সাত বা আটের দশকে কলকাতার সাবেক পাড়াগুলোয় যাঁরা ছেলেবেলা কাটিয়েছেন তাঁরা জানেন, বাঙালির পুজো আর নাটক তখন কেমন আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ছিল। ইদানীং ভবানীপুর, মনোহরপুকুর বা গড়চা রোডের মতো পুরনো এলাকার অলিতে-গলিতে যেমন আতসকাচ হাতে বাঙালি খুঁজে বেড়াতে হয়, তখন কিন্তু তা ছিল না। পুরনো পুরনো বাড়িগুলো নানা বয়সের আর নানা ধরনের মানুষে ভর্তি ছিল। দুগ্গাপুজো হয়ে গেলে সেই ফাঁকা মণ্ডপটিতে নাটক হবে, এটাই ছিল বেশির ভাগ পাড়ার দস্তুর। বাড়তি বলতে যোগ হত চালা থেকে ঝুলিয়ে দেওয়া পাঁচ-ছ’খানা মাইক। কে যেন শিখিয়ে দিয়েছিল ওগুলোকে মাইক বলতে নেই, বলতে হয় ক্যাচার। ক্যাচারের কাছে গিয়ে তোমাকে তোমার ডায়লগ থ্রো করতে হবে। শুনেই গা-টা কেমন শিরশির করে উঠেছিল।
যে কোনও পাড়াতেই তখন দুটো করে নাটকের গ্রুপ থাকত। একটা বড়দের। একটা ছোটদের। পয়লা বৈশাখের সময় থেকেই বড়দের গ্রুপের নাটক বাছাই শুরু হয়ে যেত। নাটক বাছাইয়ের প্রধান ক্রাইটেরিয়া ছিল, তাতে অন্তত দশ-বারোটা ক্যারেক্টার থাকতে হবে। আর তার সবই হতে হবে পুরুষ চরিত্র। পরের দিকে বিভিন্ন পাড়ার নাটকে দিদি-বউদিদেরও অংশ নিতে দেখেছি। কিন্তু আমাদের ছেলেবেলায় এমন কোনও স্মৃতি নেই। এক-আধ বার কোনও ফুটফুটে কিশোরীকে জাহানারা বা অত্যাচারী জমিদারের আদরের মেয়ে বানিয়ে হয়তো মঞ্চে নামানো হয়েছে, কিন্তু সে-ও দু-চার মিনিটের বেশি নয়।
নাটকের মেন ক্যারেক্টারগুলো, ভাল চেহারার এবং ভাল অভিনয় করে, এমন অভিনেতাদের জন্যে বরাবরই সরিয়ে রাখা হত। কিন্তু সরিয়ে রাখলেই তো আর হল না। সেগুলো করা নিয়ে আবার কিছু মান-অভিমানের পালাও চলত। ধরা যাক, পাঁচ ফুট দু-ইঞ্চির শিবনাথ ভদ্র বেঁটেখাটো ভুঁড়িওয়ালা মানুষ। গোল্লাদা নামেই তিনি পাড়ায় পরিচিত। পাড়ায় এ বার ‘ছত্রপতি শিবাজি’ হচ্ছে জেনে তিনি এক দিন ভরা সন্ধেয় দুধ-চায়ের গ্লাস হাতে ছলোছলো চোখে বললেন, ‘‘বুঝলি বক্সি...(৩২ সেকেন্ডের একটি পজ) আমার বহু দিনের সাধ ছিল...(এ বারের পজ ৪২ সেকেন্ডের)...আমি এক দিন মঞ্চ কাঁপিয়ে শিবাজি করব! সুনীল বক্সি বারুইপুরের একটি সেকেন্ডারি স্কুলের ইতিহাসের টিচার। নাটক অন্ত প্রাণ। তাঁর গানের গলাটিও ভারি চমৎকার। বক্সিকাকু, তাঁর গোল্লাদার কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বললেন, ‘‘কিন্তু দাদা, ইতিহাস জানে, শিবাজির কোনও বয়সেই কোনও ভুঁড়ি ছিল না। আর লোকটা লম্বায় ছিল প্রায় সাড়ে ছ’ফুট! তুমি শিবাজি করলে...,’’ বক্সিদার কথা মাঝপথে থামিয়ে ঢুলুঢুলু চোখে গোল্লাদা বললেন, ‘‘চেহারাটাই কি জীবনের সব হল রে! অভিনয় কি কিছু নয়! বক্সিদা কাঁচুমাচু মুখে বললেন, ‘‘তুমি এ বারের মতো আফজল খাঁ কর দাদা। আর অন্তুই শিবাজিটা করুক। বাঘনখ দিয়ে তোমার ভুঁড়ি ফাঁসানোর একটা দুর্ধর্ষ সিন আছে— পাবলিক হাততালিতে ফেটে পড়বে...আমার কথা তুমি মিলিয়ে নিও!’’
আরও পড়ুন: পকেটমারি তো ‘হস্তশিল্প’-র বাইরে নয় রে বাবা!
এই ভাবে কে কোন চরিত্র করবে সেটা মোটামুটি ঠিক হয়ে যাওয়ার পর শুরু হত রিহার্সাল। মঞ্চের কিছুটা অভিজ্ঞতা আছে, দু-একটি ভাল নাটক করেছেন, এমন কেউ সেই নাটকের ডিরেকশন দিতেন। নানা মড্যুলেশনে ডায়লগ বলা, হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ ঘাড় মুচড়ে তাকানো, কাঠের তরোয়াল বা প্লাস্টিকের বন্দুক কারও কপালে ঠেকিয়ে হা-হা করে হেসে ওঠা— আমাদের মতো পুটকেদের কাছে এ সবের যে কী রোমাঞ্চ ছিল তা বলে বোঝাতে পারব না! মহলার জন্য কারও বাড়ির একতলার বৈঠকখানা পেলে সন্ধে সাড়ে ছটা থেকে নটা। আর ক্লাবঘরে হলে সেটা আরও একটু রাত অব্দি গড়াত। মাঝে মাঝে লিকার চা আসত। মুড়ি তেলেভাজা আসত। আমাদের পড়াশোনা থাকত বলে কদাচিৎ সেখানে এন্ট্রি পেতাম। কিন্তু যে দিন পেতাম সে দিন পথের ধারে ফুটে থাকা সন্ধ্যামালতী ফুলের ফিকে গন্ধটুকুও পাশে বাবু হয়ে বসে যেত রিহার্সাল দেখতে। একটা ব্যাপার ভারি মজার ছিল। নাটকে এ বছর যিনি যে চরিত্রটি করছেন, বহু দিন পর্যন্ত তাঁকে সেই নামেই ডাকা হত। যেমন ব্রজজেঠুকে ‘মাস্টারদা’, দিলীপকাকুকে ‘ইনস্পেক্টরসাহেব’, আবার নির্মলদার স্টেশনারি দোকানে গিয়ে অনেককেই বলতে শুনেছি, ‘‘জমিদারবাবু একটা মিন্ট ফ্লেভারের ভাল পেস্ট দিন তো, সঙ্গে কি টুথব্রাশ ফ্রি আছে?’’
আমাদের ছোটদের যে আধ ঘণ্টার নাটক তার বেশির ভাগই ছিল সুকুমার রায়। ‘অবাক জলপান’, ‘পাগলা দাশু’, ‘রাজার অসুখ’। যা-ই হোক না কেন, বন্ধুরা মিলে রিহার্সাল দেওয়ার জন্য প্রাণ যেন আকুলিবিকুলি করত। বিকেলবেলা স্কুল থেকে ফিরে ঘণ্টাখানিক রিহার্সাল। বড়রা কেউ দাঁড়িয়ে থেকে আমাদের রিহার্সাল করাতেন। যদি জানতে পারতাম, আমার চরিত্রটির গোঁফ বা দাড়ি আছে অথবা মাথায় মুকুট বা হাতে তরোয়াল নিতে হবে, তবে আনন্দের সীমা থাকত না। কারণ এ সব থাকলে তবেই তো নাটক। নইলে অভিনয় করে লাভ কী!
প্রতি বারই নাটক হত একাদশীর দিন। আর নবমী থেকে মাইকে ঘনঘন তার অ্যানাউন্সমেন্ট চলত। এ বারের নাটকে যে ইচ্ছে থাকলেও কোনও রোল পায়নি, এমন এক জনকে ওই অ্যানাউন্সমেন্টটি করতে দেওয়া হত। বাবাইদা সামান্য তোত্লা হলেও তাকে কিন্তু এ-সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হয়নি। অনুষ্ঠানের দিন সন্ধের মুখে প্রথমেই কুঁচো বাচ্চাদের বিচিত্রানুষ্ঠান হত। এতে ‘প্রজাপতি প্রজাপতি’ এবং ‘হা রে রে রে’ এই দু’টি গানের সঙ্গে নাচ ছিল মাস্ট। সঙ্গে রকমারি লাইটিং। এর পর কচি গলায় দু-একটি আবৃত্তি এবং মোটা গলায় একটি দু’টি রবীন্দ্রনাথের গান। আর তার ঠিক পরেই শুরু হত আমাদের নাটক। আমাদের নাটক যেমনই হোক না কেন, তাতে প্রচুর হাততালি পড়ত। তার পর মঞ্চের শার্টিনের পর্দা এগিয়ে আসত দু’পাশ থেকে, আর মাঝখানটা মুঠো করে ধরে কেউ ভেতরে দাঁড়িয়ে থাকতেন। কারণ এই সময় মঞ্চের উপর বড়দের নাটকের সেট সাজানো হত।
আরও পড়ুন: নতুন জুতোর হয়রানি? উপায় থাকতে চিন্তা কী?
ছোটদের নাটকের যে মেকআপ বা সাজপোশাক, তা করানো হত মঞ্চের কাছেই কারও বাড়ির একতলার বৈঠকখানা ঘরে। সেখান থেকেই আমরা ধুতি-ফতুয়া-চশমা পরে ছড়ি হাতে বেরিয়ে, সকলের ‘ও লে বাবা-লে, কী মিত্তি লাগচে লে!’ ইত্যাদি আদরসূচক মন্তব্য শুনতে শুনতে গর্বভরে মঞ্চে ওঠার সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যেতাম। কিন্তু বড়দের বেলায় এটা হলে তো সব সাসপেন্স-ই মাটি। তাই তাঁদের একটা গ্রিনরুম (এক বার ড্রেসিংরুম বলাতে কে যেন এই শব্দটা শিখিয়ে দিয়েছিলেন) প্যান্ডেলের ডেকরেটার আলাদা করে বানিয়ে দিতেন মঞ্চের একদম গা-ঘেঁষে। সেখানেই অভিনেতারা ড্রেস পরতেন। মেকআপ নিতেন। তাই আমাদের নাটক শেষ হলে, নিজের নিজের কোটার টিফিন নিয়ে আমরা পড়িমরি করে সেই গ্রিনরুমের দরজায় গিয়ে উঁকিঝুঁকি মেরে দ্যাখার চেষ্টা করতাম, কাকে মেকাপ করে কেমন লাগছে, আর নিশ্চিত ভাবেই বকুনি খেতাম।
বড়দের নাটক যেমন একটু দেরিতে শুরু হত, তেমনই শেষও হত একটু রাতে। তার পর চলত সেই নাটক নিয়ে চুলচেরা আলোচনা। শেখরকাকু এমনিতে সিগারেট খান না, কিন্তু তিনিও সে দিন আনন্দে ও উত্তেজনায় সিগারেট ধরিয়ে ফেলতেন। আমরা ছোট বলে বড়দের নাটক শেষ হলেই সোজা বাড়ি চলে আসতাম। কিন্তু মন পড়ে থাকত সেই লাল-নীল-হলুদ আলোছায়ার ভেতর। কানে লেগে থাকত নাটকের মিউজিকের রেশ। অনেক দিন পরেও যা আমাদের ছেড়ে চলে যেত না। যেমন আজও যায়নি।
অলঙ্করণ: দেবাশীষ দেব।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy