সদ্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে নামী তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থায় ভাল মাইনের চাকরিতে যোগ দিয়েছেন রাজর্ষি। কিন্তু কাজ শুরুর কয়েকটা দিন পরেই মনে হল, তাল কাটছে। নতুন পরিবেশে মানিয়ে নিতে পারছেন না। কখন কাজ শুরু আর শেষ, সেটাই যেন গুলিয়ে যাচ্ছে! রাজর্ষির বন্ধু বিশাখারও নতুন চাকরি। তাঁর সমস্যাটা অন্য। মাসের মাঝামাঝি হাতে বিশেষ টাকা থাকছে না। বাড়িতে টাকা চাইতেও কেমন যেন অপ্রস্তুত। আবার বাড়ির কাজ সামলাতে গিয়ে অফিসের কাজটা ঠিক মতো হচ্ছে কি, মাথায় ঘুরছে এমন ভাবনাও। অচেনা সহকর্মীদের ভিড়ে কাকে বলবে এ সব কথা।
কর্পোরেট জগতের চাকরিতে যোগ দেওয়া ঋদ্ধি যেন কর্মক্ষেত্রে কথা বলার লোক খুঁজছেন। তাঁরই সঙ্গে চাকরিতে যোগ দিয়েছেন সৌম্য। তিনি আবার ভাবছেন, চাকরির প্রথম দিন থেকেই অস্বাভাবিক চাপ দেওয়া হচ্ছে। সামান্য কোনও ভুলে নানা ভাবে কটু কথা শোনানো হচ্ছে। অথচ, সৌম্য যে চেষ্টা করছেন বা নতুন কিছু ভাবছেন, তা যেন কেউ দেখছেন না।
অনেককেই আবার কাজের সূত্রে বাড়ি, নিজের শহর ছাড়তে হয়। তাঁদের ক্ষেত্রে বাড়ির বয়স্ক বাবা-মা আর নতুন অফিস, এই দুইয়ের মধ্যে ভারসাম্য রাখাটা বেশ কঠিন হয়ে পড়ে। আবার, কোভিড-পরবর্তী বিশ্বে ওয়ার্ক ফ্রম হোম-এর মাধ্যমে যাঁরা নিজেদের কর্মজীবন শুরু করছেন, তাঁদের বুঝতে সমস্যা হয়, বাড়িতে থাকা আর বাড়িতে থেকে কাজ করা, এই দু’টির মধ্যে গুরুতর ফারাক আছে।
বোঝাই যাচ্ছে, সমস্যাগুলো প্রথম চাকরিতে ঢুকেছেন যাঁরা, তাঁদের। এমন নানা সমস্যার সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের হেনস্থাও রয়েছে। কিন্তু কাজের জগতে নতুন হওয়ায় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে কী ভাবে এ সব সমস্যা নিয়ে কথা বলবেন নবাগতেরা বা সে সব বললে চাকরিতে কোনও প্রভাব পড়বে কি না, এ সব সাতপাঁচ ভেবে খেই হারিয়ে ফেলেন অনেকেই। অনেকে ভাবেন, ‘আমার দ্বারা হবে না।’ এমন চিন্তা থেকে চাকরি ছেড়ে দেওয়ার প্রবণতাও দেখা যায় বহু ক্ষেত্রে।
কেন সমস্যা
বিষয়টি বোঝানোর চেষ্টা করলেন ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট শ্রীতমা চট্টোপাধ্যায়। তাঁর মতে, স্কুল-কলেজে থাকাকালীন আমরা অভিভাবক ও শিক্ষকদের ছত্রছায়ায় থাকি, যা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই একটি সুরক্ষিত বৃত্ত। তাই ভুলভ্রান্তি হলে তা ধরিয়ে দেওয়ার লোকজন থাকেন। ভুল কোনও পদক্ষেপের কথা কাছের বন্ধুরা জানতে পারলে সাবধান করেন। কিন্তু কর্মজীবনে ঢুকলে নিজেকেই নিজের কাজের দায়িত্ব নিতে হয়। অর্থাৎ এক ধাক্কায় যেন খানিকটা বড় হয়ে যাওয়া। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যান্টিনের চেনা চৌহদ্দি ছেড়ে চাকরির কঠিন বাজারে নিজেকে প্রমাণ করার লড়াইতেও নামতে হয়। সব মিলিয়ে প্রথম দিকে বিষয়টা বিভ্রান্তিকর ঠেকতেই পারে।
জরুরি সচেতনতা
তবে কথায় আছে, সমস্যা থাকলে, সমাধানও আছে। পথ বাতলাচ্ছেন মনোবিদ জয়রঞ্জন রাম। তিনি জানাচ্ছেন,
কোনও বিষয় নিয়ে আমাদের পড়াশোনা থাকলেও, চাকরিতে না ঢোকা অবধি তার প্রয়োগ অর্থাৎ হাতে-কলমে দক্ষতা কতটা, তা বোঝা যায় না। ফলে, নিজের কর্মদক্ষতা নিয়ে অনেকেই অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস অথবা হীনম্মন্যতায় ভুগতে পারেন। পরিচিত কেউ যদি আগে থেকে একই ক্ষেত্রে কাজ করে থাকেন, তবে নবাগতেরা তাঁর পরামর্শ নিলে উপকৃত হবেন।
প্রতিটি চাকরিরই একটা ‘জব রোল অ্যান্ড রেসপনসিবিলিটি’ থাকে। চাকরি শুরুর আগে সংশ্লিষ্ট সংস্থা ও সেখানে নিজের নির্দিষ্ট ভূমিকা কী হতে পারে, সে বিষয়ে কিছুটা আন্দাজ থাকলে বা সচেতন থাকলে ভাল।
কর্মস্থলে সহকর্মীদের মধ্যে প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব থাকবেই। কিন্তু এর মাঝে ভাল বন্ধুত্বের সম্পর্কও তৈরি হয়। ‘কাউকে সাহায্য করব না’, এই ভাবনাটা একেবারে ভুল।
দিনের একটা গুরুত্বপূর্ণ সময় যাঁদের সঙ্গে কাটাতে হচ্ছে, সেই সহকর্মীদের সঙ্গে ব্যক্তিগত জীবনের কথা ভাগ করে নেওয়া হবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু কর্মস্থলে কখন কতটা কথা বলব, সেই পরিমিতিবোধটা জরুরি। বিশেষ করে কর্মক্ষেত্রে নতুন হলে, তা প্রথম থেকেই বিবেচনা করা ভাল।
ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট শ্রীতমা চট্টোপাধ্যায়ের মতে, নিজের ক্ষমতা অনুযায়ী বোঝা উচিত কতটা কাজ করা সম্ভব। কোনও কিছু না জানা বা না করতে পারাটা অপরাধ নয়। এ ক্ষেত্রে ‘না’ বলাটাও ভীষণ জরুরি।
যদি কোনও সময় মনে হয়, কর্মস্থলে কোনও ধরনের হেনস্থার শিকার হতে হচ্ছে, তবে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে তা জানানোর ক্ষেত্রে দ্বিধা করা চলবে না। প্রয়োজনে আইনি সাহায্যে বিচার মিলবে, এই বিশ্বাস রাখাটাও জরুরি।
প্রথম মাইনে পাওয়া থেকেই সঞ্চয়ে নজর দিতে হবে। আপৎকালীন পরিস্থিতিতে এটি খুবই কাজে দেয়।
বাড়ি থেকে হোক বা অফিস গিয়ে, কাজের জগৎ আর ব্যক্তিগত সময় ও পরিসর আলাদা রাখাটা জরুরি।
সর্বোপরি বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, প্রথম কর্মক্ষেত্রে নিজের কাজ বোঝা ও পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে না পেরে চাকরি ছাড়ার ভাবনাকে প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না। বিশ্বাস রাখতে হবে, নিজের যোগ্যতায় চাকরিটা পাওয়া আর সেটা নিজের যোগ্যতাতেই ভাল ভাবে করা সম্ভব। আর যদি একান্তই চাকরি ছাড়ার পরিকল্পনা করতে হয়, তবে তার আগে বিকল্পটি তৈরি রাখতে হবে। পাশাপাশি, কোনও নেতিবাচক চিন্তা মাথায় আসার আগে চাকরিক্ষেত্রে নবাগতেরা যেন মাথায় রাখে , ‘বিশ্বাস করো তুমি পারবে এবং তুমি তোমার যাত্রাপথের অর্ধেক পথ হেঁটে ফেলেছ!’ (থিওডোর রুজ়ভেল্ট)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy