কোহবার পেন্টিং। নিজস্ব চিত্র।
শিল্পি যখন তাঁর ভাবনাকে অভিনব ক্যানভাসে মূর্ত করে তোলেন, নতুন পথে হাঁটতে শুরু করেন, তখন তা পথ দেখায় বহুজনকে। কলকাতার ভবানীপুরের প্রজ্ঞাপারমিতা দত্ত বিবাহসূত্রে দীর্ঘ দিন বিহারের মধুবনীর বাসিন্দা ছিলেন। সেখানেই তিনি শেখেন মধুবনী আর্ট। মিথিলার এই শিল্পকে শুধু ক্যানভাসেই সীমাবদ্ধ না রেখে, তিনি চামচ, কোস্টার, চিরুনি, ব্যাগ, ক্লাচ, ফাইল, কি-হোল্ডারের মতো ঘরোয়া জিনিসেও ফুটিয়ে তুলেছেন।
এই প্রসঙ্গে বিস্তারিত হওয়ার আগে মধুবনী শিল্প সম্পর্কে দু’চার কথা বলে নেওয়া যাক। মিথিলার এই লোকশিল্প ক্যানভাসে মূর্ত করে তোলে সেখানকার সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য। মূলত বাড়ির মহিলারাই এই ছবি আঁকতেন বাড়ির মাটির দেওয়ালে, যার মধ্য দিয়ে ফুটে উঠত পুরাণের গল্প এবং সমাজব্যবস্থার নানা চিত্র। স্থানীয় লোকেদের বিশ্বাস মধুবনী শিল্পের অস্তিত্ব সেই রামায়ণের সময় থেকে। রাম এবং সীতা পরস্পরকে প্রথমবার দেখেছিলেন মধুবনের গহনে। আর্থিক ভাবে পিছিয়ে পড়া এই অঞ্চলটির পরিস্থিতি দেখে অল ইন্ডিয়া হ্যান্ডিক্রাফটস বোর্ডের ডিরেক্টর হিসেবে পুপুল জয়কর (অ্যাকটিভিস্ট, লেখক, রিভাইভালিস্ট অব ট্রাডিশনাল অ্যান্ড ভিলেজ আর্ট) তখন শিল্পী ভাস্কর কুলকার্নিকে পাঠিয়েছিলেন মিথিলার মহিলাদের দেওয়ালের বদলে কাগজে আঁকার বিষয়ে উৎসাহিত করতে, যা আর্থিক পরিস্থিতির উন্নয়ন করবে। তাঁদের প্রচেষ্টায় ক্রমশ ছড়িয়ে পড়তে থাকে মধুবনী আঁকা। অন্যান্য লোকশিল্পের মতো সমাজের মনস্তত্ত্বের আভাস মেলে মধুবনী চিত্রেও।
এহেন আঁকায় প্রজ্ঞাপারমিতার দখল এল কী ভাবে? ‘‘আমার শ্বশুরমশাই মধুবনীতে ডাক্তার ছিলেন। তাঁর কাছে বহু মহিলা আসতেন চিকিৎসার জন্য, যাঁরা মধুবনী পেন্টিং করতেন। তাঁদের কাছ থেকেই আমার শেখা এবং বিভিন্ন বিষয় জানা। ওখানকার মহিলাদের পৌরাণিক কাহিনি বিষয়ে গভীর জ্ঞান,’’ বললেন তিনি।
প্রজ্ঞাপারমিতার আঁকা বিভিন্ন ছবির মধ্যে বিশেষ ভাবে নজর কাড়ে ‘কোহবর’ পেন্টিং। ‘‘মধুবনীতে ফুলসজ্জার ঘরে কোহবর ছবিটি রাখা হয়। মাঝে আঁকা মানুষটি বংশের প্রধান, বংশদণ্ড। তাঁর থেকে লতায়-পাতায় সম্পর্ক বেরিয়েছে। সেটা আসলে তুলে ধরছে বাঁশ। সারা ছবি জুড়ে রয়েছে জোড়া পাখি (প্রেমের প্রতীক), হাঁস, কচ্ছপ (দীর্ঘ জীবনের কামনায়), শ্রীকৃষ্ণ, পশুপাখি, হাতি, সাপ, কেন্নো কী নেই তাতে। ১৪-১৫ রকম উপাদান থাকে ছবিতে,’’ ব্যাখ্যা করলেন প্রজ্ঞাপারমিতা।
মধুবনী শিল্পের দুই স্তম্ভ সীতা দেবী ও জগদম্বা দেবী, কাজের জন্য রাষ্ট্রপতি পুরস্কার পেয়েছিলেন। সীতাদেবীর কাছ থেকেই প্রজ্ঞাপারমিতা শিখেছিলেন মধুবনী পেন্টিং। তাঁর কথায় উঠে এল সে অভিজ্ঞতা, ‘‘উনি বাবার কাছে নেবুলাইজ় করাতে আসতেন, সেটা আমি করে দিতাম। তখন আমাকে নানা গল্প শোনাতেন— ইন্দিরা গান্ধী ওঁর আঁকা দেখে কী বলেছিলেন, উনি বহুবার বিদেশ গিয়েছিলেন, কী বিষয়ের উপরে ছবি আঁকতেন ইত্যাদি। উনি আমার আঁকা খুব পছন্দ করতেন। কোহবার সীতাদেবীর কাছ থেকে শিখেছি। উনিই আমাকে সুযোগ করে দিয়েছিলেন বিভিন্ন বাড়িতে গিয়ে মধুবনী আর্ট শেখার।’’
চার ধরনের স্টাইলে মধুবনী পেন্টিং করা হয়। যেমন ভরনি, কচনি, গোধনা এবং তান্ত্রিক। চারটি স্টাইলের মধ্যে প্রথম দু’টি, কচনি অর্থাৎ লাইন পেন্টিং এবং ভরনি অর্থাৎ ভরাট করে আঁকা, বিশেষ জনপ্রিয়। কাঠি, খয়ের, ভেষজ রং দিয়ে গোড়ার ছবিগুলি আঁকা হত। এখন অবশ্য অ্যাক্রিলিকেই আঁকা হয়, তাতে ছবির স্থায়িত্ব বাড়ে। এই আঁকার বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যেগুলো আয়ত্ত করেছেন প্রজ্ঞাপারমিতা। তাঁর কাছ থেকে জানা গেল, মধুবনী দু’টি লাইনে আঁকা হয়। আঁকায় কোনও পেনসিল এবং ইরেজ়ার ব্যবহার হয় না। পুরোটা আঁকা হবে রং, তুলিতে এবং এক টানে। মধুবনী আঁকায় যে দেবতাদের বা মানুষের ছবি থাকে, তার চোখ বড়, টিকালো নাক। শরীর, মুখ ও হাত-পায়ের অনুপাত সমান নয়, ছোট-বড় হতে পারে। এ রকম মুখাবয়বের কারণ জানতে চাইলে প্রজ্ঞাপারমিতার স্বামী রঞ্জন কুমার দত্ত, যিনিও মধুবনীর দীর্ঘ দিনের বাসিন্দা, বললেন, ‘‘মিথিলায় ব্রাহ্মণেরা মূলত মধুবনী পেন্টিং করত। ওই অঞ্চলের ব্রাহ্মণদের খুব ধারালো চোখমুখ এবং গায়ের রং ফরসা। তাদের মুখ-চোখের ছবি ফুটে ওঠে মধুবনী আঁকায়। মাইথলজিক্যাল ছবিরই প্রাধান্য বেশি তাদের আঁকায়। অন্য দিকে নিম্নবর্ণের মানুষেরা যে পেন্টিং করত, তাকে গোধনা পেন্টিং বলা হয়। গোধনা কথার অর্থ উল্কি। উল্কিতে যে ধরনের আঁকা হয়, সেটাই তাদের ছবিতে ফুটে ওঠে।’’ সেই সঙ্গে আরও জানা গেল, জিতওয়ারপুর ও রাঁটি দু’টি গ্রাম বিশেষ প্রসিদ্ধ মধুবনী শিল্পের জন্য। প্রথমটি বিখ্যাত ভরনির জন্য, রাঁটির সুনাম রয়েছে কচনির জন্য।
এই ছবি আঁকাও হয় বিশেষ ধরনের কাগজে। জলে গোবর গুলে তার মধ্যে চাঁপা ফুলের রং এবং গদের আঠা মিশিয়ে মিশ্রণটিকে পাতলা সুতির কাপড়ে ছেঁকে নিতে হবে। এ বার আর একটি পাতলা সুতির কাপড় মিশ্রণে ভিজিয়ে নিয়ে সমান ভাবে তার প্রলেপ লাগাতে হবে হ্যান্ডমেড কাগজে। এই মিশ্রণটি যত ভাল ভাবে তৈরি হবে এবং প্রলেপ দেওয়া হবে সমান ভাবে, ছবি আঁকাও তত ভাল হবে, রংও খুলবে।
আঁকা আয়ত্তে আসার পরে নিজের যাত্রাপথ কী ভাবে তৈরি করলেন প্রজ্ঞাপারমিতা? চামচ, কোস্টার, নুনদানি, ট্রে... দৈনন্দিন হরেক জিনিসে এই মিথিলার আর্টফর্মকে ফুটিয়ে তুলে তাকে দিয়েছেন নান্দনিক মাত্রা। ‘‘ওখানে দেখেছিলাম ছবি ছাড়াও বিছানার চাদরে, শাড়িতে মহিলাদের মধুবনী পেন্টিং করতে। সেখানে আমি আলাদা কিছু না করতে পারলে হারিয়ে যাব। তখন পার্স, ঝোলা ব্যাগ, বটুয়া, পেনস্ট্যান্ড বানিয়ে তাতে মধুবনী আঁকতে শুরু করলাম। ২০১২-তে কলকাতায় ফিরে বিভিন্ন ধরনের ও মাপের ব্যাগে এবং আরও বহু রকম জিনিসে মধুবনী পেন্টিং করলাম।’’ এর সঙ্গে খোলসা করলেন কাঠের উপরে মধুবনী আঁকার টেকনিক। ‘‘কাঠ ঘষে পালিশ তুলে, তাতে অ্যাক্রিলিক রং দিয়ে আঁকি। আঁকার পরে বার্নিশ করতে হয়, যাতে জিনিসটা টেকসই হয়।’’
শুধু দেশি-বিদেশি ক্রেতাই নয়, তিনি পেয়েছেন সম্মানও। নর্থ ক্যারোলাইনা ইউনির্ভাসিটিতে ওবামা-মনমোহন সিং ফাউন্ডেশনের অধীনে একটি প্রজেক্টে উইমেন এমপাওয়ারমেন্ট নিয়ে তিনি কাজ করেছেন। সেই সুবাদে বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে বক্তৃতা দিয়েছেন মধুবনী শিল্প এবং তার মাধ্যমে নারীদের অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা নিয়েও। প্রথাগত ডিগ্রি না থাকা সত্ত্বেও প্রতিভা ও অনুশীলনের জোরে প্রজ্ঞাপারমিতা আজ অনুপ্রেরণা।
ছবি: সর্বজিৎ সেন
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy