ভরসা যখন বারান্দা। করিমপুর হাসপাতালে তোলা নিজস্ব চিত্র।
জরুরি বিভাগ থেকে একটু এগোতেই দেখা গেল ওয়ার্ড রুমের সামনের বারান্দায় শুয়ে জনা পনেরো রোগী। কেউ ভুগছেন পেটের যন্ত্রণায়। কেউবা জ্বর, ডায়েরিয়া নিয়ে চিকিৎসাধীন। তাঁদের কারও শয্যা মেলেনি। রোগীর পাশেই বসে পরিজনেরা। কেউ হাতপাখা নিয়ে বাতাস করছেন। কেউ বা এগিয়ে দিচ্ছেন ওধুষ, জলের বোতল। তারই মাঝে নার্স একবার এসে দেখে গেলেন রোগীদের শারীরিক অবস্থা। করিমপুর গ্রামীণ হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেল এমনই ছবি।
শুধু করিমপুর হাসপাতাল নয়, অতিরিক্ত গরমে কমবেশি একই ছবি দেখা গিয়েছে দুই জেলার হাসপাতালগুলিতে। এই ক’দিনে তাপমাত্রার পারদ চড়েছে হু-হু করে। পাল্লা দিয়ে বেড়েছে অসুখবিসুখে আক্রান্তের সংখ্যাও। বেশির ভাগ রোগীই ভুগছেন জ্বর, ডায়েরিয়া ও পেটের যন্ত্রণার অসুখে। প্রতিদিনই কমবেশি ৪০-৫০ জন রোগী ভর্তি হচ্ছে হাসপাতালগুলিতে। বহির্বিভাগেও কোনও কোনও দিন রোগীর সংখ্যা হাজার ছাড়াচ্ছে। এ দিকে, অতিরিক্ত রোগী ভর্তির কারণে শয্যা না পেয়ে মেঝেতেই রেখে চলছে চিকিৎসা। গ্রামীণ হাসপাতালগুলির পাশাপাশি মহকুমা হাসপাতালেও দেখা গিয়েছে একই ছবি।
করিমপুর হাসপাতালের চিকিৎসক সমর বিশ্বাস জানালেন, করিমপুর দুই ব্লকের ও মুর্শিদাবাদের কমবেশি ৬ লক্ষ মানুষ এই হাসপাতালের উপরে নির্ভরশীল। তাঁর অভিজ্ঞতা, ফি গরমে রোগী ভর্তির সংখ্যাটা হু হু করে বেড়ে যায়। এ বছরও টানা গরমে অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। তাঁদের বেশির ভাগেরই পেটের সমস্যা রয়েছে। হাসপাতাল সূত্রে খবর, এখন হাসপাতালে ১০ জন চিকিৎসক থাকার কথা। রয়েছেন তার অর্ধেক। এর মধ্যে অতিরিক্ত রোগীর চাপে চিকিৎসকেরা হাঁপিয়ে উঠছেন। হাসপাতালের সুপার রাজীব ঘোষ মানছেন, বাধ্য হয়েই রোগীদের মেঝেয় রাখতে হচ্ছে। তবে সকলেরই যথাযথ চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
হাসপাতালের মেঝেতেই চিকিৎসা চলছে নন্দনপুরের বাসিন্দা বছর তিরিশের গণেশ শীলের। বমি ও পায়খানার সমস্যায় ভুগছেন। স্ত্রী সুজাতাদেবী বলেন, ‘‘বিস্তর চেষ্টার পরেও শয্যা জোটাতে পারিনি। এখন চিকিৎসাটুকু ঠিকঠাক হলেই হয়। শয্যায় আর কাজ নেই।” একই কথা শোনালেন হোগলবেড়িয়ার বিনয় প্রামাণিক। তিনিও গত পেটের যন্ত্রণা নিয়ে ভর্তি হয়েছেন। মেঝেতে সমস্যা হচ্ছে? তিনি জানালেন, ‘‘অসুবিধা তো হচ্ছেই। তবে পাখার ব্যবস্থা রয়েছে বলে খুব সমস্যা হচ্ছে না।’’
মুর্শিদাবাদেও গরমের কারণে নানা অসুখে নিয়ে ভর্তি হওয়ার সংখ্যাটা এক লাফে বেড়েছে। তবে দুই জেলাতেই এখনও অবধি ‘সানস্ট্রোকে’ মৃত্যুর ঘটনা নজরে আসেনি। বহরমপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল সূত্রে খবর, গত এপ্রিলে ২৯৫২ জন রোগী ভর্তি হয়েছিলেন। মে মাসে সংখ্যাটা চারশো বেড়েছিল। চলতি মাসেও সংখ্যাটা বাড়ছে। মেডিসিন বিভাগের সঙ্গে যুক্ত হামিদ আলির পর্যবেক্ষণ, গরমের ফলে বহু লোকের শারীরিক বিভিন্ন অস্বস্তি হচ্ছে। মাথা ঝিমঝিম করছে। শরীর অবশ হয়ে যাচ্ছে। যে সব রোগী ভর্তি হচ্ছেন, তাঁদের শরীরে জলের মাত্রা কম থাকছে। প্রায় সব রোগীকেই স্যালাইন দিতে হচ্ছে।
ডোমকল মহকুমা হাসপাতালেও একই রকম সমস্যা নিয়ে রোগীদের ভর্তি হতে দেখা গিয়েছে। রোগীর আত্মীয়দের দাবি, হাসপাতালে শয্যা না পেয়ে মেঝেতে রোগীকে রাখতে হচ্ছে। ডোমকলের গোবিন্দপুর এলাকার কামাল হোসেন বলেন, ‘‘সরকারি হাসপাতাল ছাড়া অন্য কোথাও যাওয়ার সঙ্গতি নেই। মেয়েকে ভর্তি করার পর শয্যা না পেয়ে মেঝেতে রাখতে হচ্ছে।’’ ওই হাসপাতালে পানীয় জলের অভাব রয়েছে বলে অভিযোগ তুলছেন রোগীর পরিজনদের কেউ কেউ। তাদের দূরে একটি টিউবয়েল থেকে জল এনে খেতে হচ্ছে।
দিন কয়েক আগে সাদিখাঁড়দেয়াড় গ্রামীণ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন জলঙ্গির বদর আলি। শয্যা না পেয়ে মেঝেতে থাকতে হচ্ছে তাঁকে। তাঁর কথায়, ‘‘মাথার উপরে পাখা রয়েছে। কিন্তু, ঘুরছে না। ওষুধ দেওয়ার কথা বললেই চিকিৎসকেরা একটা স্লিপ ধরিয়ে দিয়ে বলছেন কিনে আনুন।’’ যদিও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অভিযোগ মানেননি।
সহ প্রতিবেদন—শুভাশিস সৈয়দ ও সুজাউদ্দিন
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy