জলবেলুনের আঘাতে এই ভাবেই বেরিয়ে আসতে পারে চোখের অংশ। প্রতীকী ছবি।
দোলের দিন দু’য়েক পরের ঘটনা। পরিবারের লোকজনের সঙ্গে নিজের বিয়ের বাজার করতে রবীন্দ্র সরণি দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন এক যুবক। কিছু বুঝে ওঠার আগেই চোখে প্রবল জ্বালা অনুভব করেন তিনি। হাত দিয়ে মুখ ঢেকে বসে পড়েন রাস্তায়। পরিবারের লোকেরা দেখেন, রবীন্দ্র সরণির একটি বহুতল থেকে নীচের দিকে লক্ষ্য করে রং ভরা বেলুন ছোড়া হচ্ছে। তারই একটি লাগে ওই যুবকের চোখে। বছরখানেক আগের সেই ঘটনায় ওই যুবকের বিয়ে পিছিয়ে দিতে হয়। বেলুনের আঘাতে বেরিয়ে আসে চোখের তারা। জটিল অস্ত্রোপচারে দৃষ্টিশক্তি না হারালেও আগের মতো আর দেখতে পান না তিনি।
চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, দোল উৎসব মিটলে এমন বহু ঘটনাই সামনে আসে প্রতি বছর। তাঁদের পরিভাষায় যাকে বলে, ‘ব্লান্ট ট্রমা’। যার জেরে ‘ট্রম্যাটিক ক্যাটারাক্ট’ থেকে শুরু করে রেটিনা ছিঁড়ে যাওয়ার মতো ঘটনাও ঘটতে পারে। বহু ক্ষেত্রে চোখ ফেটে যাওয়ায় কর্নিয়া বদলের ঘটনাও ঘটেছে! চলতি বছরে বেপরোয়া দোল উৎসব যাপনের আগে এমন সব বিষয় নিয়েই সতর্ক করতে চাইছেন চিকিৎসকেরা। তাঁরা বলছেন, ‘‘দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হলে চোখের মতো ইন্দ্রিয়ের বিপদ অবধারিত। রং মর্মে লাগুক, চোখে নয়।’’
চক্ষু চিকিৎসক জ্যোতির্ময় দত্ত জানালেন, এ শহরে হাজার দশেকেরও বেশি মানুষ দোলের দিন চোখে অন্ধকার দেখেন। এর বড় কারণ, রং ও আবিরে ধাতুর ব্যবহার। চিরাচরিত অভ্র-মিশ্রিত আবির চোখ জ্বালা করায় এবং অঝোরে জল ঝরায়। আবির মূলত ক্ষারধর্মী। এর প্রভাবে চোখের সংবেদনশীল অংশ ঝলসে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। অনেক ক্ষেত্রেই ‘কর্নিয়াল বার্ন’-এর অন্যতম কারণ আবির। চোখের ভিতরের ‘এপিথেলিয়াল টিসু’-কে পুড়িয়ে দিতে পারে শুকনো আবির। কুমকুম ব্যবহার করা হয়, এমন আবিরে ক্ষতির আশঙ্কা বেশি। এর উপাদান হিসাবে ব্যবহৃত অভ্র বা কাচের গুঁড়োয় কর্নিয়া ছড়ে যায়। এমনকি, ফুটোও হয়ে যেতে পারে বলে তাঁর মত।
জ্যোতির্ময়বাবুর কথায়, ‘‘দোলের পরে চোখের বিভিন্ন অংশে কেমিক্যাল বার্নের ঘটনা দিন দিন বাড়ছে। বেলুন সব চেয়ে বেশি ক্ষতিকর। চোখ বাঁচাতে তাই চশমা পরে রং খেলা ভাল। দেখা যায়, প্রথমে মাথা এবং তার পরে মুখে ঘষে ঘষে রং মাখানো হয়। তাই কখনওই লেন্স লাগিয়ে রং খেলা উচিত নয়। মাথায় টুপি পরে চুল বাঁচানো গেলে খুব ভাল হয়। চোখের পক্ষে অ্যাসিড বার্নের থেকেও বেশি ক্ষতিকর অ্যালকালি বার্ন।’’ তিনি আরও জানান, লাল রঙে থাকে পারদের যৌগ। যা চোখে ঢুকলে চোখ ফুলে জল পড়ে, ব্যথা হয়। সবুজ রঙে থাকা কপার সালফেটে চোখ লাল হয়ে কড়কড় করে। অ্যালার্জির ফলে চোখ খুলে রাখা কঠিন হয়ে যায়। উজ্জ্বল হলুদ রঙে থাকা সিসা স্নায়ুর ক্ষতি করে। নীল রঙে আছে ‘প্রুসিয়ান ব্লু’, এটি অক্ষিপল্লব-সহ সমস্ত চোখে অস্বস্তি সৃষ্টি করে। রুপোলি ও সোনালি রঙের উপাদান ক্যানসারের কারণ হতে পারে।
চক্ষু চিকিৎসক শৌভিক বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, ‘‘মাথায় রাখতে হবে, চোখে রং বা আবির ঢুকলে কখনওই রুমাল দিয়ে তা রগড়ানো উচিত নয়। আঁজলা করে জল নিয়ে তাতে চোখ ডুবিয়ে পিটপিট করলে অনেক ক্ষেত্রে রং বেরিয়ে যায়। কেউ এক জন চোখের পাতা আলাদা করে ধরার পরে অন্য জন ঠান্ডা জল ধীরে ধীরে চোখে ফেললেও উপকার পাওয়া যায়। দরকার পড়লে ডাক্তারের পরামর্শে অ্যান্টিবায়োটিক ড্রপ ব্যবহার করতে হবে।’’
চর্মরোগ চিকিৎসক কৌশিক লাহিড়ীর পরামর্শ, ‘‘মনে রাখতে হবে, গায়ে যেন বেশি ক্ষণ রং লেগে না থাকে। দ্রুত তা ধুয়ে ফেলতে হবে। ত্বক ছাড়াও চুল এবং নখ বাঁচিয়ে চলা জরুরি। তবে, রং না উঠলে কেরোসিন বা অন্য কিছু দিয়ে ঘষাঘষি করার দরকার নেই। দুধের শিশুদের নিয়ে দোল না খেলাই ভাল।’’ সেই সঙ্গেই তাঁর প্রশ্ন, ‘‘ভেষজ আবিরের নামে বাজারে যা বিক্রি হচ্ছে, তা নিয়ে প্রশাসন কঠোর হয় না কেন? কোনটা ভেষজ আর কোনটা নয়, দেখছেই বা কে? সচেতনতাই একমাত্র পথ?’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy