পুরনো অ্যাংলো পাড়া ছেড়ে বড়দিনের কেক এখন বাঙালির নতুন শিল্প। ছবি- সংগৃহীত
পুজো আর প্রসাদ দু’টিই উৎসবপ্রিয় বাঙালির কাছে অতি গুরুত্বপূর্ণ। তাই বিবিধের মাঝে পড়ে কী ভাবে যেন পৌষ-পার্বণের সঙ্গে বড়দিনও এখানকার উৎসবে পরিণত হয়েছে। উত্তুরে হাওয়ায় বড়দিনের সকালে চড়ুইভাতি না হলেও এক টুকরো কেক কিন্তু চাই-ই চাই বাঙালির। হিন্দুদের পুজোর ভোগের মতোই খ্রিস্টানদের কাছে ‘কেক’ প্রসাদের মতো। ঠিক যতটা যত্ন নিয়ে পুজোর ভোগ রান্না করা হয়, ততটাই যত্ন নিয়ে বাড়িতে কেক তৈরির চল রয়েছে নানা জায়গার খ্রিস্টানদের মধ্যে।
কলকাতায় কেক বলতে যে জায়গাটির কথা প্রথম মাথায় আসে, তা হল নিউ মার্কেট চত্বর। ডিসেম্বরের হালকা রোদ গায়ে মেখে পুরনো এই পাড়ার আশপাশ দিয়ে গেলে এখানকার উপচে পড়া ভিড় আর কেকের সুবাস জানান দেয়, বড়দিন আসতে আর বেশি দিন বাকি নেই। তবে এখন আর শুধু নিউ মার্কেট নয়, বো ব্যারাক, নানা পাড়ায় পাওয়া যায় রকমারি কেক। আগে পুরনো কলকাতার অ্যাংলো পাড়ায় ছোট ছোট বহু বেকারি ছিল, যেখানে ক্রেতারা তাঁদের পছন্দ অনুযায়ী কেক তৈরির সরঞ্জাম কিনে দিলে বিক্রেতারা কেক বানিয়ে দিতেন। এখন তেমন ভাবে কেক বানানোর চল কমেছে হয়তো, তবে আছে অন্য একটি মজা। নিজের পছন্দ মতো কেকের বরাত দেওয়া যায় বিভিন্ন হোম বেকারের কাছে। তাঁরা ক্রেতার প্রয়োজনের কথা জেনে নিয়ে সেই মতো কেক বানিয়ে দিব্যি পাঠিয়ে দেন নির্দিষ্ট ঠিকানায়।
মানুষের চাহিদা অনুযায়ী কেক তৈরি করতে করতে গত দু’বছরে যে কত রকমের কেক বানিয়েছেন, তা মনে করতেই অসুবিধা হচ্ছিল হোমবেকার মৌমিতা গুপ্তর। বছর দুয়েক আগে থেকেই পেশাদার কেক-শিল্পী হিসাবে কাজ করছেন তিনি। বাবার জন্মদিনে নিজে হাতে কেক তৈরি করে অসংখ্য মানুষের প্রশংসা কুড়িয়েছিলেন। সেই থেকে শুরু। আর পিছন ফিরে থাকাতে হয়নি মৌমিতাকে। সাধারণ কেকের পাশাপাশি মৌমিতার বিশেষত্ব হল প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের মেলবন্ধন করা। মৌমিতা বলেন, “হঠাৎই এক দিন মাথায় এল গুড় দিয়ে যদি কিছু করা যায়। শীতের সময়ে পিঠে, পুলি তো মানুষ খেতেই থাকেন। কিন্তু গুড় দিয়ে কেক তৈরি করলে বিষয়টা কি খুব খারাপ হবে?” এই শীতে মৌমিতার কাছে ক্রেতারা মাসখানেক আগে থেকেই নলেন গুড়ের লোফ কেক, নলেন গুড়ের জার কেক, কাপ কেক, পিঠে পেস্ট্রি, নলেনগুরুর বরাত দিয়ে রেখেছেন। ‘কেকেশ্বরী’ নামে অনলাইনে মৌমিতার একটি পেজ রয়েছে। সেখান থেকেই ব্যবসায়িক লেনদেন করেন তিনি।
শুধু ব্যবসা নয়, কেক-শিল্পের মাধ্যমে সমাজের বিশেষ একটি স্তরের মানুষদের মূল স্রোতে ফেরানোর নিরন্তর প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে ‘শুকতারা কেকস’। একেবারে নিজস্ব উদ্যোগে তৈরি এই ‘শুকতারা’ এক সময়ে শুধুই মানসিক এবং শারীরিক ভাবে প্রতিবন্ধীদের আশ্রয়ের জায়গা ছিল। কিন্তু ২০১৩ থেকে সোমনাথ সর্দারের উদ্যোগে শুকতারার বিশেষ ভাবে সক্ষম ছেলেদের নিয়েই গড়ে উঠেছে এই বেকারি। সোমনাথবাবু বলেন, “কলকাতায় বসে ফরাসি ম্যাডেলাইন, ফিনান্সিয়ার স্বাদ পেতে চাইলে এক বার শুকতারা বেকারির দারস্থ হতেই হবে।”
এ ছাড়াও পাওয়া যাবে মুসাম্বি এবং পোস্ত দেওয়া ফ্রুট কেক। জিঞ্জার, সিনামন এবং ওয়ালটনাট কেক। ৫০০ গ্রাম থেকে ১ কেজি পর্যন্ত কেক দাম ৩৫০ থেকে ৬০০ টাকার মধ্যে। ফিনান্সিয়া এবং ম্যাডেলাইনের এক বক্সের দাম ৬০০ টাকার আশপাশে। বড়দিনে শুকতারা বেকারির কেক খেতে চাইলে দু’দিন আগে অর্ডার দিতে হবে। অনলাইনে শুকতারা কেকস দিয়ে খুঁজে দেখলেই হবে।
পাউরুটির জগতে বিখ্যাত নাম মডার্ন ব্রেড। বাঙালির হেঁশেলে রোজের জল খাবারে যে দিন থেকে পাউরুটি ঢুকেছে, প্রায় সেই সময় থেকেই ‘মডার্ন’-এর নাম লোকের মুখে মুখে ঘোরে। কিন্তু কেকের চাহিদার কথা মাথায় রেখে এই সময়ে কেক তৈরি করছে তারাও। বিভিন্ন দামের ফ্রুট কেক থেকে শুরু করে প্লাম কেক, সবই তৈরি করেন তারা। তারাতলার কাছে অবস্থিত বহুদিনের পুরনো এই পাউরুটি কারখানার আধিকারিক চন্দন দত্ত বলেন, “সারা বছর পাউরুটির চাহিদা থাকলেও এই সময়ে কেকের একটা আলাদা জনপ্রিয়তা থাকে। সকলে তো দামি ব্র্যান্ডের কেক কিনতে পারেন না। তাই সাধারণ মানুষের কথা মাথায় রেখে তুলনামূলক কম দামে কেক তৈরি করা হয়।” তাই রোজ সকালে পাড়ার দোকানে পাউরুটি কিনতে যাওয়া মধ্যবিত্ত বাঙালি বড়দিনের সকালে ‘মডার্ন’-এর কেক খেতেই পারেন।
কিছু দিন আগে পর্যন্ত ‘বুটিক’-এর নাম শুনলে কলকাতার মানুষ কিন্তু পোশাকের কথাই ভাবতেন। তবে এখন অনেকে কেকের বুটিকের সঙ্গেও পরিচিত। তেমনই একটি বুটিক হল ‘ক্রেজি ফর কেকস’। ধরা যাক আপনি এমন কারও জন্মদিনে কেক উপহার দেবেন, যিনি পেশায় চিকিৎসক। তার জন্য চিনির বিশেষ মণ্ড দিয়ে চিকিৎসার সরঞ্জাম ক্ষুদ্র সংস্করণ বা ফন্ড্যান্ট বানিয়ে কেক সাজান হয়। ‘ক্রেজি ফর কেকস’-এর উল্টোডাঙ্গা শাখার কর্মী ববিতা সর্দার বলেন, “আমাদের এখানে সধারণত থিম বেসড কেক তৈরি হয়। তবে, বড়দিন উপলক্ষে রিচ ফ্রুট কেক এবং প্লাম কেকও তৈরি করা হয়েছে।”
কেকের অন্যতম উপকরণ হল ডিম। এ দিকে, কেক খেতে ভালবাসলেও ডিমের জন্য কেককে ব্রাত্য করে রাখেন অনেকেই। তাই নিরামিষ ভোজীদের কথা মাথায় রেখে অনেকেই আবার ডিম ছাড়া কেকও তৈরি করছেন। মুখে দিলে বোঝার একেবারেই কোনও উপায় নেই যে এই কেক অন্য আর পাঁচটি কেকের থেকে আলাদা। আবার ইংরেজি সংস্কৃতির কেক এবং বাংলার গুড় মিলেমিশে এক হয়ে গিয়েছে শহরের এক বিখ্যাত মিষ্টি বিপণি বলরাম মল্লিক এবং রাধারমন মল্লিকের হাত ধরে। অন্যান্য বারের মতোই মিষ্টির পাশাপাশি তাঁরা বড়দিন উপলক্ষে নিয়ে এসেছেন নলেন গুড়ের ফ্রুট কেক এবং গুড়ের মেরিলিন। বলরাম মল্লিকের পক্ষ থেকে সুদীপ মল্লিক বলেন, “মিষ্টির পাশাপাশি বাঙালি কেক খেতেও ভালবাসেন। তাই এই সময়ে তাঁদের কথা মাথায় রেখেই কেক তৈরি করা। বিশেষ করে যাঁরা ডিম খান না, তাঁদের কথা মাথায় রেখেই আমরা একেবারে ডিম ছাড়া কেক তৈরি করি। এ ছাড়াও ‘ফিউশন’ আমাদের অন্যতম একটি ধারা। মিষ্টির ক্ষেত্রেও যেমন মেলবন্ধন করি, তেমন কেকের সঙ্গেও গুড় মিশিয়ে নতুন একটি ধারা তৈরির চেষ্টা করেছি আমরা।”
করোনা অতিমারির সময়ে বাড়ি থেকে অনলাইনে কেক তৈরির প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন লেক টাউনের বাসিন্দা সুদেষ্ণা দত্ত মুখোপাধ্যায়। পেশাদার কেকশিল্পী হওয়ার স্বপ্ন দেখেই কেক তৈরি শুরু করেছিলেন তিনি। প্রথম দিকে বন্ধুবান্ধবদের, পরিচিতদের কেক তৈরি করে খাওয়াতেন। পরে দু’-একটি অর্ডারও আসতে শুরু করে। কিন্তু কেকের চাহিদা এখন এমন জায়গায় পৌঁছে গিয়েছে যে, আগে থেকে অনলাইনে বা ফোনে অর্ডার না দিলে ডেলিভারি করাই মুশকিল হয়। সুদেষ্ণা বলেন, “জন্মদিন, বিয়ে বা বিবাহবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে ক্রেতাদের পছন্দ অনুযায়ী কেক তৈরি করতাম। কিন্তু এখন তো বড়দিনের জন্য অনেকেই কেক চাইছেন। তাই তাঁদের চাহিদা মতো রিচ ফ্রুট কেক, চকোলেট ওয়ালনাট কেক তৈরি করছি। তবে দোকানের মতো আগে থেকে কেক বানিয়ে রাখা থাকে না বলে অন্তত দু’দিন আগে অর্ডার দিতে হয়।”
বড়দিনের মাসখানেক আগে থেকেই নিউ মার্কেট চত্বরে যা ভিড় হয়, সে সব দেখে ভয়ে কেক খাওয়াই মাথায় উঠেছে? চিন্তা নেই। কারণ, ‘দূরে কোথাও যাবেন কেন, বাড়ির কাছে পাড়ার মোড়ে’-ই রয়েছে ‘মিও আমোরে’। সারা বছর নানা রকমের কেক থাকলেও এই সময়ে ডান্ডি কেক, প্লাম কেক, ওয়ালনাট কেক, রিচ ফ্রুট কেকের সমাহার নিয়ে সেজে উঠেছে প্রতিটি শাখা। “অন্য সময়ে যে পরিমাণ কেক তৈরি হয়, তার চেয়ে প্রায় চার গুণ বেশি কেক তৈরি হয় বড়দিনে। গত দু’বছর সব দিক থেকেই মন্দা ছিল। তবে এ বছর আবার ধীরে ধীরে সবটা স্বাভাবিক হচ্ছে,” বললেন সন্তোষপুরের এক বিপণির কর্মী নীলিমা যাদব। বিভিন্ন স্তরের ক্রেতাদের, বিভিন্ন রুচির কথা মাথায় রেখে ২৫০ থেকে ৮০০ টাকা পর্যন্ত কেক রয়েছে ‘মিও আমেরে’-তে। অনেকে আবার ফ্রুটকেক পছন্দ করেন না, তাঁদের জন্য সাধারণ রিচ বাটার ভ্যানিলা কেকও রয়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy