অটিজম নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে উদ্যোগ নিতে হবে বেশি করে।
২ এপ্রিল অটিজম সচেতনতা দিবস। সে উপলক্ষে কিছু কথা বলা প্রয়োজনীয়। যেমন, অটিজমকে এখন আর ‘একটি’ অসুখ বলে মনে করা হয় না। বৈজ্ঞানিকদের মতে, অটিজম হল নানা ব্যাধির একটি ‘স্পেক্ট্রাম’। বর্ণচ্ছটার মতো অটিজমেরও নানা ব্যাপ্তি আছে, বিভিন্ন ভাবে তার প্রকাশ হতে পারে।
এ বছর চতুর্দশতম অটিজম সচেতনতা দিবস পালন করছে জাতিসংঘ। গত বছর থেকে সারা পৃথিবী একটা ভয়াবহ অবস্থার মধ্যে দিয়ে চলেছে। সব সমস্যাতেই প্রান্তিকদের উপরে আঘাত আসে বেশি। অটিজমেও এই একই নিয়ম। যাঁদের অটিজম আছে, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তাঁদের আমরা ‘আলাদা’ বা ‘পৃথক’ করে রাখি। তাঁদের দায়ভার সমাজ সাধারণত নিতে আগ্রহী নয়। নির্দিষ্ট পরিবারকেই যাবতীয় সমস্যা ও দায় গ্রহণ করতে হবে, এই ভেবে নিজেদের সরিয়ে নিই। কিন্তু, গত কয়েক বছর ধরে জাতিসংঘ এই মনোভাবের বিপরীতে চলা শুরু করেছে। প্রতিবন্ধীদের অধিকার সম্পর্কিত জাতিসংঘ কনভেনশন মেনে নিয়েছে যে, ‘অন্যের সঙ্গে সমান ভিত্তিতে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের কাজ করার অধিকার’ অলঙ্ঘনীয়। সকলের অভিগমনযোগ্য কাজের পরিবেশ সৃষ্টি করা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।
জাতিসংঘের ডাকে সাড়া দিয়ে এর মধ্যেই একাধিক ক্ষেত্রে এই ধরনের মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। অটিজম এবং সেই সম্পর্কিত নানা সমস্যাকে একসময়ে প্রতিবন্ধকতা ভাবা হত। এখন তেমন মানুষদের চাকরিক্ষেত্রে স্থান দেওয়ার চেষ্টা শুরু হয়েছে। ফলত সামাজিক দায়ভার বহন করার উদ্দেশ্যে আরও বহু নিয়োগকর্তা চাইছেন অটিজম জাতীয় সমস্যা-সহ মানুষদের স্বাভাবিক, সাধারণ কর্মক্ষেত্রে কাজের সুযোগ করে দিতে।
যাঁদের অটিজম থাকে, তাঁরা সকলেই আমাদের মতো পঞ্চেন্দ্রিয় দিয়ে পৃথিবীর রূপ, শব্দ, ঘ্রাণ, স্পর্শ বা স্বাদ প্রত্যক্ষ করেন। কিন্তু তাঁরা যে ভাবে সেই অভিজ্ঞতার অর্থসৃষ্টি করেন, তা আর পাঁচ জন আপামর মানুষের মতো নয়। যা কিছু সাধারণের বোধগম্যতার বাইরে, তা নিয়ে মনুষ্যসমাজ চিরকালই অসহিষ্ণুতা প্রকাশ করে থাকে। এ ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম নেই। অথচ, যাঁরা অটিজমের অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে চলেছেন, তাঁদের কথা মন দিয়ে শুনলে আমরা বুঝি যে, তাঁরা সম্ভবত আমাদের চেয়ে অনেক বেশি অভিজ্ঞতা একই সঙ্গে প্রত্যক্ষ করেন। ফলে অতিরিক্ত তথ্য তাঁদের মস্তিষ্কে অস্বস্তি এবং কষ্টের সৃষ্টি করে। তার উপরে চিন্তার অনমনীয়তা, ভাষায় প্রকাশের অসুবিধা এবং সামাজিক আদান-প্রদানে অস্বাচ্ছন্দ্য তাঁদের সামাজিক পরিস্থিতিতে স্বাভাবিক চলাফেরায় বাধা সৃষ্টি করে। এই বাধা যেহেতু তাঁদের একার পক্ষে দূর করা সম্ভব নয়, তাই সকলের এগিয়ে আসা একান্ত প্রয়োজন। অটিজম সচেতনতা দিবসের মুখ্য উদ্দেশ্য এ-ই।
অটিজম-বান্ধব আবহ এমন এক সামাজিক অবস্থানের সৃষ্টি করবে বলে আশা করা যায়, যেখানে মানুষে মানুষে কথাবার্তা বলায়, সর্বজনীন অনুষ্ঠান আয়োজনে নমনীয়তা থাকবে। অটিজম যাঁদের আছে, সরলভাবে চিন্তার আদানপ্রদান করতে পারবেন তাঁরাও। সে সব পরিস্থিতিতে নানা রকম উদ্দীপক থাকবে না। যাতে তাঁরা অস্বস্তিতে না পড়েন। এবং শান্ত ভাবে কাজ করতে পারেন।
অতিমারির প্রকোপে সারা পৃথিবীতেই আর্থিক অনটন বেড়েছে। লক্ষ মানুষের রোজগারের এবং অন্নসংস্থানের অসুবিধা হয়েছে। একই সঙ্গে কম্পিউটার ভিত্তিক কাজের সংস্থান বেড়েছে। মুখোমুখি যোগাযোগ কমেছে। এই অবস্থায় যাঁদের অটিজম রয়েছে, তাঁরা কর্মক্ষেত্রে কাজ করতে পারবেন তুলনামূলক ভাবে সহজে।
এ বছরের অটিজম সচেতনতা দিবসে জাতিসংঘ এ সবই কেন্দ্রে রেখে ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নির্ধারণ করবে। অটিজম স্পেকট্রাম ডিজর্ডারে আক্রান্তদের সঙ্গে রেখে এ সবই আলোচনা করা হবে জাতিসংঘের সভায়। যাতে তাঁরা নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকে জানাতে পারেন, কর্মক্ষেত্রে কী ভাবে আরও সুযোগ করে দেওয়া যেতে পারে। এর ফল সব দিক থেকেই সুদূরপ্রসারী হবে এমন আশা করাই যায়।
(লেখক মনোরোগ চিকিৎসক)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy