রাজ্যের তরফে শোনার কেউ নেই। তাই চিকিৎসায় গাফিলতির ভুরি ভুরি অভিযোগ নিয়ে এ রাজ্যের মানুষ দলে দলে গিয়ে ভিড় করছেন দিল্লির দরবারে!
এবং পরিস্থিতি এমনই দাঁড়িয়েছে যে, নয়াদিল্লির মেডিক্যাল কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়া (এমসিআই)-র চোখে রাজ্য মেডিক্যাল কাউন্সিলগুলির মধ্যে পশ্চিমবঙ্গেরটিই এখন সবচেয়ে অকর্মণ্য! বিভিন্ন রাজ্যে অভিযোগ নিষ্পত্তির হার বিচার করেই তারা এমন সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে। এমসিআইয়ের পর্যবেক্ষণ: পশ্চিমবঙ্গে চিকিৎসায় গাফিলতির কোনও অভিযোগেরই কার্যত সময়মতো সুরাহা হয় না। ভুক্তভোগীরা রাজ্য কাউন্সিলের দরজায় ঘুরে ঘুরে সুকতলা ক্ষইয়ে ফেললেও ফাইল গড়ায় না। বস্তুত এ ব্যাপারে রাজ্যকে একাধিক বার হুঁশিয়ারি-চিঠি দিয়েও লাভ হয়নি বলে হয়নি আক্ষেপ করছেন এমসিআই-কর্তারা।
অনন্য উদাহরণ সুহানা-কাণ্ড। উত্তর ২৪ পরগনার স্বরূপনগরের কিশোরীটি পথ দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হয়ে এসএসকেএমে এসেছিল। রক্ত মজুত থাকা সত্ত্বেও ডাক্তাররা দেওয়ার ‘সময় না-পাওয়ায়’ সে মারা যায়। হাসপাতালের তদন্ত কমিটি দ্রুত চার ডাক্তারকে দোষী সাব্যস্ত করে রিপোর্ট দেয়। কিন্তু পরবর্তী আট-ন’মাসে স্বাস্থ্যভবন বা রাজ্য কাউন্সিল, কেউই দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি।
খোদ মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের চিঠিতে সম্প্রতি সুহানা-কাণ্ডে নড়াচড়া শুরু হয়েছে। বলাই বাহুল্য, এটা ব্যতিক্রমী ঘটনা। ক’মাস আগে কলকাতার এক সরকারি ও দু’টি বেসরকারি হাসপাতালের মোট পাঁচ ডাক্তারের বিরুদ্ধে অভিযোগ নিয়ে কাউন্সিলের সামনে ধর্নায় বসেছিলেন কিছু রোগীর পরিজনেরা, যাঁরা কিনা গত ১৩ বছর ধরে সুবিচার চেয়ে ঘুরছেন! ইতিমধ্যে রাজ্যে সরকার পাল্টেছে, কাউন্সিলের বোর্ড বদলেছে। কোথাও ভরসা না-পেয়ে ওঁরা এ বার সরাসরি এমসিআইয়ের দ্বারস্থ হয়েছেন।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কিন্তু ক্ষমতায় এসেই ঘোষণা করেছিলেন, তাঁর অগ্রাধিকার-তালিকায় শীর্ষে রয়েছে স্বাস্থ্য। সেই সুবাদে চিকিৎসায় গাফিলতির যে কোনও অভিযোগের দ্রুত নিষ্পত্তিরও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি। সেই সূত্রে কাউন্সিলের পূর্বতন বোর্ডের ‘ব্যর্থতা’র যুক্তি দেখিয়ে নতুন বোর্ড গড়া হয় তিন বছর আগে, যার মাথায় বসানো হয়েছে তৃণমূলের চিকিৎসক-বিধায়ক নির্মল মাঁঝিকে। যদিও কাউন্সিল-সূত্রের খবর, এই তিন বছরে কাজ বিশেষ কিছু হয়নি। তেরো-চোদ্দো বছর আগের অভিযোগও পড়ে রয়েছে। কাউন্সিল সভাপতি কী বলেন?
‘‘আপনাদের কাছে এ সব শুনে আমাকে প্রতিক্রিয়া দিতে হবে নাকি?’’— প্রথমে মন্তব্য করেন নির্মলবাবু। পরে বলেন, ‘‘আমার সঙ্গে দিল্লির সম্পর্ক খুব ভাল। যা কথা বলার, ওদের সঙ্গে বলব।’’ এমসিআই তাঁকে কিছু জানিয়েছে কিনা জিজ্ঞাসা করা হলে নির্মলবাবুর জবাব, ‘‘কোনও চিঠি পাইনি।’’
এমসিআই-কর্তাদের অবশ্য দাবি, রাজ্যকে একাধিক বার জানানো হয়েছে। পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গের মেডিক্যাল কাউন্সিল সম্পর্কে এ হেন মনোভাব এমসিআইয়ের বৈঠকেও প্রকাশিত হয়েছে, যার লিখিত বয়ান এসেছে এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার হাতে। তারাও রাজ্য সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে লাগাতার চিঠি লিখছে। সংগঠনটির তরফে চিকিৎসক কুণাল সাহার মন্তব্য, ‘‘মুখ্যমন্ত্রীকে জানিয়েও ফল হয়নি। উল্টে নির্মল মাঁঝির ক্ষমতা বেড়েছে।’’ প্রসঙ্গত এসএসকেএমের কুকুর-কাণ্ডে নাম জড়ানো ইস্তক কাউন্সিলের সভাপতি পদ থেকে নির্মলবাবুর অপসারণের দাবিতে সরব হয়েছে একাধিক চিকিৎসক সংগঠনও। তাদের অভিযোগ, নির্মলবাবু মেডিক্যাল এথিক্সের তোয়াক্কা না-করে মানুষের হাসপাতালে কুকুরের ডায়ালিসিস করাতে চেয়েছিলেন।
রাজ্য কাউন্সিলের অনেকেও বীতশ্রদ্ধ। এক প্রবীণ সদস্যের কথায়, ‘‘অভিযোগের নিষ্পত্তি করতে হলে নিয়মিত বৈঠক দরকার। এখানে তো বৈঠক না-হওয়াটাই নিয়ম!’’ তা হলে কাউন্সিলে হয়টা কী?
আর এক সদস্যের জবাব, ‘‘গল্প-গুজবেই কেটে যায়। কখনও খোঁজ নেওয়া হয়, নির্দিষ্ট কিছু ডাক্তারের নামে কোনও অভিযোগ আছে কি না। থাকলে দ্রুত এগোনোর নির্দেশ আসে।’’
নিষ্ক্রিয়তার ফল ভুগছে দিল্লি। নিয়ম অনুযায়ী, রাজ্যে অভিযোগ দাখিলের ছ’মাসের মধ্যে সংশ্লিষ্ট কাউন্সিল যদি নিষ্পত্তি না করে কিংবা না-করার গ্রহণযোগ্য কারণ না-দেখায়, তা হলে সরাসরি দিল্লিতে এমসিআইয়ের দ্বারস্থ হওয়া যাবে। ‘‘পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে এটাই যেন নিয়মে দাঁড়িয়েছে! ফি মাসে প্রচুর অভিযোগ দিল্লিতে জমা পড়ছে। শুনানির জন্য রোগী বা তাঁর পরিবারকে দৌড়ঝাঁপ করতে হচ্ছে। ভোগান্তির একশেষ!’’— মন্তব্য দিল্লির এক কর্তার। তাঁরা জানিয়েছেন, ‘অকর্মণ্যতা’র নিরিখে পশ্চিমবঙ্গের পরে হরিয়ানার স্থান। তবে সেখানেও অভিযোগের প্রতিকার হয়েছে ও হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় যথেষ্ট বেশি।
এখানেই শেষ নয়। এমসিআই বিভিন্ন অভিযোগের নিষ্পত্তি করে সংশ্লিষ্ট ডাক্তারদের রেজিস্ট্রেশন বাতিলের সুপারিশ করলেও পশ্চিমবঙ্গ মেডিক্যাল কাউন্সিল বহু ক্ষেত্রে তা মানছে না বলে আক্ষেপ শোনা যাচ্ছে দিল্লিতে। উদাহরণ হিসেবে
এ রাজ্যের তিন বেসরকারি ডাক্তারের উল্লেখ করেছেন এমসিআইয়ের এক কর্তা। তিনি বলেন, ‘‘ওঁদের শুনানিতে ডেকে পাঠানো হয়েছিল। এক বার নয়, তিন-তিন বার। আসেননি। শেষে এমসিআই একতরফা সিদ্ধান্ত নিলে ওঁরা দিল্লি ছুটে আসেন। জানান, রাজ্য কাউন্সিলই নাকি তাঁদের দিল্লির ডাকে গুরুত্ব দিতে বারণ করেছিল!’’
অর্থাৎ, বিচারের দায়িত্ব নিজে এড়িয়ে অন্যের বিচারেও পরোক্ষে বাধার সৃষ্টি! দিল্লির এই গুরুতর অভিযোগের জবাব দেবেন, রাজ্য মেডিক্যাল কাউন্সিলের তরফে এমন কাউকে অবশ্য পাওয়া যায়নি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy