গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ। গ্রাফিক সহায়তা: এআই
কালী কিন্তু আন্তর্জাতিকও!
নিউ ইয়র্কের এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং। ১০২ তলার সেই আকাশচুম্বী বহুতল শহরের প্রাণকেন্দ্র ম্যানহ্যাটনের গর্ব। প্রতি দিন হাজার হাজার মানুষ শুধু দেখতে যান সেই বাড়ির ছাদ থেকে কেমন দেখায় শহরটাকে। হঠাৎ এক দিন সেই বহুতল চমকে দিল। গোটা বাড়ি জুড়ে দেখা গেল কালীর ছবি। কেউ চেনেন, কেউ বা চেনেন না সেই ‘হিন্দু গডেস’-কে। আলোয় করা ইনস্টলেশন। শহরের চোখ ধাঁধিয়ে পৌঁছে গেল দেশ-বিদেশের সংবাদ শিরোনামে।
২০১৫ সালের অগস্ট মাসের ঘটনা। আলোকচিত্রী অ্যান্ড্রয়েড জোনসের শিল্প। এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিংয়ে সে দিন ছিল বন্যপ্রাণ সংরক্ষণের আবেদনে সচেতনতামূলক বার্তা দেওয়ার পালা। শিল্পের মাধ্যমে। আলোকচিত্রী সেখানেই বেছে নিয়েছিলেন হিন্দু দেবী কালীর ছবি। ১২৫০ ফুট উঁচু বাড়িটির গা জুড়ে যে ছবি ছিল, তার মাধ্যমে শিল্পী বলতে চেয়েছিলেন, কালীর মতো ভয়ঙ্করী কোনও দেবীকেই যেন এ সময়ে প্রয়োজন গোটা বিশ্বকে ধ্বংসের থেকে রক্ষা করার জন্য।
বেশ কয়েক বছর হল নানা ভাবে পশ্চিমে, বিশেষ করে আমেরিকায় বৌদ্ধিক চর্চা ও জনপ্রিয় শিল্পের অঙ্গনে বার বার ঘুরে-ফিরে এসেছে কালী-ভাবনা। নারীবাদ নিয়ে লেখাপড়ায় বহু স্তরে এসেছে কালীর প্রসঙ্গ। বিশ শতকের মাঝের দিক থেকেই পশ্চিমে নারীবাদ নিয়ে চর্চায় কালী হয়ে উঠেছেন নারীশক্তির প্রতীক। এ দেশে হয়েছেন তার আগেই। তবে এ ক্ষেত্রে পশ্চিমের কথা আলাদা করে উল্লেখ করার কারণ আছে।
পশ্চিমে কালী ও শক্তিসাধনাকে প্রথম পরিচিত করান স্যর জন উড্রফ নামে এক ইংরেজ আইনজীবী তথা অধ্যাপক। তাঁর বাবা জেমস উড্রফ ছিলেন বাংলার অ্যাডভোকেট জেনারেল । জনের জন্ম ১৮৬৫ সালে কলকাতা শহরেই। যৌবনেই জন শাক্তধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হন এবং সংস্কৃত ভাষা আয়ত্ত করে তন্ত্রের বিভিন্ন গ্রন্থ ‘আর্থার অ্যাভালন’ ছদ্মনামে অনুবাদ করতে শুরু করেন। তাঁর অনূদিত গ্রন্থগুলির মধ্যে ‘মহানির্বাণ তন্ত্র’ অন্যতম। পরে তন্ত্রের বিবিধ বিষয় নিয়ে তিনি বেশ কিছু বই লেখেন। ‘হিমস টু দ্য গডেস’ এবং ‘দ্য গারল্যান্ড অফ লেটার্স’ গ্রন্থে বিস্তারিত ভাবে ব্যাখ্যা করেন কালীতত্ত্ব। উড্রফের কাজ আজও পশ্চিমে আদৃত। তবে এই চর্চা একান্ত ভাবেই পশ্চিমের অ্যাকাডেমিক ও আগ্রহী মহলেই সীমাবদ্ধ। ১৯৬০-এর দশকের হিপি ও বিটনিক আন্দোলনের সময়ে কালীকে নিয়ে পশ্চিমি যুবক সম্প্রদায়ের আগ্রহ বৃদ্ধি পায়। সেই আন্দোলন স্তিমিত হলে আবার এই আগ্রহেও ভাটা পড়ে।
সাম্প্রতিক সময়ে অনেকের মত, ভারত তথা বাংলায় কালী আসলে যেমন, তেমনটা বুঝতে পারে না বিদেশ। তাই তো ২০০৮ সালে আমেরিকার মডেল হাইডি ক্লাম হ্যালোউইন পার্টিতে কালী সেজে যাওয়ায় হইহই পড়ে যায়। কেউ বলেন, কালী আসলে কে, তা তো আর আমেরিকার লোকে বোঝেন না, কেউ বলেন, কালী তো রাগী, প্রতিবাদের প্রতীক, ঠিকই তো আছে! এর পরে সেই তর্ক আরও দূর গড়ায় যখন ২০১৭ সালে নিজের মনের অবস্থা বোঝাতে গিয়ে আমেরিকার গায়িকা ক্যাটি পেরি হঠাৎ ইনস্টাগ্রামে কালীর ছবি দিয়ে বসেন। ছবির নীচে লেখেন, ‘‘এখনকার মেজাজ’’। বোঝান, তিনি তখন কালীর মতো মেজাজেই আছেন। অর্থাৎ, কোনও ভাবে যেন ক্রোধ সঞ্চারিত হছে তাঁর মনে। ক্যাটির এ দেশি ভক্তকুল তা দেখে বেশ খানিকটা খাপ্পা। নেটমাধ্যমে বুঝিয়ে দেন, এ সব তাঁরা মোটেই মেনে নেবেন না। কালী হলেন দেবী। তিনি কি নিছক ‘ক্রোধ’-এর প্রতীক নাকি! আমেরিকার কবি অ্যানি ফিঞ্চের এ প্রসঙ্গে একটি বক্তব্য আছে। তিনি মনে করেন, ‘‘পশ্চিমে এখন সে ভাবে কোনও দেবীর আরাধনা হয় না। যত হিন্দু দেবীদের কথা জানতে পারছে পশ্চিমের লোকজন, নারীশক্তি সম্পর্কে ধারণা খানিকটা বদলাচ্ছে। আকৃষ্টও হচ্ছেন অনেকে। কালীর মূর্তি তার মধ্যে সবচেয়ে চোখধাঁধানো। অন্য রকমও। ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ সেই মূর্তিতে। ফলে কালীর প্রতি টানও বোধ হয় খানিকটা বেড়েছে সে সব দেশে।’’
তা ছা়ড়াও, কালী যে হেতু বার বার ফিরে এসেছেন নানা শিল্পে, ফলে দেবী বেশি পরিচিতও এখন পশ্চিমে, এমনও ধারণা অনেকের। আমেরিকার ব্রুকলিন মিউজ়িয়ামে রাখা আছে মিক্সড মিডিয়া ইনস্টলেশন ‘দ্য ডিনার পার্টি’। শিল্পী জুডি শিকাগোর সেই কাজের একটি অংশে রয়েছেন কালী। সত্তরের দশকের এই শিল্পকর্ম নারীবাদ নিয়ে চর্চায় বিশেষ ভাবে জায়গা করে নিয়েছে সেই সময় থেকেই। স্বল্প কথায় বলতে গেলে, সেই শিল্পকর্ম সাম্যের দাবি জানিয়ে বার্তা দেয়। বিভিন্ন সংস্কৃতির শক্তিশালী নারীরূপকে তুলে ধরে। প্রজনন ও উর্বরাশক্তির উপাসনার উৎসের কথা তোলে। সেই শিল্প নিয়ে আলোড়ন কম হয়নি এক সময়ে।কিন্তু কালী কি সত্যিই এমন প্রতিবাদের প্রতীক? যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে মানবীবিদ্যার অধ্যাপক ঐশিকা চক্রবর্তী বলেন, ‘‘কালীকে নিয়ে ভাবনায় পরে অনেক বদল এসেছে। তবে কালী আসলে আগলহীন নারী, উদ্দাম এবং অসীম মহাকালের প্রতীক। বাকি দেবীদের থেকে অনেকটাই আলাদা। যে কালীকে আমরা ধীরে ধীরে ঘরের মেয়ে বা মা বানিয়ে তাঁর শক্তিকে কিছুটা প্রশমিত করেছি। যে রাত এখন দখল করার কথা তুলছেন মেয়েরা, সেই রাতকে কালী অনেক আগেই দখল করেছেন। তিনি পূজিত হন রাতে।’’
তবে পশ্চিম শুধুই কালীকে ভয়ঙ্কর রূপে দেখে মুগ্ধ হয়েছে বলে মনে করেন না রক-সঙ্গীতকার ও শিল্পী রূপম ইসলাম। যেমন লন্ডনের ‘দ্য রোলিং স্টোনস’ ব্যান্ডের লোগোর প্রসঙ্গই ধরা যাক। কালীর জিভ। তা দিয়েই লোগো। ১৯৬৯ সালের সেই লোগো নিয়ে চর্চা আজও থামেনি। সে ব্যান্ডের গায়ক মিক জ্যাগার নিজেই বলেছেন, কালীর জিভ বার করা মূর্তি দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন তিনি। তা দেখেই দু’টি ঠোঁট এবং সেখান থেকেই বার করা জিভ দিয়েই সেই লোগো তৈরি করা হয়। জন পেশ্যে নামে যে শিল্পী সেই লোগো তৈরি করেন, তিনি পরে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘‘আমি মিকের কথা শুনে ভারতীয় সংস্কৃতির দ্বারা প্রভাবিত কোনও কাজ করতে চাইনি। কারণ, ওই সময়টা ও রকমই ছিল। সকলেই হিন্দু সংস্কৃতির দিকে ঝুঁকছিল।’’ তিনি ভাবেননি, ওই লোগো এ ভাবে কালজয়ী তকমা পাবে। মিক কিন্তু লোগোর অন্য ব্যাখ্যা বুঝেছিলেন। তাঁর মনে হচ্ছিল, এই ঠোঁট আর জিভ বুঝিয়ে দেবে সমাজকে তোয়াক্কা না করার বিষয়টি। রূপমও সে কথাই বলছেন। এত দিন ধরে পশ্চিমের রক সংস্কৃতিকে তিনি যে ভাবে দেখেছেন, তার থেকে তাঁর মনে হয়েছে, ‘‘এ দেশে কালীর জিভ বার করার যে প্রচলিত ব্যাখ্যা, তার থেকে অনেকটাই আলাদা ধারণা তৈরি হয়েছে পশ্চিমে। প্রচলিত সমাজব্যবস্থাকে না মেনে বুড়ো আঙুল দেখানো যেমন হয়, জিভ দেখানোও খানিকটা এ ক্ষেত্রে তেমন। প্রথাকে ভেংচি কেটে দেখানো হচ্ছে যেন!’’ তবে রকশিল্পীদের জন্য বিশের দশকের মাঝের দিকে পশ্চিমের নানা দেশে বেশ পরিচিত হন কালী। এক দিকে যেমন ‘দ্য রোলিং স্টোনস’ নিজেদের লোগোতে নিয়ে আসে কালীকে, আর এক অতি জনপ্রিয় ব্যান্ড ‘দ্য বিটল্স’ নিজেদের ‘হেল্প!’ ছবিতে দেখায় কালীর মূর্তি। তা নিয়েও বেশ আলোড়ন তৈরি হয় সে সময়ে।
সময়ের সঙ্গে আরও নানা ভাবে নানা ক্ষেত্রেই ছড়িয়ে গিয়েছে কালী-চিন্তা। তা থেকে গিয়েছে নানা জনের কাজে। বিভিন্ন দেশে তৈরি এনসাইক্লোপিডিয়া থেকে তাত্ত্বিক বইপত্র, কালী নিয়ে চর্চা চলছে নানা ভাবে। আর জনপ্রিয় শিল্পীদের মাধ্যমে কখনও কখনও তা পৌঁছে যাচ্ছে আরও বহু জনের কাছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy