ডাক্তারবাবুকে (বাঁ দিকে সাদা শার্ট) ঘিরে গ্রামবাসীরা। —নিজস্ব চিত্র।
ওঁদের কেউ অসুস্থ হলেই তাঁর শরণাপন্ন হন।
প্রয়োজনে তাঁর কাছ থেকে নিখরচায় ওষুধ পান।
রাত-বিরেতে কোনও রোগীকে কলকাতার হাসপাতালে স্থানান্তরিত করতে হলেও তিনি যাবতীয় ব্যবস্থা করে দেন।
গত কয়েক বছরে কুলতলির গ্রামীণ হাসপাতালের চিকিৎসক পিন্টু রঞ্জন মণ্ডল গ্রামবাসীদের বড় ভরসার মানুষ হয়ে গিয়েছেন। সোমবার তাঁকে বদলি করানো হচ্ছে। কিন্তু সেই বদলি রুখতে কয়েক দিন ধরেই দাবি তুলছিলেন গ্রামের মানুষ। এমনকী, শনিবার থেকে রীতিমতো আন্দোলনেও নেমেছেন তাঁরা।
ঘটনাটি ঘটেছে দক্ষিণ ২৪ পরগনার কুলতলির জয়নগর গ্রামীণ হাসপাতালে। স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, বহু বছর আগে জামতলা মোড়ের কাছে প্রায় ৮ বিঘা জমির উপরে জয়নগর প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রটি তৈরি হয়েছিল। বছর ১৫-২০ আগে সেটি গ্রামীণ হাসপাতালে উন্নীত হয়। বর্তমানে বেডের সংখ্যা ৩০টি। এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রের উপরে কুলতলি ব্লকের জালাবেড়িয়া-১ ও ২, কুন্দখালি গোদাবর, মেরিগজ্ঞ-১ ও ২, গোপালগজ্ঞ, দেবীপুর, ভুবেনশ্বৱী ও মৈপিঠ— ৯টি পঞ্চায়েতের প্রায় আড়াই লক্ষ মানুষ নির্ভরশীল।
তবে পরিকাঠামোয় নানা সমস্যা থেকেই গিয়েছে। বর্হিবিভাগে প্রায় ৪০০ রোগী ভিড় জমান রোজ। সেই তুলনায় চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীর সংখ্যা যথেষ্ট কম। ব্লক মেডিক্যাল অফিসার সহ একজন স্থায়ী ও একজন অস্থায়ী চিকিৎসক। মেডিক্যাল অফিসার যেখানে থাকার কথা ৭ জন, রয়েছেন মাত্র ২ জন। সিনিয়ার নার্স ৭ জন। চতুর্থ শ্রেণির কর্মী রয়েছেন মাত্র ৭ জন। ফলে রোগীদের উপযুক্ত পরিষেবা দেওয়ার মতো উপযুক্ত ব্যবস্থা নেই। চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের থাকার জন্য ১২টি আলাদা আবাসন থাকলেও বহু বছর আগে তার অ্যাবেস্টসের ছাউনি জীর্ণ হয়ে গিয়েছে। বর্ষাকালে ঘরের মধ্যে জল পড়ে। জোরে বৃষ্টি হলে ছাতা মাথায় দিয়ে রাত কাটাতে হয় আবাসনের বাসিন্দাদের। ভাল শৌচাগারের ব্যবস্থা নেই। সারা হাসপাতাল চত্ত্বর প্রাচীর দিয়ে ঘেরা না থাকায় স্বাস্থ্যকেন্দ্রের মধ্যে বহিরাগতদের আনাগোনা লেগেই থাকে। স্বাস্থ্যকেন্দ্রের মাঠে বাঁধা থাকে গরু-ছাগল। এ ছাড়া, নিকাশি ব্যবস্থা ভাল না থাকায় বর্ষায় হাসপাতাল চত্বরে জলে থৈ থৈ করে।
২০১০ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর বাসন্তী এলাকার বাসিন্দা মিন্টুরঞ্জন মণ্ডল জেনারেল ফিজিসিয়ান হিসাবে এই হাসপাতালে কাজে যোগ দেন। তারপর কেটে গেছে প্রায় সাড়ে তিন বছর। তাঁর বাড়িতে বাবা ডায়াবেটিস রোগী এবং এক ভাই প্রতিবন্ধী হওয়ায় তাঁদের দেখাশনার জন্য কাছাকাছি বাসন্তী ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে বদলির জন্য ২০১৪ সালের ৪ অগস্ট স্বাস্থ্য দফতরে বদলির আবেদন করেছিলেন। সেই মতো স্বাস্থ্য দফতর তা মঞ্জুরও করে।
সপ্তাহ খানেক আগে স্থানীয় বাসিন্দারা সে বিষয়ে ইন্টারনেটে খোঁজ পান। তারপরেই বাসিন্দারা ওই চিকিৎসকের বদলি আটকাতে ‘কুলতলি জনস্বাস্থ্য রক্ষা কমিটি’ গঠন করে আন্দোলন শুরু করেছেন। শনিবার সকালে স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সামনে মাইক লাগিয়ে প্যান্ডেল খাটিয়ে বিক্ষোভ-সভা শুরু করেন কয়েকশো বাসিন্দা। বিক্ষোভ সভা চলাকালীন কমিটির কয়েক জন মিন্টুরঞ্জনবাবুর বদলি আটকানোর দাবি নিয়ে সহ ব্লক মেডিক্যাল অফিসারের সঙ্গে দেখা করেন। প্রায় ঘণ্টা চারেক বিক্ষোভ চলার পর ব্লক মেডিক্যাল অফিসারের আশ্বাস ও পরামর্শে অবরোধ তুলে নেওয়া হয়।
কিন্তু মিন্টুবাবুকে এ ভাবে ধরে রাখতে কেন চাইছেন বাসিন্দারা?
অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, সাধারণ মানুষের আপদে-বিপদে তাঁদের পাশে আন্তরিক ভাবে থেকে সকলের ভরসা জয় করে নিয়েছেন ডাক্তারবাবু। তাঁর সম্পর্কে মানুষজনের মত, কাউকে সহজে ‘রেফার’ করেন না। সাধ্যমতো চিকিৎসা করার চেষ্টা করেন। চিকিৎসা সংক্রান্ত কোনও পরামর্শের দরকার হলে ডাক্তারবাবুর সঙ্গে সহজেই কথা বলা যায়। রোগীকে প্রয়োজনে কোথায় নিয়ে যেতে হবে, কী ভাবে যেতে হবে, সব ব্যবস্থা করেন দেন মিন্টুবাবু।
দিপালী হালদার, সুচিত্রা মণ্ডল, রঞ্জন হালদাররা জানান, ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে অন্য চিকিৎসক প্রাইভেট চেম্বারে প্রায়ই ব্যস্ত থাকেন। কিন্তু মিন্টুবাবুকে দরকারে সব সময়ে পাওয়া যায়। তাঁদের কথায়, ‘‘যাঁরা ওই চিকিৎসকের বদলি রুখতে এখানে আন্দোলন করছেন, সকলেই কোনও না কোনও সময়ে ডাক্তারবাবুর থেকে উপকৃত হয়েছেন।’’
কী বলছেন মিন্টুবাবু?
তাঁর কথায়, ‘‘বাড়ির সমস্যার জন্য আমি বদলি চেয়েছিলাম। কিন্তু এখানে মানুষ যে ভাবে আমাকে ভালবাসেন, তাতে আমি গর্বিত। স্বাস্থ্যব্যবস্থা নিয়ে চারিদিকে যখন নানা সমস্যা চলছে, তার মধ্যেও এ ভাবে ওঁরা আমাকে ধরে রাখতে চাইছেন দেখে আমি আপ্লুত।’’
বিএমওএইচ সুপদ মল জানান, মিন্টুবাবুর বদলির নির্দেশ এসে গিয়েছে। সে ক্ষেত্রে তাঁর কিছু করার নেই। তা ছাড়া, ওই চিকিৎসকের জায়গায় নতুন চিকিৎসক নিয়োগ হয়ে গিয়েছে। পাশাপাশি তাঁর বক্তব্য, ‘‘মিন্টুবাবু যদি নিজের ইচ্ছার কথা স্বাস্থ্য দফতরকে জানান, সেখান থেকেই পরবর্তী সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’ মিন্টুবাবু এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘‘আমি কোনও লিখিত আবেদন জানাব না। সরকারি সিদ্ধান্ত মেনেই চলব।’’
দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা স্বাস্থ্য আধিকারিক অসীম দাস মালাকার বলেন, ‘‘ওই চিকিৎসকের আবেদনের ভিত্তিতে বদলি মঞ্জুর হয়েছে। ওঁর জায়গায় অন্য চিকিৎসক নিয়োগও হয়েছে। তবে বিক্ষোভকারীরা আমার কাছে গণস্বাক্ষর-সহ বদলি আটকাতে আবেদন করেছেন। তা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাব। বিক্ষোভকারীরা সোমবার আমরা সঙ্গে দেখা করার জন্য আসবেন।’’ পরিকাঠামো-সংক্রান্ত সমস্যাগুলি নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানিয়েছেন তিনি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy