Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

মানসিক হাসপাতালে স্তম্ভিত সচিব

বহির্বিভাগের রোগী ও তাঁদের বাড়ির লোকেদের পানীয় জলের জন্য একটি মাত্র কল। তার পাশেই টিউবওয়েল অকেজো পড়ে। বহির্বিভাগের পিছনে সিঁড়ি দিয়ে নেমে নোংরা নর্দমার পাশ দিয়ে হেঁটে কলের কাছে পৌঁছোতে হয়। নর্দমায় আর্বজনায় ভরা জমা জলে খেলছে মশার লার্ভা। কলের নীচে প্রতিনিয়ত জল পড়ে সান বাঁধানো সিমেন্টে শ্যাওলা জমে পিচ্ছিল।

বহরমপুর মানসিক হাসপাতাল পরিদর্শনে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের যুগ্মসচিব ধরিত্রী পণ্ডা। —নিজস্ব চিত্র।

বহরমপুর মানসিক হাসপাতাল পরিদর্শনে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের যুগ্মসচিব ধরিত্রী পণ্ডা। —নিজস্ব চিত্র।

নিজস্ব সংবাদদাতা
বহরমপুর শেষ আপডেট: ০৬ জুন ২০১৫ ০১:০২
Share: Save:

বহির্বিভাগের রোগী ও তাঁদের বাড়ির লোকেদের পানীয় জলের জন্য একটি মাত্র কল। তার পাশেই টিউবওয়েল অকেজো পড়ে।

বহির্বিভাগের পিছনে সিঁড়ি দিয়ে নেমে নোংরা নর্দমার পাশ দিয়ে হেঁটে কলের কাছে পৌঁছোতে হয়। নর্দমায় আর্বজনায় ভরা জমা জলে খেলছে মশার লার্ভা। কলের নীচে প্রতিনিয়ত জল পড়ে সান বাঁধানো সিমেন্টে শ্যাওলা জমে পিচ্ছিল।

শুক্রবার বহরমপুর মানসিক হাসপাতালে এসে এই সব দৃশ্য দেখে কার্যত শিউরে উঠলেন সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে গঠিত কমিটির চেয়ারপার্সন তথা কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের যুগ্মসচিব ধরিত্রী পণ্ডা। রাজ্য স্বাস্থ্য অধিকর্তার সামনেই উষ্মা প্রকাশ করে অবিলম্বে পরিশ্রুত পানীয় জলের যন্ত্র বসানোর পরামর্শ দিলেন। পানীয় জলের ঠাঁই পরিচ্ছন্ন করার কথাও বললেন।

দেশের মানসিক হাসপাতালগুলির হাল ফেরাতে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে ওই কমিটি গড়া হয়েছে। চেয়ারপার্সন ধরিত্রীদেবী, স্বাস্থ্য অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথী ও কমিটির বিভিন্ন সদস্য যখন হাসপাতালে এসে পৌঁছন, তখন বেলা পৌনে ১১টা মতো বাজে। বহির্বিভাগে রোগীর ভিড়। গাড়ি থেকে নেমে ধরিত্রীদেবী সোজা সেখানেই চলে যান। কিন্তু সেই পরিকাঠামো দেখে তিনি সন্তুষ্ট হতে পারেননি।

একের পর এক প্রশ্ন করতে থাকেন তিনি: পুরুষ ও মহিলা রোগীদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা নেই কেন? কাউন্সেলিং কোথায় করা হয়? রোগীরা সকলে দাঁড়িয়ে থাকে কেন? রোগী ও তাঁদের বাড়ির লোকজনের বসার ব্যবস্থা নেই? হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বেশির ভাগ প্রশ্নের সদুত্তর দিতে পারেননি। ধরিত্রীদেবী বলেন, রোগীদের জন্য বেঞ্চ বা চেয়ারের ব্যবস্থা করতে হবে। পুরুষ ও মহিলা রোগীদের মাঝে পর্দা টাঙাতে হবে। পৃথক শৌচালয়ও করতে হবে। যথেষ্ট সংখ্যক সিলিং ফ্যান লাগানোর কথাও বলেন তিনি।

রোগী ও তাঁদের পরিজনদের জন্য চেয়ার বা বেঞ্চের ব্যবস্থা করা হলেও তাঁরা সেখানে বসতে পারবেন কি না তা নিয়ে অবশ্য সন্দেহ রয়েছে। হাসপাতালের কর্মীরা জানান, অন্য দিন বিভিন্ন ওষুধ প্রস্তুতকারক সংস্থার প্রতিনিধিদের ভিড়ে ভরে থাকে বহির্বিভাগ। এ দিনও তাঁরা ভিড় করেছিলেন। কিন্তু স্বাস্থ্যকর্তাদের দেখে তাঁরা চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলার সাহস পাননি। কিন্তু পরে হয়তো দেখা যাবে এক শ্রেণির চিকিৎসকের প্রশ্রয়ে ওষুধ প্রস্তুতকারক সংস্থার প্রতিনিধিরাই চেয়ার বা বেঞ্চে বসে রয়েছেন অথবা সেখানে ওষুধে ভরা ব্যাগ রেখে দিয়েছেন।

পানীয় জলের জায়গা দেখে ধরিত্রীদেবী হাসপাতাল সুপারকে প্রশ্ন করেন— ‘‘এত নোংরার মধ্যে দিয়ে পানীয় জল খেতে রোগী ও তাঁদের বাড়ির লোকজন কী ভাবে যাবেন?’’ সুপার পবিত্রকুমার সরকার বলেন, ‘‘আমাদের এখন ১৫ জন সাফাইকর্মী রয়েছে। থাকার কথা ২৫ জন। ফলে একটু সমস্যা হচ্ছে।’’ ধরিত্রীদেবী স্বাস্থ্য অধিকর্তা কাছে জানতে চান, সে ক্ষেত্রে কোনও এজেন্সি থেকে লোক নিয়োগ করা হচ্ছে না কেন? স্বাস্থ্য অধিকর্তা বলেন, ‘‘এজেন্সি থেকে লোক নিয়োগের জন্য নির্দেশ পাঠানো হয়েছে। সেই মতো কাজ চলছে।’’ যদিও এই জবাবে ধরিত্রীদেবী বিশেষ সন্তুষ্ট হতে পারেননি। হাসপাতালের এক কর্মীর কথায়, যে ট্যাঙ্ক থেকে ওই পানীয় জল সরবরাহ হয়, শেষ কবে তা পরিষ্কার করা হয়েছে, তা কারও জানা নেই।

এর পরে কমিটির সদস্যেরা নারী ও পুরুষ আবাসিকদের থাকার জায়গায় যান। রোগীদের সঙ্গে কথাও বলেন। পরে ধরিত্রীদেবী বলেন, ‘‘দৈনন্দিন খাবারের যা তালিকা রয়েছে, সেই মতো খাবার পরিবেশন করা হলেও তার মান উন্নত করা প্রয়োজন।’’ ২০১১ সালে খাদ্যে ‘বিষক্রিয়া’য় সাত দিনে সাত জন এবং এক মাসে ১৬ জন রোগীর মৃত্যুর পরে গুণগত মান পরীক্ষা করে তবেই রোগীদের খাবার পরিবেশনের নির্দেশ দিয়েছিল রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর। সেই কাজ দেখার জন্য দুজন চিকিৎসক ও এক নার্স নিয়ে কমিটিও গড়া হয়। বর্তমানে ওই কমিটির যেমন কোনও অস্তিত্ব নেই, তেমনি খাবারের মান বিষয়ে স্বাস্থ্য ভবনে সাপ্তাহিক রিপোর্ট পাঠানোর বিষয়টিও লাটে উঠেছে। স্বাস্থ্য অধিকর্তা অবশ্য এ বিষয়ে কোনও মন্তব্য করেননি।

ধরিত্রীদেবী বলেন, ‘‘পরিচ্ছন্নতা থেকে খাবারের মান— সব দিক দিয়েই উন্নতির প্রয়োজন রয়েছে। এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা এখানে সুস্থ মহিলা আবাসিকদের জন্য কাজ করছে দেখে ভাল লাগল। কিন্তু আরও বড় জায়গার প্রয়োজন রয়েছে। সেই সঙ্গে সুস্থ পুরুষ আবাসিকদের নিয়েও কাজ করার কথা বলব। সুস্থ আবাসিকদের পুনর্বাসনের মধ্যে দিয়ে সমাজের মূল স্রোতে ফিরিয়ে দেওয়া প্রয়োজন।’’

মানসিক হাসপাতালের দু’জন সুস্থ মহিলা আবাসিক বহির্বিভাগে ওষুধ দেওয়ার কাজ করেন দেখে খুশি হন ধরিত্রীদেবী। তাঁর মতে, কাজের মধ্যে দিয়ে বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করতে পারলেই আবাসিকরা সবচেয়ে ভাল থাকবেন। তবে সরকার আগামী দিন তাঁদের স্থায়ী চাকরির বন্দোবস্ত করবে কি না, তা নিয়ে তিনি কো‌নও মন্তব্য করতে চাননি।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE