Advertisement
০৩ নভেম্বর ২০২৪
Durga Puja Celebration

ভোরের শিউলি, রাতের ছাতিম নিয়ে পুজো আসছে

অমন দুধসাদা একটি ফুল, যার বৃন্তটি নরম কমলা, তারা কি না দলে দলে মাটিতে ঝরে পড়েছে, দেখেও কেমন একটা অস্বস্তি হত।

রজতেন্দ্র মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ১৬:১১
Share: Save:

শরৎকালের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর হল কাশফুল। কিন্তু শহর কলকাতায় তাকে সে ভাবে দেখতে পাওয়া যায় না। এক সময় গড়ের মাঠের কোনও কোনও মেঠো খোঁদলের পাশে কিছু কাশফুল ফুটে থাকতে দেখা যেত, কিন্তু এখন সে সব গল্পকথা। কাশ ছাড়া আর যে সব ফুল শরৎকালে ফোটে তার মধ্যে প্রথমেই যে ফুলটির নাম আমার মনে পড়ল সে হল শিউলি। আমাদের ভবানীপুরের বাড়ির উঠোনে একটা মাঝারি মাপের শিউলি গাছ ছিল, যার পাতা বেটে আমাদের রস খাওয়ানো হত।

পুজোর সময় ভোরবেলায় উঠে দেখতাম তার পায়ের কাছে অজস্র ফুল ঝরে পড়ে আছে। অমন দুধসাদা একটি ফুল, যার বৃন্তটি নরম কমলা, তারা কি না দলে দলে মাটিতে ঝরে পড়েছে, দেখেও কেমন একটা অস্বস্তি হত। কেউ পাশ দিয়ে সাবধানে হেঁটে গেলেও তো দু-চারটে ঠিকই মাড়াবে। পরে বিখ্যাত গায়ক এলভিস প্রিসলিকে নিয়ে একটা সত্যি গল্প শুনেছিলাম। মাটিতে চুল খুলে শুয়ে থাকা অজস্র সুন্দরীর চুলের ওপর দিয়ে জুতো পায়ে হেঁটে এলভিস গান গাইবার জন্য মঞ্চে উঠেছিলেন। মনে মনে সেই না-দেখা সুন্দরীদের কল্পনা করতে গিয়ে আমার শিউলিফুলের চেহারাটাই ভেসে উঠেছিল।

আসলে সূর্য উঠলেই শিউলি ঝরে পড়ে। কেন, তা কেউ জানে না। এই ফুলটির অন্য নাম পারিজাত। পুরাণের একটা গল্প থেকে জানা যায়, নাগরাজার পরমাসুন্দরী মেয়ের নাম ছিল পারিজাতিকা। সে নাকি সূর্যদেবের প্রেমে পড়েছিল। অনেক চেষ্টাচরিত্র করেও সেই মেয়ে যখন সূর্যদেবকে বর হিসেবে পেল না, তখন সে আত্মহত্যা করল। তাকে পুড়িয়ে দেওয়ার পর তার পোড়া ছাই থেকে জন্ম নিল পারিজাত গাছ আর সেই গাছে যে ফুল হল তারা সূর্যের আলোর ছোঁয়া পাওয়া মাত্রই চোখের জলের মতো ঝরঝর করে ঝরে পড়ল মাটিতে। শরত-হেমন্তের ভোরবেলায় শিউলিফুলের গায়ে লেগে থাকা শিশিরকে এই কারণেই বোধহয় অশ্রু বলে মনে হয় আমাদের। আর রবীন্দ্রনাথ যে লিখেছেন, ‘ঝরা শেফালির পথ বাহিয়া...’ এখানে শেফালিও তো সেই শিউলিফুলেরই আর এক নাম!

আরও পড়ুন: ঘরের কোণ সাজান মনের মতো করে​

আরও পড়ুন: রান্নাঘর সেজে উঠুক আধুনিকতার ছন্দে​

আরও পড়ুন: বয়স্কদের ঘর দিয়ে শুরু হোক সেজে ওঠার পালা​

শিউলির পরেই দ্বিতীয় যে ফুলটি আমাদের পুজো এসে গেছে বলে চিনিয়ে দেয়, সে হল ছাতিম। ভবানীপুরের মিত্র স্কুলের পাশে আর হরিশ পার্কের পিছন দিকটায় একসময় দু’-তিনটে ছাতিম গাছ ছিল। আমরা ছাতিম গাছ যবে চিনেছি, তার ঢের আগে চিনে ফেলেছি ছাতিম ফুলের মাথা খারাপ করা গন্ধকে। এই গন্ধটা যেন ওড়না-জড়ানো হাত দিয়ে আমার হাতটি ধরে আলতো করে কাছে টানত। নিশিডাকা মানুষের মতো কোনও এক অচেনা রাস্তায় টেনে নিয়ে যেত বটে, কিন্তু ধরা দিত না। আসলে ওই রকম সটান লম্বা, মাথার ওপর বিশে ডাকাতের মতো ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া চুল বোঝাই একটা গাছের, সবুজ আর সাদায় মেশানো যে থোকাবাঁধা ছোট ছোট ফুল, তার যে এমন পাগল করা গন্ধ হতে পারে, সে বয়সে বুঝব কী ভাবে! এই ফুল সন্ধের মুখে ফুটলেও রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে গন্ধের মাদকতাও বাড়ে। জানি না, এই গাছের তলাটিকে আগেকার দিনের সাধুসন্নেসিরা জপতপের জন্য বেছে নিতেন কী করে! শান্তিনিকেতনেও দেখেছি বিখ্যাত ছাতিমতলা রয়েছে। অথচ এর গন্ধে তো ঠাকুরদেবতার বদলে অপ্সরা-কিন্নরীদের কথাই মনে আসা স্বাভাবিক। মনে পড়া উচিত এই পৃথিবীর সমস্ত না-পাওয়া প্রেমের কথা, তপ্ত বিরহের কথা।

ঝাঁকড়া মাথার এই গাছটিকে রাত্তিরবেলা হঠাৎ দেখে গাঁ-গঞ্জের মানুষেরা মনে করতেন, এই গাছে নাকি ভূত-পেত্নি থাকে। বাংলার একটা প্রাচীন লোকছড়ায় রয়েছে, ‘শ্যাওড়া গাছে পেত্নি ঠাসা, ছাতিম গাছে ভূতের বাসা।’ এই কারণেই হয়তো এই গাছটির ইংরেজি নাম ডেভিল ট্রি। আর হ্যাঁ, কালীপুজোর সময়েও এই ছাতিমফুলের গন্ধ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে বইকি!

সে গন্ধ ডাকিনি-যোগিনীদের যে ভাল লাগে না, সে কথা হলফ করে কে কইবে!

অলঙ্করণ: দেবাশীষ দেব।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE