ষাট-সত্তর বছর বা তারও আগে সাধারণ মানুষের হাতে নগদ টাকার জোগান তেমন থাকত না। অলংকরণ: শৌভিক দেবনাথ।
সাহেবদের একাদশী নেই, সংক্রান্তি নেই, অম্বুবাচীর বালাই নেই। এমনকি, তাদের নতুন বছর বৈশাখ মাসে শুরুও হয় না। শুধু সাহেবই বা কেন, চিনা, জাপানি, হটেনটট, এস্কিমো— কেউই তিথি-নক্ষত্রের ধার ধারে না। এ সব মান্যিগন্যির বালাই শুধু এই দেশে। অন্যদের কথা থাক, বাংলা সাল নিয়ে বাঙালি ছাড়া আর কারই বা মাথাব্যথা আছে? সত্যি কথা বলতে কি, বাঙালিরও মাথাব্যথা নেই। ওই মুষ্টিমেয় কিছু বাঙালি এখনও বাংলা অব্দের কিছু খোঁজখবর রাখে মাত্র। তিথি-নক্ষত্রেরও দরকার পড়ে বিয়ে, পৈতে বা পুজো ইত্যাদির জন্য। আশ্চর্যের বিষয়, তবু কিন্তু পঞ্জিকা এখনও বেশ হুহু করেই বিক্রি হয়, বাংলা খবরের কাগজে বাংলা তারিখ নিয়মিত ছাপার রেওয়াজ এখনও অব্যাহত। যদিও তিথি-নক্ষত্র বা তারিখ নিয়ে বিভিন্ন পঞ্জিকার মতবিরোধও আমাদের অজানা নয়। সূর্যসিদ্ধান্ত আর দৃকসিদ্ধান্তে বড় রকমের ফারাকও বিদ্যমান। অনেক গোঁজামিল এবং গোলযোগ নিয়েই বাংলা ক্যালেন্ডার এখনও বাঙালির ঘরে, দোকানে, অফিসে ঝুল খায়।
তবে হ্যাঁ, পয়লা বৈশাখ হল পয়লা বৈশাখ। এর আবেগই আলাদা। নতুন বাংলা বছরের শুরু, নববর্ষের সূচনা আমবাঙালির কাছে এখনও কল ফর এ সেলিব্রেশন।
একটু পিছিয়ে গেলে, অর্থাৎ ষাট-সত্তর বছর বা তারও আগে সাধারণ মানুষের হাতে নগদ টাকার জোগান তেমন থাকত না। পাড়ার দোকান বা চেনা ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে বাকি বা ধারে জিনিস কেনা একটা প্রচলিত রেওয়াজ ছিল। মাসান্তে গৃহকর্তা বেতন পেলে সেই ধার-বাকি শোধ দেওয়া হত। রেওয়াজ এখনও আছে। বাকির কারবার বড় বড় ব্যবসাতেও চলে। কিন্তু সেটা অন্য প্রসঙ্গ। আমাদের মধ্যবিত্ত গেরস্থালিতে ছোটখাটো ধার-বাকির ধারা বহুকাল অব্যাহত ছিল। অনেক সময়ে মাসান্তে সবটা শোধ হতও না, কিছুটা রয়েও যেত। নববর্ষ আবার হালখাতারও দিন, অর্থাৎ পুরনো হিসেবের খাতার বদলে নতুন হিসেবের খাতার শুরু। তাই হালখাতা। রীতি ছিল, নববর্ষে পুরনো বছরের ধার-বাকি মিটিয়ে আবার নতুন করে হিসেবনিকেশ শুরু করা। একটু কষ্ট করে হলেও গেরস্তেরা ওই দিন দোকানের বাকি-বকেয়া মিটিয়ে দিতে সচেষ্ট হতেন। ময়মনসিংহে আমাদের একটা কাপড়ের দোকান ছিল, জগদ্ধাত্রী ভাণ্ডার। তাই ব্যাপারটা আমি বাল্যকাল থেকেই অনুধাবন করার সুযোগ পেয়েছি। নববর্ষের দিন বিক্রিবাটা বন্ধ, শুধু অতিথি-অভ্যাগতদের আপ্যায়ন। আমার ওপরে ভার থাকত অতিথি এলে তার গায়ে গোলাপজল সিঞ্চন করার। একটা ছোট্ট ঝাঁঝরি দিয়ে সেই কাজটা আমি সোৎসাহে করতামও। তার পর অতিথিরা পকেট বা ট্যাঁক থেকে টাকা বার করে বাকি-বকেয়া মিটিয়ে দিতেন। আর তাঁদের হাতে তুলে দেওয়া হত মিষ্টির রেকাবি। না, তখন কিন্তু প্যাকেট সিস্টেমের প্রচলন ছিল না। অতিথিরা দোকানে বসেই তৃপ্তি করে মিষ্টি সাঁটাতেন।
আজকালকার বাচ্চারা খেতে চায় না বলে মায়েদের খুব আক্ষেপ করতে শুনি। খেতে চায় না, কিন্তু আয়োজন থাকে প্রচুর। দুধ, ডিম, ফল, সিরিয়াল, পুষ্টির নানা আয়োজন সত্ত্বেও বাচ্চারা নাকি খাদ্যবিমুখ। আর আমরা জন্মেইছিলাম হাঘরের খিদে নিয়ে। বাছবিচারেরও বালাই ছিল না। যা পেতাম, তা-ই খেয়ে ফেলতাম। পেটে অনন্ত খিদের বসতি। যেন ভিতরে এক রাক্ষস ঘাপটি মেরে আছে। তা বলে এমন মনে করার কারণ নেই যে, আমাদের অভিভাবকেরা আমাদের খেতে টেতে দিতেন না। ভ্যারাইটি না হলেও মুড়ি, চিঁড়ে, দুধ, কলা, খই, মুড়কির যথেষ্ট আয়োজন থাকত। তবু আমাদের খাইখাই ভাবের অবসান ঘটত না। ফলে পেট ছেড়ে দিত প্রায়ই। কেন কথাটা বললাম, তা এ বার বলি।
আসলে নববর্ষ বা হালখাতার দিন দোকানে দোকানে মিষ্টিমুখ করানোর রেওয়াজ থাকত বলে আমি এবং আমার তৎকালীন বন্ধুরা দল বেঁধে বিভিন্ন দোকানে হানা দেওয়ার চেষ্টা করতাম। কিন্তু বড় একটা সফল হতাম না, কারণ খদ্দের না হলে যে আপ্যায়ন জোটে না এবং বকেয়া টাকা শোধ করারও যে একটা রেওয়াজ আছে, সেটা তখন বুঝতে পারার মতো বয়স হয়নি। আর তখনকার আমরা এখনকার ছেলেমেয়েদের মতো তেমন চালাকচতুরও ছিলাম না কিনা!
আস্তিক হোক বা নাস্তিক, অল্পবিস্তর অদৃষ্টবাদী আমরা সবাই। অদৃষ্ট মানে, যা দৃষ্ট নয়। অর্থাৎ, এক মিনিট পরে আমার কপালে কী ঘটবে, তা আমি জানতে পারছি না। আর এই অনিশ্চয়তাই জীবনকে যাপনযোগ্য করেছে। যদি জীবনের সবটাই আমার আগে থেকে জানা থাকে, তা হলে জীবনযাপনই আলুনি হয়ে যায়। তাই আস্তিক-নাস্তিক নির্বিশেষে আমরা সবাই একটু না একটু অদৃষ্টবাদী বাই ডিফল্ট। আর সেই জন্যই নতুন বছর এলে আমাদের আচমকা মনে হতেই পারে, সামনের বছরটা আর একটু ভাল হবে। মনের দুর্বলতাবশে অনেকে পঞ্জিকার রাশিফল দেখেন বা নানা অলীক দিবাস্বপ্নকে অজান্তে প্রশ্রয় দিয়ে ফেলেন। নববর্ষের আগমন আমাদের বেশির ভাগ মানুষকেই একটু না একটু সম্ভাবনার প্রলোভন দেখায়। নতুন বছর মানেই নতুন কিছু, অন্য রকমের কিছু, বেটার কিছু। বাস্তবে তা কমই ঘটে অবশ্য। কিন্তু আমাদের দুর্বল মনের স্বভাবই ওই, নানা স্বপ্নকে পাখির মতো পুষে রাখে বুকের মধ্যে।
১৪২৮ এসে গেল। পৃথিবী আরও একটু পুরনো হল। আমাদের বয়স একটু বাড়ল। নৈরাশ্যবাদীদের কাছে এটা একটা তাৎপর্যহীন ঘটনামাত্র, তার বেশি কিছু নয়। আবার অনেকের কাছে নতুন বছর মানেই বিপুল সম্ভাবনার দরজা খুলে যাওয়া, নতুন উদ্যমের সঙ্কেত, নতুন শপথগ্রহণ। পাশেই বাংলাদেশে পয়লা বৈশাখের উৎসব কী উদ্যম আর উৎসাহের সঙ্গেই না পালিত হয়! দৈনন্দিন জীবনে তাদেরও বাংলা সাল-তারিখের তেমন প্রয়োজন নিশ্চয়ই হয় না! তবু এই উৎসব যাপনের মধ্যে একটি বাঙালিয়ানারও পুনরায় অভিষেক ঘটে বোধহয়।
মনে না রেখে উপায় নেই যে, গত একটা বছর আমরা একটি অনভিপ্রেত, অনাকাঙ্ক্ষিত সংক্রমণের কাছে পণবন্দী হয়ে আছি। তার স্বৈরাচারী শাসনে আমাদের চলাফেরা, মেলামেশা, সামাজিকতা, সবই নিয়ন্ত্রিত। এমন কি প্রেম-প্রণয় থেকে বিবাহবন্ধন পর্যন্ত লাটে ওঠার জোগাড়। গোটা পৃথিবীকে ঘরের মধ্যে কয়েদ করে ফেলেছে একটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জীবাণু। আজও তার দাপট শেষ হয়নি। মানুষের সব রকম সেলিব্রেশনকেই সে ঠান্ডাঘরে পাঠিয়ে ছেড়েছে। এই প্রেক্ষাপটে নববর্ষের এই আগমন আমাদের কতটা উদ্দীপ্ত করবে, তা বলা মুশকিল। তবে লাগাতার ঘরবন্দি হয়ে থাকতে থাকতে ধৈর্য হারিয়ে মানুষ মরিয়া হয়ে বেরিয়েও পড়ছে দেখছি। মাস্ক পরছে না, শরীরী দূরত্ব বজায় রাখছে না, মিছিল-মিটিংয়ে ভিড় করছে। তবে তা কত দূর বিজ্ঞোচিত সিদ্ধান্ত, সেটাই প্রশ্ন। সংক্রমণের ভয়াবহ দ্বিতীয় প্রবাহ পুরনো সব রেকর্ড ভেঙে দিচ্ছে। মৃত্যুহার ঊর্ধ্বগামী, হাসপাতালে ভিড় বাড়ছে, ভেন্টিলেটরের চাহিদা ফের তুঙ্গে। এই পশ্চাৎপটে ১৪২৮-কে কী দিয়ে স্বাগত জানাই, তা ভাবনার বিষয়। হয়তো আবার আমাদের আধাবাস্তবতার ভার্চুয়াল জগতেই নির্বাসন নিতে হবে।
১৪২৮ আমাদের জন্য বরং আরোগ্য নিয়ে আসুক, মুক্তি নিয়ে আসুক, আমাদের নিরন্তর বন্দিত্বের দশা বিমোচিত হোক। নতুন কিছু আর চাই না, ১৪২৮ বরং আমাদের পুরনো দিনগুলোই ফিরিয়ে দিক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy