অর্থ ফের পেট কেটে টিউবের বাঁধা অংশ খোলা এবং কাটা অংশ জুড়ে দেওয়া। এর সাফল্যের হার খুবই কম।’’

এই ধরনের অস্ত্রোপচারে কিছু ঝুঁকির দিকও রয়েছে। স্ত্রীরোগ চিকিৎসক মল্লিনাথ মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘এ ক্ষেত্রে ভ্রূণ জরায়ুতে না পৌঁছে টিউবেই থেকে যেতে পারে (এক্টোপিক প্রেগন্যান্সি)। সঠিক নজরদারি না থাকলে এতে মায়ের মৃত্যুও হতে পারে।’’

তিন-তিনটি সন্তানের জন্ম দেওয়ার পরে মালাদেবীর লাইগেশন হয়েছে। তাঁর ক্ষেত্রে সাফল্যের আশা কি আরও কম? বিশেষজ্ঞদের মতে, আলাদা ভাবে সাফল্যের হার কমে যাচ্ছে, তা বলা যাবে না। তবে যে কোনও ক্ষেত্রেই রিক্যানালাইজেশনের আগে মহিলাদের ল্যাপারোস্কোপি করে টিউবের অবস্থা ভাল করে যাচাই করা দরকার। সাফল্যের আশা থাকলে তবেই অস্ত্রোপচার করা উচিত। অন্যথায় মা-সহ পরিবারকে নিরস্ত করাই শ্রেয়। তা ছাড়া, বেসরকারি হাসপাতালে প্রথমে ল্যাপারোস্কোপি এবং পরে অস্ত্রোপচারের খরচ যথেষ্ট বেশি। তাই সন্তানহারা মা-বাবাদের ফের সন্তানলাভের ভরসা সরকারি হাসপাতালগুলিই।

শুধু লাইগেশন নয়, পুরুষের ভ্যাসেকটমির পরে ফের সন্তানের জন্ম দেওয়ার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। এর সাফল্যের হারও খুব কম। সরকারি হাসপাতালগুলিতে কার্যত এই ধরনের অস্ত্রোপচারের চেষ্টাই করা হয় না। তবে সম্প্রতি বারাসত জেলা হাসপাতালে এমন একটি ঘটনায় সাফল্য মিলেছে।

কলকাতার বাঁশদ্রোণীর অমর বিশ্বাস ও রেখা বিশ্বাস ২০০৬ সালে তাঁদের কন্যার জন্মের পরে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন— আর সন্তান চাই না। তাই ভ্যাসেকটমি করান পেশায় অটোচালক অমরবাবু। কিন্তু কয়েক মাসের মেয়ের দুর্ঘটনায় মৃত্যুর কয়েক বছর পরে ফের সন্তান পাওয়ার জন্য হন্যে হয়ে উঠেছিলেন তাঁরা। বিভিন্ন সরকারি হাসপাতাল ফিরিয়ে দিলেও বারাসত হাসপাতালের ডাক্তারেরা জানান, তাঁরা শেষ চেষ্টা করে দেখবেন। সুপার সুব্রত মণ্ডল জানান, শল্যচিকিৎসক কঙ্কন চট্টোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে অস্ত্রোপচারটি সফল হয়। রেখাদেবী ফের অন্তঃসত্ত্বা।

প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো ও কর্মীর অভাবে জেলা হাসপাতালগুলি যখন ধুঁকছে বলে অভিযোগ, তখন কী ভাবে এমন অস্ত্রোপচারের ঝুঁকি নেওয়া হল? কঙ্কনবাবুর জবাব, ‘‘এটি খুবই সূক্ষ্ম অস্ত্রোপচার। খালি চোখে দেখা যায় না, এমন সুতো দিয়ে এই অস্ত্রোপচার করা হয়েছে। সেই সুতোও বাইরে থেকে আনতে হয়েছে। সব ক্ষেত্রে এমন অস্ত্রোপচার সফল হয় না। তবে সদিচ্ছা থাকলে চেষ্টা করে দেখা যেতেই পারে।’’

স্ত্রীরোগ চিকিৎসক অভিনিবেশ চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘এটি ভীষণ সূক্ষ্ণ, ঝুঁকিপূর্ণ অস্ত্রোপচার। এর জেরে ওই মহিলা গর্ভবতী না হলে তাঁদের টেস্টটিউব বেবির মতো কোনও বিকল্প পদ্ধতির আশ্রয় নিতে হতো।’’

প্রশ্ন উঠেছে, কেন কলকাতার বড় সরকারি হাসপাতাল এই ধরনের অস্ত্রোপচার না করে ফিরিয়ে দেয়? স্বাস্থ্যকর্তাদের বক্তব্য, সরকারি হাসপাতালগুলির স্ত্রীরোগ বিভাগে সাধারণ প্রসবের চাপই এত বেশি যে রিক্যানালাইজেশনের মতো কম সাফল্যের অস্ত্রোপচারের ব্যাপারে সাধারণ ভাবে উৎসাহ দেখানো হয় না।

তবে কি লাইগেশন বা ভ্যাসেকটমির পরে ফের দম্পতি সন্তানের কথা ভাবলে কোনও আশার আলোই দেখাতে পারবে না সরকারি হাসপাতাল? স্বাস্থ্য দফতরের এক শীর্ষ কর্তা জানান, এই অস্ত্রোপচারগুলিকে জনপ্রিয় করতেই রিক্যানালাইজেশন-এর কথা মানুষকে জানানোর ব্যাপারে একটা সময়ে বেশ জোর দেওয়া হত। ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব মেডিক্যাল রিসার্চ (আইসএমআর)-এর টাকায় বেশ কয়েক বছর আগে এই রিক্যানালাইজেশন-এর জন্যই আরজিকর মেডিক্যালে একটি বিশেষ কেন্দ্র গড়া হয়। কয়েক বছর পরে আপাতত তা মুখ থুবড়ে পড়েছে। ওই কর্তা বলেন, ‘‘বেলঘরিয়া এক্সপ্রেসওয়ের দুর্ঘটনার পরে সত্যিই এর মানবিক প্রয়োজনের দিকটা আবার সামনে আসছে। ওই কেন্দ্রকে ফের চাঙ্গা করার ব্যাপারে ভাবনা শুরু করতে হবে।’’

অন্য বিষয়গুলি:

pregnancy sterilisation child birth test tube
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE