রোগের সূত্রপাত জ্বর। সেই সঙ্গে চোখ-নাক-মুখ দিয়ে রক্তক্ষরণ, গায়ে ব্যথা, মাথার যন্ত্রণা আর পেট খারাপ। এ ভাবে কয়েক সপ্তাহ চলার পরই মৃত্যু।
ডেঙ্গি নয়। রোগের নাম ইবোলা ভাইরাস ডিজিজ (ইভিডি)। এই ভাইরাস সংক্রমণ নিয়েই এখন উদ্বিগ্ন বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা ‘হু’। যে হেতু এই রোগের কোনও নির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই, প্রতিষেধক টিকা নেই, তাই আফ্রিকার চার দেশে রোগটি ছড়িয়ে পড়তেই হু বিশ্বজুড়ে সতর্কতা জারি করেছে। বাদ যায়নি ভারতও।
রোগটা তো আফ্রিকার, তা হলে ভারতে সতর্কতা কেন? ইবোলার ভাইরাসের হানায় ইতিমধ্যেই আফ্রিকার চার দেশে মারা গিয়েছেন ৯৩২ জন। ৪ অগস্ট পর্যন্ত আক্রান্ত ১৭১১ জন। আফ্রিকার ওই সব দেশ থেকে সারা পৃথিবীতে লোক যাওয়া-আসা করছে অনবরত। এই যাতায়াত কোনও ভাবেই বন্ধ করা যায় না। এই সব দেশে প্রায় ৪৫ হাজার ভারতীয়ও রয়েছেন। সতর্কতা জারি করে হু বলছে, ইবোলা ভাইরাস এতটাই সংক্রামক যে সামান্য হাঁচি-কাশি থেকেই তা অন্যদের দেহে ছড়িয়ে পড়তে পারে। সংক্রমণের ভয় থাকছে মৃতদেহ থেকেও। এই রোগে মৃত্যুহারও আর পাঁচটা ভাইরাস ঘটিত রোগের থেকে বেশি।
দিল্লিতে একটি হেল্পলাইন খুলেছে কেন্দ্রীয় সরকার। ২৪ ঘণ্টাই খোলা থাকবে সেটি। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী হর্ষ বর্ধন আজ বলেন, “উদ্বেগের কোনও কারণ নেই। এখনও এ দেশের কেউ আক্রান্ত হননি।” গত ২০ জুলাই ইভিডি আক্রান্ত এক পর্যটকের খোঁজ পাওয়া গিয়েছিল দ্বারকা থেকে। তিনিও এখন ভাল আছেন, জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। আজ মুম্বইয়ের ছত্রপতি শিবাজি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর জানিয়েছে, যাত্রীদের স্বাস্থ্যপরীক্ষার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করেছে তারা। ম্যাঙ্গালোর বিমানবন্দর জানিয়েছে, কাল থেকেই তারা যাত্রীদের স্ক্রিনিং শুরু করবে।
তবে সে ভাবে হেলদোল নেই পশ্চিমবঙ্গ সরকারের। যেখানে রাজ্যে এনসেফ্যালাইটিসে মৃতের সংখ্যা বেড়ে চলেছে প্রতিদিনই। পশ্চিমবঙ্গের স্বাস্থ্য দফতরের কর্তাদের কথায়, তাঁদের কাছে কোনও সরকারি নির্দেশ এসে পৌঁছয়নি। তাই ইবোলা-প্রতিকারে এ মুহূর্তে তাঁদের কিছুই করার নেই। কলকাতা বিমানবন্দরের স্বাস্থ্য আধিকারিক অবশ্য জানালেন, যদি কোনও যাত্রী অসুস্থ অবস্থায় নিজে থেকে তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন বা অভিবাসন দফতরের কর্তারা যদি কোনও যাত্রীকে তাঁদের কাছে নিয়ে আসেন, তা হলে তাঁরা নিশ্চয় ওই ব্যক্তিকে পরীক্ষা করে দেখবেন।
আজ জেনিভায় নিজেদের সদর দফতরে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন হু-র কর্তারা। তাঁরা জানিয়েছেন, চিকিৎসা বিজ্ঞানের দীর্ঘ ইতিহাসে ইবোলা ভাইরাসের এ হেন সংক্রমণের নজির আর নেই। ভাইরাসটি প্রথম ধরা পড়েছিল ১৯৭৬ সালে, কঙ্গো ও সুদানে। সে বার প্রায় সাতশো লোক মারা গিয়েছিলেন ইবোলার ছোবলে। কিন্তু এ বার মৃত্যুর সেই সংখ্যাটা ছাড়িয়েছে বহু আগেই। এ বার ইবোলা প্রথম ধরা পড়ে গত মার্চ মাসে গিনিতে। সেখান থেকেই ধীরে ধীরে পড়শি দেশগুলোতেও ছড়িয়ে পড়ে রোগ। হু-র রিপোর্ট অনুযায়ী, গিনিতেই মৃত ৩৯৩। সিয়েরা লিওনে সংখ্যাটা ২৮৬, লাইবেরিয়ায় ২৮২ ও নাইজিরিয়ায় ১।
ভাইরাসটির মূল বাহক এক প্রজাতির ফল-খেকো বাদুড়। তারা ভাইরাসটি বহন করে, তবে নিজেরা আক্রান্ত হয় না। পরে ওই বাদুড় থেকে বিভিন্ন প্রাণীর দেহে রোগ সংক্রামিত হয়। আর কোনও ভাবে আক্রান্ত প্রাণীদের মাংস খেয়ে ফেললে বা সংস্পর্শে এলেই ইবোলা ভাইরাসটি চুপিসাড়ে ঢুকে পড়ে মানবদেহে। তার পর সংক্রামিত মানুষের রক্ত বা দেহরস (যেমন হাঁচি, কাশি) থেকে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে অন্য মানুষের দেহে।
জ্বর ও রক্তক্ষরণ দিয়ে শুরু। সেই সঙ্গে গায়ে ব্যথা, মাথার যন্ত্রণা, বমি, পেট খারাপ। ক্রমশ বিকল হতে শুরু করে লিভার, কিডনির মতো বিভিন্ন অঙ্গ। শেষে মৃত্যু ঘটে কোষের। হু-র রিপোর্ট অনুযায়ী, ইবোলায় আক্রান্ত ব্যক্তির মৃত্যুর আশঙ্কা ৯০ শতাংশ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতিকারের ব্যবস্থা যে হেতু নেই, তাই প্রতিরোধ ব্যবস্থাই জোরদার করা হোক। এড়িয়ে চলা হোক আক্রান্তের (মানুষ বা পশু-পাখি) সংস্পর্শ। যদিও আফ্রিকার ওই চারটি দেশের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য বা যোগাযোগ ব্যবস্থা এখনই বন্ধ না করার অনুরোধ জানিয়েছে হু।
আফ্রিকা থেকেই প্রতিদিন বহু মানুষ এ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যাতায়াত করেন। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী হর্ষ বর্ধন তাই আজ জানিয়েছেন, আগাম সতর্কতা হিসেবে পুণের ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ভাইরোলজি’ এবং দিল্লির ‘ন্যাশনাল সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল’-কে পরিকাঠামো বাড়ানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যদিও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, সংক্রমণ রুখতে রোগীদের আলাদা করে রাখার (আইসোলেশন) ব্যবস্থা এ দেশে নেই। এক চিকিৎসকের আক্ষেপ, “ইবোলা রোগীদের জন্য লেভেল ৫ আইসোলেশন চেম্বার দরকার। এখানে লেভেল ৩-র বেশি নেই।” তাই ইবোলা ভাইরাস এক বার ভারতে ঢুকে পড়লে যে কী হবে, তা নিয়ে আতঙ্কিত চিকিৎসকেরাই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy