পাঁজরের হাড় ভেঙে গেলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অপারেশনের কিংবা প্লাস্টার করার দরকার হয় না। প্রতীকী ছবি।
বুকে ব্যথা মানেই সব সময়ে হৃৎপিণ্ড বা ফুসফুসের সমস্যা নয়। পাঁজরের পেশিতে ব্যথার কারণেও বুকের এক দিকে বা দু’দিকেই ব্যথা হতে পারে। মেরদণ্ডের অস্থি বা ভার্টিব্রা থেকে শুরু হয়ে বক্ষাস্থি বা স্টারনামের সঙ্গে যে তরুণাস্থি জোড়া থাকে, তাকে বুকের পাঁজর বলে। শেষ দু’জোড়া ছাড়া, বাকি সবক’টি পাঁজরই তরুণাস্থি দ্বারা বক্ষাস্থির সঙ্গে যুক্ত থাকে। যে-কোনও প্রদাহের ক্ষেত্রেই চার ধরনের উপসর্গ থাকে – লালচে ভাব, ফোলা ভাব, ব্যথা ও অত্যাধিক তাপমান। এর মধ্যে তৃতীয় উপসর্গটিই বেশি অনুভব করি। জোরে শ্বাস নিতে গেলে বা কাশি, হাঁপানি হলে বা শরীরের উপরিভাগের নড়াচড়াতে এমন ব্যথা হলে তা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে হৃৎপিণ্ড বা ফুসফুসের সমস্যা নয়, জানালেন জেনারেল ফিজিশিয়ান ডা. সুবীর মণ্ডল।
পাঁজরের ব্যথার কারণ
শরীরের যে কোনও ব্যথার তিন ধরনের উৎস হয় – স্নায়ু বা নার্ভ, হাড় বা বোন এবং পেশি বা মাসল। সাধারণত ব্যথার অনুভূতি স্নায়ু বহন করলেও বেশির ভাগ সময়েই ক্ষতিগ্রস্ত হয় হাড় বা পেশি। তবে ডায়াবেটিক রোগীদের ক্ষেত্রে নিউরোপ্যাথিক পেনও হয়। তাঁদের ক্ষেত্রে স্নায়ু ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। পাঁজরের ব্যথার ক্ষেত্রেও হাড়, স্নায়ু কিংবা পেশি যেকোনও একটি বা একাধিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
হাড়ে ব্যথা হয় দু’টি কারণে। কোনও আঘাত বা চোট লাগলে এবং অস্টিয়োপোরেসিসে ভুগলে। বুকে চোট বা আঘাত পেলে পাঁজরের হাড় ভেঙে যেতে পারে। মাত্রাতিরিক্ত শারীরচর্চা করলে কিংবা বহুদিন ধরে কাশিতে ভুগলেও পাঁজরের হাড় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবে দ্বিতীয় কারণটি বেশি চিন্তার। অস্টিয়োপোরেসিস এমন এক রোগ যেখানে হাড় দুর্বল হয়ে ভাঙার ঝুঁকি বেড়ে যায়। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এ ধরনের সমস্যা বেশি হলেও অনেকাংশে সমস্যাটি বংশগত হয়ে থাকে। এই রোগে হাড়ের ঘনত্ব কম হয়। ফলে হালকা চোটেই হাড় ভেঙে যায়। পাঁজরের হাড় অস্টিয়োপোরেসিসের কারণে ভেঙে গেলে বুকে ব্যথা অনুভব হয়। শরীরে প্যারাথাইরয়েড হরমোন ও ভিটামিন ডি-র অভাবজনিত কারণে ও বিভিন্ন কেমিক্যাল কম্পোনেন্টের ভারসাম্যহীনতার কারণে যেমন ক্যালশিয়াম বা ফসফেট ইত্যাদি কমে গেলে অস্টিয়োপোরেসিস ত্বরান্বিত হয় এবং এর ফলে পাঁজরের জয়েন্টে ব্যথা হতে পারে।
অন্যান্য কারণ
কসটোকনড্রাইটিসের কারণেও বুকের পাঁজরে ব্যথা হয়। ভার্টিব্রা থেকে স্টারনামের সঙ্গে যে তরুণাস্থি জোড়া থাকে, তার প্রদাহকে বলে কসটোকনড্রাইটিস। সেখানে অবস্থিত কোমলাস্থির প্রদাহের কারণে ব্যথা হলে তাকে পলিকন্ড্রাইটিস বলা হয়। এ ছাড়া রিউমাটয়েড অর্থাৎ বুকের পাঁজরের হাড়ে বা গাঁটে ফোলা ভাবের কারণেও অনেক সময়েই জোরে শ্বাস নিতে গেলে কিংবা কাশি হলে বুকে ব্যথা হয়। পাশাপাশি ফাইব্রোমায়ালজিয়ার কারণে বা পেশি কোনও ভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হলেও পাঁজরে ব্যথা হয়।
রোগের চিকিৎসা
ডা. সুবীর মণ্ডলের কথায়, “উপসর্গ থেকেই অনেকাংশে ব্যথার কারণ অনুমান করা যেতে পারে। যেমন ফাইব্রোমায়ালজিয়ার ব্যথা সঞ্চরণশীল। কসটোকনড্রাইটিস থাকলে বুকের দেওয়ালে চাপ দিলে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভূত হয়। তবে বুকে ব্যথা হলে প্রাথমিক ভাবেই প্রয়োজন রোগীর ইসিজি করানো। হৃৎপিণ্ডের ব্যথাকে পাঁজরের বা গ্যাস্ট্রাইটিসের ব্যথা বলে বসে থাকলে চলবে না। ইসিজি রিপোর্ট ঠিক থাকলে এক্সরে করে দেখতে হবে পাঁজরের হাড়ে চোট লেগেছে কিনা। ভার্টিব্রাল কলাম বেঁকে থাকলে বা স্পাইন ডিফরমেটিভের কারণে পাঁজরে ব্যথা কিনা জানতে পাশাপাশি এক্সরের সঙ্গে সামনেরও একটি এক্সরে করা প্রয়োজন। সঙ্গে ব্যথা ও প্রদাহরোধী ওষুধ দেওয়া হয় রোগীকে। দীর্ঘকালীন কাশির সমস্যা কিংবা ব্রঙ্কাইটিস থাকলে তা নিরাময়ের জন্যও ওষুধ দেওয়া হয়। রোগী যদি ডায়াবেটিক হয় তবে তাঁর রক্তে গ্লুকোজ়ের পরিমাণকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করা হয়।
ভার্টিব্রাল কলাম কিংবা তার পিছনের রিবস যে-কোনওটাই ফ্র্যাকচার হতে পারে। ডা. মণ্ডল বলেন, “এ ক্ষেত্রে চিকিৎসককে বেশি সতর্ক হতে হবে। বোন টিউবারকিউলোসিস বা মাল্টিপল মাইলোমা ধরনের বোন ক্যান্সারের সম্ভাবনা থাকতে পারে।” কেবল পাঁজরের হাড়ে ফ্র্যাকচার হলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অপারেশনের কিংবা অন্যান্য হাড়ের মতো প্লাস্টার করার দরকার হয় না। সে সময়ে কিছু দিনের জন্য ফুসফুসের অতিরিক্ত ব্যবহার, জোরে শ্বাসপ্রশ্বাস নেওয়া ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ করলে ও ক্যালশিয়াম বা ভিটামিন ডি সাপ্লিমেন্ট নিলেই হয়।
পাশাপাশি হাড়ের ঘনত্ব কতটা ও তাতে কোনও সমস্যা রয়েছে কিনা জানার জন্য বোন মিনারেল ডেনসিটি টেস্ট করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে ডুয়াল এনার্জি এক্স-রে করা হয়। একইসঙ্গে পাঁজর বা ফুসফুসে কোনও সমস্যা রয়েছে কিনা তা নির্ধারণের জন্য চেস্ট সিটি স্ক্যান বা এমআরআই করা হয়ে থাকে।
পাঁজরের ব্যথায় চিকিৎসকেরা সি-রিঅ্যাক্টিভ প্রোটিন, আরএ ফ্যাক্টর, ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রাও পরীক্ষা করিয়ে থাকেন। এর মাধ্যমে শরীরে ভিটামিন ডি, ভিটামিন বি১২, ক্যালশিয়াম ইত্যাদির ভারসাম্যে কতটা ঘাটতি রয়েছে তা নির্ধারণ করা সম্ভব। তবে ডা. মণ্ডলের কথায়, “খেয়াল রাখতে হবে দোকান থেকে ক্যালশিয়াম কিনে খাওয়ার প্রবণতা খারাপ। শরীরে যেসমস্ত কম্পোনেন্ট কম থাকবে তা ডাক্তারের পরামর্শ নিয়েই খেতে হবে। চিকিৎসার সময়ে হাড়ে ক্যালশিয়ামের মাত্রা কী ভাবে বাড়ানো যায় সে খেয়াল রাখাও জরুরি।”
মনে রাখা প্রয়োজন
ক্যালশিয়াম হাড়ের পক্ষে ভাল, তবে হার্টের পক্ষে খারাপ। মাত্রাতিরিক্ত ক্যালশিয়াম হার্টের ভেসলকে ব্লক করে দিতে পারে। চিকিৎসকের পরামর্শ মতো হালকা স্ট্রেচিং এক্সারসাইজও করতে পারেন। অনেক সময়েই চিকিৎসকরা ফিজিয়োথেরাপির পরামর্শও দিয়ে থাকেন।
পাঁজরের ব্যথার থেকে সাময়িক আরাম পেতে বাড়িতেই ঠান্ডা-গরম সেঁক দিতে পারেন। তবে গরম সেঁক দেওয়ার আগে দেখে নিতে হবে রোগীর যেন নিউরোপ্যাথি না থাকে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy