পেরেন্টিং বিষয়টাই হল ছোট্ট চারাগাছকে বড় করা।
আপনি কি কখনও সন্তানের উপস্থিতিতেই তার সম্পর্কে অন্যদের সামনে মিথ্যে প্রশংসা করেছেন? হয়তো ছেলে কষ্টেসৃষ্টে ক্লাসে উতরোচ্ছে। তখনও কি ধৈর্য হারিয়ে সকলকে হেসে বলে বেড়াচ্ছেন, ‘‘খোকা আমার জিনিয়াস। এ বার ক্লাসে পাঁচটা সাবজেক্টে হায়েস্ট পেয়েছে।’’ আপনি বুক বাজিয়ে মিথ্যে বলছেন আর খোকা বুঝছে— ক্লাসে ভাল রেজ়াল্ট করার প্রয়োজন কি? বাবা-মা অল্পেই খুশি।
কিংবা আপনার কি মনে হয়, মিথ্যে প্রশংসা যেমন বর্জনীয়, তেমনই ছেলেমেয়েদের সামনে তার ভালটুকুকে গুরুত্ব দিতে নেই? বেশি আদর পেলে তারা বখে যাবে। তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে বকুনি দিয়ে।
আপনি যদি এ ধরনের অভিভাবক না হন, তবে স্বস্তির কথা। কিন্তু নিশ্চয়ই মা-বাবা হিসেবে মনে প্রশ্ন জাগে, সন্তান যদি ব্যর্থ হয়, তবে কী ভাবে সামলাবেন? কী ভাবে চারপাশের প্রশ্নবাণ থেকে আড়ালে রাখবেন তার ব্যর্থতার যন্ত্রণা? আর তার কৃতিত্বে যখন মনে খুশির বান, তখন কি সকলের সামনে সেই আনন্দ জাহির করে ফেলাও ভাল? এতে সন্তানের মধ্যে আত্মগর্বের বোধ তৈরি হবে না তো? যখন একটা চারাগাছ বেড়ে উঠছে, জীবনের আকাশটাকে চিনছে, তখন তাকে কখন রোদ দেবেন, কখন ছায়া— সেই নিয়ে জরুরি পরামর্শ দিলেন বিশেষজ্ঞরা।
মূল্যবোধের শিক্ষাটাই আসল
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ জয়রঞ্জন রাম বললেন, ‘‘বাবা-মা-ই বাচ্চার জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ। তাঁদের চিন্তাভাবনার প্রতিফলন নিয়ে শিশুর মনস্তত্ত্ব গড়ে ওঠে। তাঁদের প্রতিক্রিয়ার ভিত্তিতেই বাচ্চার মানসিক পরিকাঠামো তৈরি হয়। তাঁরা যদি ক্রমাগত বলেন যে, ও তো কিছুই পারে না, তবে বাচ্চা সেটাই আত্মস্থ করে নেবে। ভাববে, আমি কিছু পারি না। পারার চেষ্টাও করবে না। বিশেষত যে কাজ শ্রমসাপেক্ষ সেটা এড়িয়ে যাবে। সেও নিজেকে ‘খারাপ’ই মনে করবে, ভাবতে পারে তা হলে ‘খারাপ’ ছেলেমেয়েরা যা করে সেটাই করি। বিপথে যাওয়ার, কুসঙ্গে পড়ার সম্ভাবনা বাড়বে।
‘‘আবার বাচ্চাকে যদি মিথ্যের আড়ালে ঢেকে রাখা হয়, জনসমক্ষে প্রচার করা হয় যে, ও দারুণ বাচ্চা, সব পারে, তবেও ঝামেলা। ও শিখবে, মানসম্মান রক্ষার জন্য মিথ্যে বলাই যায়। সেটা যে অন্যায় সেই বোধটাই তৈরি হবে না। আবার তার ধারণা হতে পারে, বাবা-মা যখন বলছে, তখন আমি ভালই। বন্ধু বা শিক্ষকশিক্ষিকারাই আমাকে সুনজরে দেখে না, তাই এ রকম বাজে কথা বলে। এতে জগতের প্রতি অবিশ্বাস তৈরি হয়। আত্মীয়, বন্ধু, শিক্ষকের প্রতি ভরসা চলে গেলে মানসিক জটিলতাও সৃষ্টি হবে।’’
বাচ্চাকে বড় হয়ে তথাকথিত ‘সফল’ মানুষ তৈরি করবেন, না কি সৎ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলবেন, আগে সেই সিদ্ধান্তটা নিতে হবে। সেই ধরনের মূল্যবোধ বিকাশে বাচ্চাকে সাহায্য করতে হবে। ডা. রামের পরামর্শ, নিজেদের শৈশব-কৈশোরের সময়টা মনে রাখুন। কেন, কখন আমাদের মন ভাল হত, কখন খারাপ— সেগুলো ফিরে দেখাও জরুরি। যে বন্ধু অঙ্কে ৩৫ পেয়ে কেঁদেছিল, তার তো জীবন সেখানে শেষ হয়ে যায়নি। সেও তো প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছে। এই উদাহরণগুলো মনে রেখে ছোটদের পাশে দাঁড়ান। সে যদি কম নম্বর নিয়ে আসে, তবে তাকে বলতে হবে, পরের বার ভাল করার চেষ্টা করো। ফলাফল যাই হোক, সেই চেষ্টাটুকুকে উৎসাহ দেওয়া ভীষণ জরুরি। চেষ্টা করেও যদি তার নম্বর আশানুরূপ না হয়, তবে তাতে যে লজ্জা নেই, সেটা নিজেকেও বুঝতে হবে আর বাচ্চাকেও বোঝাতে হবে। বাচ্চা হয়তো ভূগোলে ভারতের মানচিত্র আঁকতে পারে না। কিন্তু বন্ধু পেনসিলবক্স আনতে ভুলে গেলে নিজের প্রিয় পেনটা তাকে লিখতে দিয়ে দেয়। তার সেই মূল্যবোধ নিয়েই কিন্তু বাবা-মায়ের স্বপ্ন দেখা উচিত।
কড়া হন, মানবিক থাকুন
ছোট্ট শিশুর কচি মননে কী ভাবে সেই মূল্যবোধের জমি তৈরি করা যাবে? এ বিষয়ে পেরেন্টিং কনসালট্যান্ট পায়েল ঘোষ জানালেন, ‘‘পেরেন্টিং বিষয়টাই হল ছোট্ট চারাগাছকে বড় করা। তার পাশে, তার ‘গাইড’ হিসেবে থাকা। এই পথ দেখাতে গিয়েই অভিভাবকেরা অনেক সময়েই বাচ্চাদের সত্তাকে নিজস্ব সত্তা, অহং বানিয়ে ফেলেন। তখনই সমস্যার সূত্রপাত।
‘‘পেরেন্টিংয়ের চারটে স্তর। অথরিটেরিয়ান, পারমিসিভ, ডিসকানেক্টেড আর অথরিটেটিভ পেরেন্টিং। অনেক বাবা-মা বাচ্চার প্রশংসা করতে জানেন না। তাঁরা ভাবেন ভাল বললে বাচ্চা বিগড়ে যাবে। এটাই অথরিটেরিয়ান পেরেন্টিং। আবার বাচ্চা দুষ্টুমি করলেও অনেকে বলেন, এখন ছোট তো, পরে ঠিক হয়ে যাবে। আমার বাচ্চা ভালই হবে। এটি পারমিসিভ পেরেন্টিং। চোখে পড়ে ডিসকানেক্টেড পেরেন্টিংও। বাবা-মায়েরা নিজেদের নিয়ে, নিজেদের সম্পর্ক রক্ষা করতেই এত ব্যস্ত যে, বাচ্চাদের বিষয়ে তেমন আগ্রহই নেই। স্নেহ বা শাসন কিছুই চোখে পড়ে না।’’
মেনে চলুন অথরিটেটিভ পেরেন্টিং। এই ধরনের অভিভাবকত্বে সহানুভূতি ও দৃঢ়মনের সুন্দর মেলবন্ধন দেখা যায়। চলতি কথায় এটিই পজ়িটিভ পেরেন্টিং। এ ক্ষেত্রে পাঁচটি শর্ত মানতে হবে। প্রথমত, বাচ্চাকে বোঝান, বাবা-মা সব সময়ে নিঃশর্ত ভালবাসা দেবেন। ভাল বা খারাপ পরীক্ষার ফলের সঙ্গে ভালবাসার তারতম্য হবে না। বাচ্চা জানবে বাড়ির পরিবেশ নিরাপদ। সে সাহস করে কাজ করবে, লুকানোর বা মিথ্যা বলার প্রবণতা কমবে। দ্বিতীয়ত, প্রি-স্কুল বয়স থেকে সময়ানুবর্তিতা, পরিবারের নিয়ম শেখান। কেন তা শেখাচ্ছেন সেটাও ব্যাখ্যা করতে হবে। তৃতীয়ত, অভিভাবকের তরফে নেতিবাচক সম্বোধন, অনুৎসাহব্যঞ্জক কথা এবং শারীরিক শাস্তি চলবে না। কর্পোরাল পানিশমেন্ট বা চিৎকার করে অপমান কিন্তু বাচ্চার ব্যবহারে তীব্র পরিবর্তন আনে। যখনই সে শক্তি সঞ্চয় করে তখনই দুম করে ধাক্কা দেয়, বা তার মুখ থেকে ভাল ভাষা বেরোয় না। যতই ছোট হোক, বাচ্চাকেও প্রাপ্য সম্মানটুকু দিতে হবে। এই ধরনের শাস্তি বন্ধ রেখেও শীলিত ভাবে ওদের ভুল সংশোধন করাই যায়। চতুর্থত, চাইলেই দিয়ে দেওয়ার অভ্যেস অবশ্যই শুধরে নিন। বাচ্চা মেনে নিতে শিখবে যে সব কিছু চাইলেই পাওয়া যাবে না। পঞ্চমত, কোন বিষয়ে বাচ্চার প্রতিভা রয়েছে, প্রত্যেক অভিভাবককেই তা খুঁজে বার করার দায়িত্ব নিতে হবে। তার জন্য লেখাপড়ার বাইরে খেলা থেকে চারুকলা বিভিন্ন অ্যাক্টিভিটি-র সঙ্গে ওকে যুক্ত করুন। বাড়িতেও খোলামেলা হাসিখুশির আবহ দরকার। ওর জানা দরকার ভুল করলেও ওর হাতটা ধরে নেওয়ার মানুষ আছেন। এতে ওর মনের জোর বাড়বে, দায়িত্ববোধ আসবে।
পায়েল জোর দিয়ে বললেন, অন্য কারও সঙ্গে তুলনা কেউ-ই পছন্দ করে না। এতে মন ভেঙে যায়। পরিশ্রমের উৎসাহ চলে যায়। বাড়িতে দুটো বাচ্চা থাকলে, বড়টির দিকেও পর্যাপ্ত সময়, নজর দেওয়া দরকার। তুমি বড়, মানিয়ে নিতে শেখো— বলে দিলে চলবে না। তাকেও আগলে রাখা দরকার। তবে তার রাগের প্রকাশ কমবে, সকলের প্রতি মমতা-বোধ তৈরি হবে। এই উপায়গুলি মেনে চললে সন্তানকে নিয়ে যেমন বিশেষ সমস্যার সৃষ্টি হবে না, তেমনই বৃহত্তর সমাজে বাচ্চার কারণে অস্বস্তিতে পড়ার সম্ভাবনা কমবে।
এখন ছোটরা অনেকটা সময় বাড়িতেই কাটাচ্ছে। ওদের ব্যর্থতা ঢাকা দেবেন না। আবার বারবার ‘বুরুন তুমি অঙ্কে তেরো’ বলে ওর জীবনটা কঠিন করে দেবেন না। বরং ওর জোরের জায়গাটা নিয়েও একটু আলোচনা করুন, আর তার পর পাশে বসে বলুন, ‘বুরুন, তুমিও অঙ্ক পারো!’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy