Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪
Mental health

সন্তানের সঙ্গে যাপনের নয়া পাঠ বন্দিদশায়

‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ সামলে সকালে ঘণ্টাখানেকের এই ‘ডিউটি’ গত কয়েক মাসে অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।

প্রতীকী ছবি।

প্রতীকী ছবি।

সম্রাট মুখোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ৩১ অগস্ট ২০২০ ০৪:৩৭
Share: Save:

খেলাধুলোয় কস্মিনকালেও তেমন দড় ছিলেন না মধ্য তিরিশের কর্পোরেট চাকুরে। কিন্তু এখন একেবারে মহেন্দ্র সিংহ ধোনির ভূমিকায়। ল্যাপটপের সামনে বছর তিনেকের বিচ্ছুটিকে বসিয়েই উইকেটকিপার হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ছেন তার পিছনে। সিলি পয়েন্টে স্ত্রী। ফরোয়ার্ড শর্ট লেগে সদ্য হাঁটু বদলে আসা নড়বড়ে মা। একেবারে নিশ্ছিদ্র প্রহরা। না হলেই পাখি ফুড়ুৎ হয়ে আলমারির মাথায় বা টেবিলের নীচে সেঁধিয়ে যাবে। তখন অনলাইন ক্লাসের দফারফা।

‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ সামলে সকালে ঘণ্টাখানেকের এই ‘ডিউটি’ গত কয়েক মাসে অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। ঘেরাটোপ-সর্বস্ব এই নব্য স্বাভাবিকতায় তিন বছরের এক দস্যিকে দু’কামরার শাসনে বন্দি করা যে কতটা দুরূহ, হাড়ে হাড়ে তা টের পাচ্ছেন পরিবারের সকলে। কিন্তু উপায় নেই। নবাগত এক অণুজীব বিশ্ব জুড়ে যে ত্রাসের দেশ তৈরি করেছে, তাতে আপাতত এটাই ভবিতব্য।

লকডাউনের বন্দিদশায় ছোটদের মানসিক স্বাস্থ্য এই মুহূর্তে সারা পৃথিবীতেই চর্চার অন্যতম বিষয়। মাসের পর মাস বাড়ি থেকে বেরোতে না-পেরে তাদের মনে যে অস্থিরতা বা অবসাদ তৈরি হচ্ছে, তা নিয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু মুদ্রার একটি বিপ্রতীপ পিঠও আছে। বিভিন্ন সমীক্ষা বা গবেষণা বলছে, হঠাৎ করে পাওয়া স্বাধীনতা বা চাপমুক্তির যে আনন্দ, ছোটরা অনেকে কিন্তু সেটাও খুব উপভোগ করছে। সম্প্রতি ব্রিটেনের এসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল অ্যান্ড ইকনমিক রিসার্চ’ থেকে প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রে লেখা হয়েছে, মা-বাবাদের অন্তত এক-চতুর্থাংশ জানিয়েছেন, লকডাউনে সন্তানের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্কের প্রভূত উন্নতি হয়েছে। তবে আর্থ-সামাজিক নানা কারণে প্রথম বিশ্বের তুলনায় এ দেশের মা-বাবারা যে লকডাউনে অনেক বেশি চাপে, তা নিয়ে কোনও দ্বিমত নেই।

অভিনেত্রী সুদীপ্তা চক্রবর্তী যেমন জানালেন, তাঁর সাড়ে চার বছরের কন্যা শাহিদা নীরা বাড়ির বন্দি পরিবেশ পছন্দ করছে না মোটেই। যত দিন যাচ্ছে, তার বিরক্তি এবং অস্থিরতার মাত্রাও তত বেড়ে চলেছে। যার প্রকাশ ঘটছে বিভিন্ন আচরণে। মেয়ের পড়াশোনা নিয়েও চিন্তিত সুদীপ্তা। তাঁর কথায়, ‘‘অনলাইন ক্লাস হচ্ছে ঠিকই। কিন্তু বাড়িতেও অনেকটা পড়াতে হয়। আমি তো প্রশিক্ষিত শিক্ষিকা নই। বাচ্চাদের পড়ানোর কিছু নির্দিষ্ট পদ্ধতি আছে, যার সবটা আমার জানা নেই। এ ভাবে মাসের পর মাস চালিয়ে যাওয়াটা খুব মুশকিল। তা ছাড়া, আমারও পেশাগত ব্যস্ততা রয়েছে। মেয়েকে সামলানো, ওকে পড়ানোর পাশাপাশি নিজের কাজকর্ম— এত কিছু সামাল দেওয়াটা খুব কঠিন। আর পেরে উঠছি না।’’

পেশাগত এবং বাড়ির কাজকর্মের সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে ২৪ ঘণ্টা সন্তানের দেখভাল। এই ত্র্যহস্পর্শে মা-বাবাদের অনেকেই হাঁসফাঁস করছেন। তবে যাঁদের ছেলেমেয়েরা তুলনায় একটু বড় এবং অবুঝ বয়সটা পেরিয়ে এসেছে, তাঁদের পক্ষে পরিস্থিতি তুলনায় কিছুটা কম কঠিন।

সাহিত্যিক উল্লাস মল্লিকের যেমন মনে হচ্ছে, লকডাউনে গোটা পরিবারের একসঙ্গে সর্বক্ষণ থাকাটা তাঁর কাছে একটা বড় প্রাপ্তি। তাঁর কথায়, ‘‘আমার মেয়ে সুবর্ণরেখা সামনের বছর মাধ্যমিক দেবে। এখন পড়াশোনা, অনলাইন ক্লাস— এ সব নিয়ে ও খুব ব্যস্ত। তবু মাঝেমধ্যেই এসে আমার সঙ্গে কিছু ক্ষণ গল্প করে যাচ্ছে। দুপুরে গোটা পরিবার একসঙ্গে খেতে বসছি। খারাপ লাগছে না সব মিলিয়ে। মেয়েকে এখন অনেক বেশি সময় দিতে পারছি। এই সময়ে সেটা হয়তো ওর প্রয়োজনও।’’

বাইপাস সংলগ্ন পূর্বালোকের বাসিন্দা আবির সান্যাল ও তাঁর স্ত্রী হৈমন্তী চট্টোপাধ্যায় কাজ করেন একটি নামী তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থায়। তাঁদের চার বছরের মেয়ে বৃন্দা লকডাউনে প্রবল মনমরা হয়ে পড়েছিল। কার্টুন আর খেলনার অকৃপণ সরবরাহেও হাসি ছিল না মুখে। আবির বললেন, ‘‘মেয়ের মন ভাল রাখতে কী করব, বুঝতে পারছিলাম না। এক দিন ওকে ছাদে নিয়ে গিয়ে পাখি দেখাতে শুরু করলাম। হাতে রুটি দিয়ে বললাম, কাকেরা এলে খেতে দিও। গাছ চেনাতে শুরু করলাম। এ ভাবেই একটু নতুন, অচেনা জগতের সন্ধান পেল ও। লকডাউন না হলে ওর এই অভিজ্ঞতাটা হত না।’’

স্ত্রী হৈমন্তী আবার বলছেন, ‘‘অফিস আর বাড়ির মধ্যে কী ভাবে ভারসাম্য রাখা যায়, লকডাউনে তা শিখে গিয়েছি। কিন্তু বাড়িতে বন্দি থাকতে থাকতে মেয়ে আজকাল একটু বেরোলেই ভয় পায়। গাড়িতে উঠলে কাঁদে। এক দিন খুব প্রয়োজনে ওকে নিয়ে শপিং মলে গিয়েছিলাম। দেখলাম, এসক্যালেটর দেখেও ভয় পাচ্ছে। এই পরিস্থিতি বেশি দিন চললে ওর মনে তার কী প্রভাব পড়বে, ভেবে ভয় করছে।’’

প্রশ্নটা অতএব রয়েই গেল। মা-বাবা এবং ছোটদের জন্য লকডাউন অভিশাপ, না আশীর্বাদ? কে জানে, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে গেলে কোভিড-১৯ যখন কেবলই স্মৃতিধার্য এক অঘটন হয়ে থেকে যাবে, তখন রচনা বইয়ের পাতাতেও হয়তো ঠাঁই পাবে এই দ্বন্দ্ব।

অন্য বিষয়গুলি:

Mental health Children
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy